ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিল। কী পরিবর্তন লক্ষ করছেন?
মজিবুর রহমান মঞ্জু: বড় একটি বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলো। এখন আমরা আশা করছি, একটি পরিবর্তন আসবে। ড. ইউনূসের কাছে প্রত্যাশা, তিনি ধীরে ধীরে আমাদের বড় পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবেন। ফ্যাসিবাদী সরকার বিদায় নিলেও ফ্যাসিবাদী কাঠামো ও আবহ এখনো বিরাজমান। সেটি তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। অনেকের মতে, তাঁর টিমটি আরও শক্তিশালী হওয়ার দরকার ছিল। আশা করব, তিনি তাঁর টিমটি আরও গুছিয়ে নেবেন, আরও বিশেষজ্ঞ মানুষের সহযোগিতা নেবেন।
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে অনেকগুলো কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আপনাদের মতামত কী?
মজিবুর রহমান: কমিশনগুলোর কার্যক্রম কিছুটা ধীরগতির মনে হচ্ছে। সবার আগে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাজটি শেষ হওয়া দরকার। কারণ, সাংবিধানিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করবে বাকি বিষয়ের সংস্কারগুলো। সংবিধানে যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ রাখা হয়; রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রাখা হয়; টানা দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে কি না; নির্বাচনপদ্ধতি কী রকম হবে—সেই আলোকে কিন্তু নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনিক কাঠামো ঠিক করা হবে।
সংবিধান সংশোধন, নাকি পুনর্লিখন—কোনটির পক্ষে আপনারা?
মজিবুর রহমান: সংবিধান এমন একটি জিনিস, চাইলে পুরোপুরি ছুড়ে ফেলা যায় না। সংবিধানে অনেক ভালো দিকও আছে। নতুন করে লিখলেও দেখা যাবে আগের অনেক কিছু সেখানে থেকে যাবে। তবে আমরা চাই সংবিধানের ভাষাটা সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য হোক। নিঃসন্দেহে কাঠামোগতভাবে অনেক কিছু পরিবর্তন হবে। কিন্তু সংবিধানের সবকিছু তো আমরা মানি না। আমাদের মানার সংস্কৃতিটা চালু করতে হবে।
নির্বাচনপদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত? কত দিনের মধ্যে নির্বাচন চান?
মজিবুর রহমান: এখানে বিবেচনায় রাখা উচিত রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য এবং দেশটাকে গণতান্ত্রিক ভিতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য কোনটা উপযোগী, সেটি। আনুপাতিক নির্বাচনপদ্ধতিটা বিভিন্ন উন্নত দেশে চালু আছে। আমাদের দেশেও এটি চালুর পক্ষে আমরা। তবে তার আগে প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য।
আমরা সরকারকে বলেছি, দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া উচিত। কেয়ারটেকার সরকারের মেয়াদ ছিল তিন মাস। প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঠিক থাকলে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। বিগত অভিজ্ঞতা সেটিই বলে। কিন্তু এখানে অনেক কিছু সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কমিশনের সুপারিশ, আইনশৃঙ্খলা ঠিক করা, সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা—এসবের জন্য সরকার এক থেকে দেড় বছর সময় নিলেই যথেষ্ট। এরপরে তিন মাসের মধ্যে চাইলে নির্বাচন করা যায়।
বিএনপি ও জামায়াত অন্য দলগুলো নিয়ে আলাদা আলাদা তৎপরতা চালাচ্ছে। আপনারা কোন দিকে আছেন?
মজিবুর রহমান: শুরু থেকেই আমরা কোনো জোটের সঙ্গে ছিলাম না, এখনো নেই। তবে সব দলের সঙ্গে অর্থাৎ বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য বাম দল ও ইসলামি দলের সঙ্গে আমাদের মতবিনিময় হয়েছে। তবে শুধু জামায়াত ছাড়া, কারণ দলটি আমাদের সম্পর্কে শুরু থেকে নানা প্রকার অপপ্রচার চালিয়েছে, হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। সে জন্য তাদের সঙ্গে আমাদের একটা রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তারা ছাড়া বাকিদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।
আপনিসহ আপনার দলের অনেকে জামায়াত-শিবিরের নেতা ছিলেন। কিন্তু আলাদা দল গঠনের প্রয়োজন মনে করলেন কেন?
মজিবুর রহমান: শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত জামায়াতে ইসলামীতে অন্য ধর্মের মানুষ, যারা এ দেশের নাগরিক, তাদের দলটিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কম। সব ধরনের মানুষের অন্তর্ভুক্তি না থাকলে কোনো দলের পক্ষে সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা বা শাসন করার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমরা মনে করেছি মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা নিয়ে জামায়াতের সুস্পষ্ট অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার।
তৃতীয়ত, জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামোগুলো বেশ পুরোনো, আমরা সেখানে সংস্কার আনার কথা বলেছিলাম। দলের নেতা হিসেবে এসব দাবি করাটা আমাদের অধিকার ছিল। কিন্তু সেখানে আমাদের দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দেওয়া হয়। একটা পর্যায়ে আমরা বুঝতে পেরেছি যে জামায়াত নিজের ভেতরে সংস্কার আনতে আগ্রহী নয়। ফলে আমরা কেউ পদত্যাগ করেছি, কাউকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সে রকম কয়েকজন মিলে আমরা একটা নতুন রাজনৈতিক দলের সূচনা করেছি।
ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হলো, আওয়ামী লীগের ব্যাপারে আপনাদের মত কী?
মজিবুর রহমান: আওয়ামী লীগ দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সর্বোপরি স্বাধীনতার স্বপ্নকে তিলে তিলে ধ্বংস করেছে। এ ধরনের একটি গণবিরোধী ও মানবতাবিরোধী দল থাকতে পারে কি না, তার একটি জনমত তৈরির বিষয় আছে। আমরা দলটিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিষিদ্ধ করার পক্ষে এবং অবশ্যই আইনগত প্রক্রিয়ায়।