অবশেষে সরকার নির্বাচন করেই ফেলল। এখন এ নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মামুন আহমেদ: এটি আসলে অর্থবহ নির্বাচন হয়নি। কারণ, এটি ছিল সাজানো নির্বাচন। সরকার যাকে চেয়েছে সে-ই নির্বাচিত হয়েছে, যাকে চায়নি সে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেনি। নির্বাচনটি ছিল একতরফা, যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁরা প্রায় সবাই একই রাজনৈতিক ঘরানার। তাঁদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, অনেক জায়গায় সেটিও হয়নি। এখন যাঁরা পরাজিত হয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য দেখলেই বোঝা যায়, সরকারনিয়ন্ত্রিত একটি নির্বাচন এখানে হয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনের আয়োজন শুরু থেকেই ছিল ত্রুটিপূর্ণ, সেখানে স্বচ্ছতার অনেক অভাব ছিল।
যার কারণে কেউ এটিকে প্রহসনের নির্বাচন বলছে, কেউ ডামি নির্বাচন বলছে। ফলে জনপ্রতিনিধিত্বশীল একটি সংসদ গঠনের জন্য যে স্বচ্ছ নির্বাচনের দরকার ছিল, তা হয়নি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ৬৩টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তারা কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, এমন নয়। মূলত প্রহসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। যেহেতু এ নির্বাচন শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল, তাই জনগণের প্রতি তারা আহ্বান জানিয়েছিল নির্বাচন বর্জনের। আর জনগণও সে দাবির প্রতিফলন দেখিয়েছে। ভোটের হারেই তা স্পষ্ট।
নতুন সরকারে বিরোধী দল কারা হবে, সেটি নিয়ে একধরনের সংকট দেখা যাচ্ছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
মামুন আহমেদ: সত্যিকার অর্থে আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট করা নেই, কতজন নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকলে সংসদের বিরোধী দল হতে পারবে। কিন্তু আমাদের সংসদের রেওয়াজ হচ্ছে, কোনো দলে ২৫ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকলে তারা বিরোধী দল হতে পারবে। এবারের নির্বাচনে কিন্তু তেমন কোনো দল দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা প্রায় একই দলের। এখান থেকেই হয়তো একটা বিরোধী দল হবে। তবে সেটি প্রকৃত বিরোধী দল হবে না। সরকারের বানানো বিরোধী দল হবে। যারা সব সময় সরকারের অনুকম্পাতেই থাকবে।
এটি তো আসলে একদলীয় সংসদ। এখানে বিরোধী দল কারা হবে, তা গুরুত্বহীন। ফলে এ সংসদকে কোনোভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বশীল বলা যাবে না। এ সংসদের মাধ্যমে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটেরও কোনো সুরাহা হবে না। সেই সংকট আরও বেশি বাড়বে। প্রকৃত বিরোধী দলবিহীন এমন সংসদে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের বাস্তবতাও থাকে না।
নতুন সরকারের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হলো। অনেকে বাদ পড়লেন, অনেকে নতুন এলেন। এ মন্ত্রিসভা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
মামুন আহমেদ: যে প্রক্রিয়ায় এ সংসদ এবং একটি সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশার খুব বেশি জায়গা থাকে না। দেশের মানুষের দৈনন্দিন যে সমস্যাগুলো আছে, দেশ পরিচালনায় যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, সেগুলোর সমাধান বা মোকাবিলার জন্য তারা হয়তো চেষ্টা করবে, কিন্তু কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
সরকার পরিবর্তনে বিএনপি আন্দোলন করে আসছিল। তারা সফল হতে পারল না। তাদের কৌশলে ভুল ছিল মনে করেন কি না?
মামুন আহমেদ: বিএনপি সফল হয়নি, এ কথা বলার সুযোগ নেই। বিএনপি প্রথম থেকে কী চেয়েছে? একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণে যে রাজনৈতিক সংকট দেশে আছে, এর সমাধান চেয়েছে। তাদের দাবির মূলে ছিল কার্যত গণতন্ত্র–ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং একটি মানবাধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করা। বিএনপির এ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা রেখেছে। নির্বাচন বর্জনের জন্য বিএনপির আহ্বানে সারা দেশের মানুষ সাড়া দিয়েছে। আমার তো মনে হয়, ২-৫ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দিতে যায়নি। নির্বাচন কমিশন যে ভোটের হার দেখিয়েছে, সেখানেও কারচুপি হয়েছে বলে আমি মনে করি। তার মানে মানুষ বিএনপির রাজনীতির প্রতি আস্থা রেখেছে। যেভাবেই হোক সরকার আবার ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু আমি মনে করি, এখানে রাজনৈতিকভাবে বিএনপিরই জয় হয়েছে।
বলা হচ্ছে, ২৮ অক্টোবরের পর গোটা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ফলে নির্বাচন নিয়েও দুশ্চিন্তা কেটে যায় সরকারের। কী মনে করেন?
মামুন আহমেদ: সরকারের এই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল রাজনীতির মাঠে বিএনপির নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি। সরকারের প্রয়োজন ছিল সেই বাধাটা উপড়ে ফেলা। সেটি করতে গিয়ে সরকার সব ধরনের রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে অনৈতিক ও অরাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠ থেকে বের করে দিয়েছে।
নিজেরা সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেয়ে বিএনপি যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা শক্তির ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছিল, এমনটা আলোচনা আছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
মামুন আহমেদ: দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। বিএনপি সাধারণ মানুষের এ মনোভাবকে দাবি আকারে সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে গেছে। সাধারণ মানুষের এ প্রত্যাশার সঙ্গে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বের মনোভাবও এক হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের দাবিকেই তারা আসলে সমর্থন করেছে।
অনেকের আশঙ্কা, এই নির্বাচনের পর বিএনপির ওপর আরও চাপ আসবে। এমনকি দলটি নিষিদ্ধ করার উদ্যোগও নেওয়া হতে পারে বলে আলোচনায় আছে। সরকারি দলের একজন মন্ত্রী বলেছেন, অগ্নিসন্ত্রাসের মূলোৎপাটন নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ। আপনি কি মনে করেন, সরকার সত্যিই বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেবে?
মামুন আহমেদ: আমি তেমনটি মনে করি না। মন্ত্রীর এ বক্তব্য রাজনৈতিক, বাস্তবভিত্তিক নয়। বিএনপির ওপর যে সাধারণ মানুষের আস্থা আছে, তা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের নামে আয়োজনের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে। ফলে এ ধরনের একটি বিপুল জনভিত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হবে না।
বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে দেখি। সেটিকে কীভাবে দেখেন?
মামুন আহমেদ: যাঁরা আসলে বিএনপিকে ব্যাকফুটে দেখতে চান, তাঁরাই আসলে এমন প্রশ্ন তোলেন। আমার মনে হয় না, বিএনপিতে দলীয় নেতৃত্বের কোনো সংকট আছে। দলটির চেয়ারপারসন একপ্রকার গৃহবন্দী এবং অসুস্থও। তাঁর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলটিকে এগিয়ে নিচ্ছেন। তিনি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিলে এক–দেড় বছর ধরে দলটির যে সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক কর্মসূচি আমরা দেখলাম, তা দেখা যেত না। এতে বোঝা যায়, বিএনপির নেতৃত্বে একটি সাংগঠনিক কাঠামো আছে এবং যৌথ সিদ্ধান্তে তা পরিচালিত হয়।
বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপির সামনে এখন পথ কী?
মামুন আহমেদ: আমি মনে করি, বিএনপি যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, সেটিকেই অব্যাহত রাখা উচিত। যেহেতু সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার দাবি নিয়েই তারা কর্মসূচি চালিয়ে আসছে এবং এক দফার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে, সেটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়াই হবে বিএনপির জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মামুন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।