মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, ডলারের দাম—অর্থনীতির সব সূচকই নিম্নমুখী। সামষ্টিক অর্থনীতির হাল কী?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্রটা আমরা যদি দেখি, তাহলে একটা জিনিস পরিষ্কার যে অর্থনীতির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো, যেমন মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, ব্যাংক খাত—প্রতিটি জায়গাতেই গত চার-পাঁচ বছরে সূচকগুলো নিম্নমুখী। প্রবৃদ্ধির মধ্যেও সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও আমরা ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। কিন্তু সেটা এখন নিম্নমুখী।
প্রবৃদ্ধি অর্জনের এখন যে ধারা, তাতে বলা যায়, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পথরেখা থেকে আমরা অনেকটাই বিচ্যুত হয়ে গেছি। অন্যান্য সূচকের ক্ষেত্রে একই চিত্র। এককথায় বলা যায়, আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বা আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অর্থনীতিটাকে যে গতিপথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, বর্তমানে সেই গতিপথ থেকে আমরা অনকেটাই সরে গেছি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই বিচ্যুতি ঘটেছে, কোথাও কম, কোথাও বেশি।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতির খবর দেখছি। অর্থ পাচারের ধারাও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দুর্নীতি, অর্থ পাচার আমাদের অর্থনীতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: সরকারের উচ্চ পদে থাকা সাবেক দু-একজনের দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসছে। কিন্তু এটা দুর্নীতির সামগ্রিক চিত্র নয়। সামগ্রিক সেই চিত্রটা নিঃসন্দেহে আরও ভয়াবহ। আমি বলব, আমাদের এখানে দুর্নীতিটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুঞ্জীভূত হয়েছে। আজকে আমরা অর্থনীতির যে সমস্যাগুলো, যে টানাপোড়েনগুলো দেখছি, তার সঙ্গে দুর্নীতির বড় একটা সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতি এখানে এক দিনে ঘটেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাকাপোক্ত হয়েছে। দুর্নীতি আমাদের স্বপ্নযাত্রাকে গ্রাস করছে।
আবার অর্থ পাচারের যেসব তথ্য, সেটা যে খুব সামগ্রিক ও নির্ভরশীল, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা থেকে যতটা তথ্য পাওয়া যায়, তাতে এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে অর্থ পাচার আমাদের দুর্নীতির একটা বড় অংশ। সমাজের বিত্তশালী ও প্রতিপত্তিশালী যে অংশ, তারাই অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। দুর্নীতি ও অর্থ পাচার আমাদের জন্য বড় সমস্যা, বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থমন্ত্রী বলছেন, অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার বাজেট হবে। বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী হবে বলে আপনি মনে করছেন?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: আমরা বাজেটটাকে যদি তার লক্ষ্য অর্জনের দিকে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাটা অবশ্যই একটা পূর্বশর্ত। আমরা যদি বাজেটে বিনিয়োগ বাড়াতে চাই, আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং কৃষি, শিল্পসহ অন্যান্য খাতকে যদি গতিশীল করতে চাই, সে ক্ষেত্রেও আমাদের পূর্বশর্ত সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবারের বাজেটের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। মূল্যস্ফীতিটা বাড়তে বাড়তে এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে সেটা আমাদের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি একটা উঁচু অবস্থায় মোটামুটি স্থিতিশীল হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে এককভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। রাজস্ব নীতি এবং অন্যান্য যে সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিগুলো রয়েছে, সেগুলোও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সহায়ক হতে হবে। বাজেটটাকে মুদ্রানীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে হবে।
নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। গত তিন–চার বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারাটা নিচে নেমে গেছে। এবারের বাজেটের বড় একটা চ্যালেঞ্জটা হলো সেই নিচে নেমে যাওয়া প্রবৃদ্ধিটাকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনা। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে মাথাপিছু আয় একটা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছাতে হবে। সে কারণে এবারের বাজেটের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কত দ্রুততার সঙ্গে প্রবৃদ্ধির ধারাটাকে কাঙ্ক্ষিত পথরেখায় ফিরিয়ে আনা।
বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আয়, শিক্ষার মান সব ক্ষেত্রেই অচলায়তন। প্রবৃদ্ধির ধারাটাকে কাঙ্ক্ষিত পথরেখায় কীভাবে আনা যাবে?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: প্রবৃদ্ধি বাড়াতে গেলে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু বিনিয়োগ, বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা গত কয়েক বছরে একটা স্থবিরতা দেখতে পাচ্ছি। প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা হচ্ছে বেসরকারি খাত। বেসরকারি খাতকে যেকোনো মূল্যে আমাদের গতিশীল করতে হবে।
আমরা যে দ্রুতগতিতে সামনে এগোতে চাই, তাতে বিনিয়োগ একটা বড় চালিকা শক্তি। কিন্তু উৎপাদনশীলতা না বাড়িয়ে, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার না বাড়িয়ে শুধু বিনিয়োগ দিয়েই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতাকে আমাদের মূল চালিকা শক্তি করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে আমাদের দক্ষ শ্রমিক তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষার মানটা নিম্নমুখী। শিক্ষার মান না বাড়ালে আমরা দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে পারব না।
শুধু শিক্ষা নয়, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, শিল্প—সবখানেই গুণগত মানের একটা বড় ঘাটতি রয়েছে। এই গুণগত মানটা অর্জন করতে না পারলে আমরা উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারব না। বাজেটে এই সমস্যাগুলোকে বাস্তবভাবে দেখতে হবে।
বাজেটে আমাদের একটা বড় সমস্যা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয়। আমাদের এখানে কর জিডিপির অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। আমাদের বাজেটের আকার এখন জিডিপির ১৬-১৭ শতাংশ। বাজেটে এখনো শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২ শতাংশের নিচে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ১ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ৪-৫ শতাংশ ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ২-৩ শতাংশ হওয়ার কথা। বাজেটে বরাদ্দ না বাড়ালে তো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুণগত মান বাড়বে না।
আমাদের মতো দেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের সরকারি ব্যয় অত্যন্ত কম। বেসরকারি খাত উন্নয়নটা করবে, কিন্তু সরকারি খাত উন্নয়নের সহযোগী ভূমিকা পালন করবে। আমাদের যে রাজস্ব আয় তার মূল অংশগুলো ব্যয় হচ্ছে ঋণ পরিশোধ, প্রশাসনিক ব্যয় কিংবা ভর্তুকি পরিশোধে। এ সবকিছুর পর উন্নয়ন খাতের জন্য আর কতটুকুই বরাদ্দ থাকে? এ পরিস্থিতিতে সরকার চেষ্টা করে বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে বাজেটটাকে একটু বড় করতে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণের পরিসীমা আছে। ফলে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নিতে হয়। কিন্তু তার তো নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বড় আকারে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতির ওপর বড় একটা প্রতিক্রিয়া হয় আর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাত ঋণ বঞ্চিত হয়।
সর্বোপরি আমাদের রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। এই বাজেটে কি আমরা জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আয় বাড়াতে সক্ষম হব, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। গত কয়েক বছরের অচলায়তন ভেঙে ভবিষ্যতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের একটা মাধ্যম হিসেবে বর্তমান বাজেটটাকে আমরা যদি ব্যবহার করতে চাই, তাহলে কিন্তু বেশ কিছু শক্ত সিদ্ধান্ত থাকতে হবে। সেখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও থাকতে হবে।
বাজেট নিয়ে আপনার মূল পরামর্শ কী?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: প্রথমত, বেসরকারি খাতকে তার ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে যে নীতি সহায়তা দরকার, সেটা দিতে হবে। কিন্তু সেটা হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। বেসরকারি খাতকে অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া যাবে না। অনেক সময় বাজেটে কোনো কোনো বেসরকারি খাতের জন্য যে সুবিধাগুলো দেওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রে তার অপব্যবহার হয়। ফলে বেসরকারি খাত বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতাশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারছে না। আমাদের নীতিগুলো বরং বেসরকারি খাতকে দুর্বল করে গড়ে তুলছে। গতিশীল, কার্যকর ও উৎপাদনশীল বেসরকারি খাত গড়ে তোলার নীতি নেওয়া প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, সরকারি খাতকে আরও গতিশীল করতে হবে। বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপিতে আমরা অসংখ্য প্রকল্প নিচ্ছি। আমরা মনে করছি, আমরা যত বেশি প্রকল্প নিতে পারব, যত বেশি এডিপির আকার বড় হবে, তত বেশি উন্নয়ন হবে। কিন্তু এটা মোটেই সত্য নয়। এডিপিতে আমরা শুধু বেশি বেশি প্রকল্পই নিচ্ছি না, প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বেশি লাগাচ্ছি। এমন একটা প্রকল্প খুঁজে বের করা কঠিন, যেটা সঠিক সময়ে, সঠিক অর্থ ব্যয়ে, সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে।
আমাদের অর্থের প্রাপ্যতার যেখানে অভাব রয়েছে, সেখানে সেটা ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রথম মানদণ্ড হওয়া দরকার গুণগত মান বজায় রেখে সেটি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বা সরকারের উন্নয়নশীল ভূমিকাকে আরও বেশি স্ট্র্যাটেজিক করতে হবে। বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
তৃতীয়ত, টানা মূল্যস্ফীতির এবং অর্থনৈতিক নানা টানাপোড়েনের কারণে আমাদের গ্রামীণ ও শহুরে এলাকার দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষদের রেজিলিয়েন্স এমনভাবে কমে গেছে যে তাঁরা খুবই অসহায় অবস্থায় রয়েছে। তাঁদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা বেড়ে গেছে। রোগবালাই বেশি হচ্ছে। দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা যাতে বাড়ানো যায়, এবারের বাজেটে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধিটা বাড়াতে হবে।
বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাটসহ সাধারণ করদাতাদের ওপর করের বোঝা চাপানো হতে পারে। রাজস্ব খাত সংস্কার না করে সাধারণ করদাতাদের ওপর এই বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার নীতিটাকে কীভাবে দেখেন?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের করব্যবস্থা রিগ্রেসিভ, প্রগ্রেসিভ নয়। প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থায় যাদের সক্ষমতা বেশি তারা বেশি কর দেবে, আর যাদের সক্ষমতা কম তারা কম কর দেবে। আমাদের করব্যবস্থাটা ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করের ওপর বেশি নির্ভরশীল। পরোক্ষ করটা বেশি আসে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে। আর প্রত্যক্ষ করটা আসে আয়কর কিংবা সম্পদ থেকে আসা কর থেকে।
আমি মনে করি, রাজস্ব আয় বাড়াতে তিনটি পথ নিতে হবে। এক. আয়কর, সম্পদ কর—এ রকম প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ বাড়াতে হবে। দুই. কর ফাঁকি দেওয়ার যে ব্যবস্থা, সেটা বন্ধ করতে হবে। তিন. বিভিন্ন খাতে ট্যাক্স হলিডের সুযোগ যেভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রূপ পেয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো একটা শিল্প বা খাতকে এগিয়ে নিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ট্যাক্স হলিডে সুবিধা দেওয়া হয়।
কিন্তু আমাদের দেশে কোনো শিল্প বা খাতকে একেকবার সুবিধা দিলে সেটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে যায়। এতে যেমন সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়, আবার নতুন কোনো খাত বিকশিত করার জন্য ট্যাক্স হলিডে সুবিধা দেওয়া দরকার, তারাও বঞ্চিত হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যে দুর্বলতা কিংবা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থের কারণে আমাদের নীতিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এবারের বাজেটেও ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই নীতি থেকে সরকারের অর্জনটা কী হচ্ছে?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: কালোটাকা সাদা করার নীতি আমাদের দেশে বহু বছর ধরে চলে আসছে। এ নীতি থেকে সরকার কতটা সুবিধা অর্জন করতে পেরেছে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। কিন্তু এই সুযোগ কালোটাকা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। মানুষ এই বার্তা পেয়ে যাচ্ছে, কালোটাকা থাকলে তো কোনো সমস্যা নেই, যেকোনো সময় গিয়ে সেটা সাদা করে নিতে পারবে। সামগ্রিকভাবে সরকার রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের এই নীতির কারণে আমরা হয়তো এখন একটা কালোটাকার রাজত্বেই বাস করছি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে। অন্যদিকে আমরা দেখছি, আইএমএফের শর্তের কথা বলে বিদ্যুৎ-জ্বালানি থেকে ভতুর্কি তুলে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। অথচ বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা বইতে হচ্ছে। ব্যাখ্যা কী?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: নীতিগতভাবে বিদ্যুৎ খাত স্থায়ীভাবে ভর্তুকির ওপর চলতে পারে না। ভর্তুকিটা স্বল্প সময়ের জন্য হতে পারে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকিটা কেন দিতে হচ্ছে? বিদ্যুৎ খাত থেকে যে আয় হচ্ছে, তার তুলনায় ব্যয়টা বেশি। এখানে আয়-ব্যয় সমান করার উপায় কী? আয় বাড়ানো ও ব্যয় কমানো। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক সময় অপচয় হচ্ছে, চুরি হচ্ছে আবার সঠিকভাবে রাজস্ব আয় হচ্ছে না। আমাদের বিদ্যুৎ খাতটা অতি ব্যয়বহুল একটা খাত হিসেবে গড়ে উঠেছে। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে এ খাতকে আমরা অপরিকল্পিতভাবে বাড়িয়ে তুলেছি। এ খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পেছনে ক্যাপাসিটি চার্জের একটা বড় দায় রয়েছে।
বিদ্যুৎ ছিল না, তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছিলাম। তাই বলে ক্যাপাসিটি চার্জ কি আমরা অনন্তকাল ধরে দিতে থাকব। বিদ্যুৎ খাতেও ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভতুর্কিটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হয়েছে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে আমরা এ খাতে অদক্ষতাকে ভালোভাবে প্রতিপালন করছি ও সুরক্ষা দিচ্ছি, অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধি করছি, এটা কোনো নীতি হতে পারে না।
বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ থাকবে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ। অন্যদিকে দুই বছর ধরে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ নিম্নমুখী। এই চাপ আমাদের অর্থনীতি কতটা সামলে নিতে পারবে?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: বৈদেশিক ঋণ হোক আর দেশি ঋণ হোক, ঋণ আমাদের পরিশোধ করতেই হবে। সময়মতো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সেটা আমাদের রেটিংয়ে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আগামী দিনগুলোতে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ আরও বাড়বে। কিন্তু আশঙ্কার ব্যাপার হলো, বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহটা নিম্নমুখী।
বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আমরা যে নীতিমালা করেছি, সেগুলো কিন্তু বিশ্বের অন্য যে দেশগুলো ভালো বিনিয়োগ আনতে পারছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই নীতিগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয়ও। তারপরও আমরা বিনিয়োগ আনতে পারছি না? কারণ হলো, কাগজে-কলমে সুবিধা দিলেও বাস্তবে সেটা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। প্রকল্প হোক, নীতি হোক—সব ক্ষেত্রেই আমাদের মূল ঘাটতিটা রয়ে গেছে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। বাজেটের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এর বাস্তবায়ন।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মুস্তফা কামাল মুজেরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।