সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনটি ছিল মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। পরে এটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়ল কেন?
সিউতি সবুর: এবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছিল এটা ঠিক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরুতে এটা নিয়ে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। কিন্তু যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হামলার শিকার হলেন, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেটা নিয়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এটাকে একধরনের সলিডারিটি বা ‘সংঘবোধ’ বলা যেতে পারে। এটা থেকেই তাঁরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে অনেক সময়ই ভুল ধারণা করা হয়। মনে করা হয়, তাঁরা ‘অরাজনৈতিক সত্তা’। এটা সত্যি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্ররাজনীতি নেই। কিন্তু ছাত্ররা তো দেখছেন, দেশে কী হচ্ছে, কারা কী করছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর আগে ‘নো ভ্যাট’ আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এসব আন্দোলনের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা অন্যদের মতো তাঁদেরও আলোড়িত করেছে। আমি মনে করি, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার পার্থক্য অনকে আগেই ঘুচে গেছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী নয়—এ রকম একটা ধারণা প্রচলিত আছে। তাহলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাদের যুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন।
সিউতি সবুর: কোনো তথ্য-উপাত্ত বা পরিসংখ্যান না থাকলেও সাধারণভাবে বলা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কম যান। তাঁদের অনেকেই হয়তো বেসরকারি চাকরি বা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়াকে অগ্রাধিকার দেন। এঁদের মধ্যে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানই বেশি। তা ছাড়া কিছু নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানও এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।
অর্থনৈতিক অবস্থা যেমনই হোক, যে ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক, শিক্ষার্থীদের প্রথম পরিচয় হলো তাঁরা শিক্ষার্থী। তাঁরা এই প্রজন্মেরই মানুষ। তাঁদের কিছু সাধারণ বোঝাপড়া আছে, কিছু সাধারণ অনুভূতি আছে। এ কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বার্থের সম্পর্ক কিছুটা কম থাকলেও এই আন্দোলন তাঁদের প্রভাবিত করেছে।
আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, আন্দোলনের উত্তাপ সেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েও টের পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর পুলিশকে লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল ছুড়তে দেখা গেছে। সেদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু বলেন।
সিউতি সবুর: ১৮ জুলাই যেদিন এসব ঘটনা ঘটেছে, সেদিন মিডটার্ম পরীক্ষার বিরতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। কিন্তু এরপরও সেদিন অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও হতাহতের প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হন। তাঁদের রক্ষার আকুতি জানিয়ে অনবরত মেসেজ (বার্তা) আসতে থাকে। সে রকম অবস্থায় আমরা কয়েকজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেখানে গিয়ে দেখি অগণিত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, কেউ কেউ টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এ রকম অবস্থায় আমাদের অগ্রাধিকার ছিল শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া। যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া বা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, তাঁদের সেখান থেকে চলে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল এবং তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। সেদিন কীভাবে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল, সেটা তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। তবে প্রচুর শিক্ষার্থী আহত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একটা হতবিহ্বল অবস্থা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষকেরাও এ রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। সব মিলিয়ে এ রকম আক্রমণ-প্রতি–আক্রমণ খুবই অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য ঘটনা।
আন্দোলনে সহিংসতা, নাশকতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগে মামলা হয়েছে। গত কয়েক দিনে বেশ কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন। এগুলোর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
সিউতি সবুর: শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনটা শুরুতে শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। এরপরও তাঁরা হামলার শিকার হন। পরে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের নিহত হওয়ার ভিডিও দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর বিক্ষোভ যখন তীব্র হয়, তখন ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। কারা এসব ঘটিয়েছে, সেটা বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কিন্তু এখন যেভাবে নির্বিচার শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেটা ন্যক্কারজনক।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ক্ষোভ ও বঞ্চনাবোধ তৈরি হয়েছে সেটা যৌক্তিক। কিন্তু আলোচনার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। ‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলনে নারী কোটা বা জেলা কোটা পুরোপুরি বাদ দেওয়া কাজের কথা নয়। আলোচনায় বসে যৌক্তিক কোটা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
শুধু চাকরিপ্রার্থীরা নন, সমাজের অন্য শ্রেণির মানুষেরাও এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে এ আন্দোলনকে কীভাবে দেখছেন? আমাদের রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজে কি কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে?
সিউতি সবুর: শুধু ছাত্রদের নয়, দেশের অনেক মানুষের মধ্যে একটা বঞ্চনাবোধ তৈরি হয়েছে। তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সর্বত্র একধরনের অনাস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতি, অনিয়ম গভীরভাবে প্রোথিত, মানুষের মধ্যে এমন ধারণা প্রবল। এগুলো রাষ্ট্র পরিচালনা জন্য ইতিবাচক নয়।
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ সাংবিধানিকভাবে গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করবে—এটাই প্রত্যাশিত। সরকার ও জনগণের সম্পর্ক ‘প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক’ নয়—এটা বুঝতে হবে। যে দেশ মানুষের, সরকারকে সেই মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। সব ধরনের দমন-পীড়ন বন্ধ করতে হবে। দেশের ভবিষ্যতের জন্যই এগুলো করতে হবে। এগুলো না হলে বাংলাদেশকে নিয়ে যে সম্ভাবনা ও স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল, সেটা আর পূরণ হবে না।
বারবার নানা অজুহাতে নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হোক—আমরা এটা চাই না। আমরা শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন চাই।