তাঁরা সরকারকে হুমকি দেওয়ার সাহস কোথা থেকে পান

শারমীন মুরশিদ: তৃণমূলে নারী ও শিশু, গ্রামীণ উন্নয়ন ও মানবাধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। এ ক্ষেত্রে সমস্যা ও এর কারণ আমার পরিচিত। তাই দুই মন্ত্রণালয়ের কাজে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারছি।

শারমীন মুরশিদ: আমারও কথা, ‘জুলাই-কন্যারা’ কেন হারিয়ে যাচ্ছেন! ‘সমুদ্রে প্রথম ঢিল’ (আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা) তাঁরাই ছুড়েছিলেন। মিছিলের সামনে ছিলেন। তাঁরাই প্রথম হামলার শিকার হন। পরে কোনো কমিটিতে তাঁদের আর দেখা গেল না। এটা মনে করিয়ে দেয় একাত্তরের বীর কন্যাদের অসম্মানের কথা। যুগে যুগে মেয়েদের বীরত্বের গল্প না-বলা থেকে যায়। সেটা আর হতে দেওয়া যাবে না। প্রতিটি জুলাই-কন্যাকে খুঁজে বের করে তাঁদের পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ করব আমরা। এসব কন্যার প্রয়োজনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নতুন একটি বিভাগ খোলা হচ্ছে।

শারমীন মুরশিদ: আমাদের রেকর্ড অনুযায়ী, গণ-অভ্যুত্থানে ১৩২ শিশু-কিশোর ও ১১ নারীর মৃত্যু হয়েছে। আহত অসংখ্য। ২০২৪-এর মতো সংগ্রাম বোধ হয় পৃথিবী আগে কখনো দেখেনি। শত শত শিশু নির্দ্বিধায়-নির্ভয়ে যুদ্ধে নেমেছে। এ যেন তাদের একান্ত যুদ্ধ। ভাবতে বুক ফেটে যায়, আমরা কী এমন সমাজ গড়লাম, যেখানে শিশুরা মনে করে তাদের প্রাণ দিয়ে এটাকে পাল্টাতে হবে? ‘কোটা নয়, মেধা’—এটা একটি গভীর উপলব্ধি। একটি ন্যায্য, সুন্দর, কল্যাণ রাষ্ট্র ‘মেধাভিত্তিক’ হওয়া উচিত।

বিগত সরকার একাত্তরের মিথ্যা তালিকা তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধকে কলুষিত করেছে।

শিশু-কিশোরেরা একের পর এক অন্যায় হতে দেখেছে। বিগত সরকার তরুণদের মেধা আন্দোলনের দাবিকে স্নেহের দৃষ্টিতে না দেখে গুলির বৃষ্টিতে তাদের বুক ঝাঁঝরা করে চরম বুদ্ধিহীন কাজ করেছিল। সেই মুহূর্তে শেখ হাসিনার সরকার ও শেখ রাজত্বের পরাজয় ঘটল। নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো।

শারমীন মুরশিদ: কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে আমরা পড়েছি, যার একটি হচ্ছে শূন্য কোষাগার। কৌশলে ব্যয় পরিকল্পনা, অপচয় রোধ ও অপরিকল্পিত ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলো দ্রুত বন্ধ করে নতুন পরিকল্পনা ও বাজেট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজগুলোকে নিয়ে আসতে হচ্ছে। প্রশাসনে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, যত্রতত্র নিয়োগ-বিয়োগ ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এগুলো কাজকে দ্রুত এগোতে দেয় না। হয়তো অনেকে চায় না, আমরা এগোই। নতুন পরিচ্ছন্ন ধারা তৈরি সহজ নয়। তবে নিশ্চয়ই তা সম্ভব। হতবাক হয়েছি, আমার দুই মন্ত্রণালয়ে কোথাও কোনো নজরদারির ব্যবস্থা নেই। মূল্যায়ন হয় না কোনো কিছুই।

কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ধর্মঘট করে সংবাদ সম্মেলন করেন। বিশ্বের কোথাও এমনটা দেখা যায় না। মানুষের জানা উচিত, আমাদের চ্যালেঞ্জ কোথায়। আমরা কিসের মধ্যে আছি! তাঁরা অফিস প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করার মতো উদ্ধত আচরণ করেন কীভাবে? তাঁরা সরকারকে হুমকি দেওয়ার সাহস কোথা থেকে পান? এই সরকার যেন তাঁদের ১৫ বছরের দাবি পূরণ করতে এসেছে। এটাই যেন আমাদের একমাত্র কাজ—তাঁদের স্বার্থ পূরণ করা। একবারও দেখলাম না, তাঁরা মহা আন্দোলনের পক্ষে, তরুণসমাজের পক্ষে কোনো সৃজনশীল দাবি অথবা প্রকল্প আমার কাছে দাখিল করেছেন। শুধুই তাঁদের স্বার্থসিদ্ধিটুকুই দেখলাম। জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করা।

তরুণ যোদ্ধাদের সুস্থ করা, মূলধারায় আনা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এখন আমার মন্ত্রণালয়ের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

শারমীন মুরশিদ: ‘মহিলা’ বললে শুধু একটি শ্রেণি বোঝায়। নারী সর্বজনীন। এই পরিবর্তনটা দরকার ছিল। প্রথমত কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে মন্ত্রণালয়ের কাঠামো পরিবর্তন ও সংস্কার জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসছে। এটি স্বচ্ছতা, সুশাসন ও নতুন বন্দোবস্ত নিশ্চিত করবে।

শারমীন মুরশিদ: অভিন্ন পারিবারিক আইন আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। হুট করে বিষয়টি পরিবর্তন করতে পারব না। তবে পরিবর্তনের লক্ষ্যে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ধর্মের সংকীর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে পুরুষদের অন্যায় অবস্থান রাষ্ট্র–সমর্থিত। এটা মেয়েদের পেছনে ঠেলে দিয়েছে। দুঃখজনক, এই পিতার রাজ্যে নারী-পুরুষের সমতা একটি ক্ষমতার লড়াই। যে লড়াইয়ে পিতা সাম্যের চোখে তাঁর কন্যাদের দেখতে পান না। ধর্মকে টেনে বিকৃত করেন ও অসাম্য জিইয়ে রাখেন। এ বিষয়ে দেশ-বিদেশ থেকে পণ্ডিতদের আলোচনার আহ্বান করব। হোক মুক্ত আলোচনা।

শারমীন মুরশিদ: নারী ও শিশু নির্যাতন নিয়ে আমি অসম্ভব উদ্বিগ্ন। একটি দেশে অস্থিরতা থাকলে, অরাজকতা থাকলে, সহিংসতা বাড়লে নারী ও শিশু হয় প্রথম টার্গেট (লক্ষ্যবস্তু)। এই চিত্র বহুদিন ধরে বাড়ছে। গত ১৫ বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন বহু গুণে বেড়েছে। এ কথা মনে করিয়ে দিই, পুলিশও যথেষ্ট সক্রিয় হচ্ছে না। এ সুযোগে নারী ও শিশু নির্যাতনকারী দুষ্টচক্র সহিংস ঘটনা ঘটাচ্ছে। দ্রুত নতুন বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে এটা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমার দুই মন্ত্রণালয়–ই সেদিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে।

শারমীন মুরশিদ: আমার দুই মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিপ্লবী তরুণসমাজ এবং গ্রাম সংগঠনগুলোকে নিয়ে নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হচ্ছে। যেখানেই নির্যাতন হোক, সব শক্তি নিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এসব মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। এর জন্য নতুন কাঠামো তৈরি হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত—প্রতি ধাপে কুইক রেসপন্স টিম (দ্রুত সাড়াদানকারী দল) থাকবে।

শারমীন মুরশিদ: দেশে বাল্যবিবাহের পরিস্থিতি খুব খারাপ। নিজের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বাল্যবিবাহ বড় আকারে কমিয়ে আনা সম্ভব। ‘ব্রতী’ কাজ করার সময় বেশ কয়েকটা গ্রামকে বাল্যবিবাহমুক্ত করেছিল। এ ক্ষেত্রে সূত্র হলো—যে গ্রাম বাল্যবিবাহমুক্ত হবে, সেটিকে সব সময় নজরদারির মধ্যে রাখা। এই নজরদারি তৈরি করাটাই হচ্ছে সামাজিক শাসনব্যবস্থা।

শারমীন মুরশিদ: এ মুহূর্তে ভাতাভোগীর সংখ্যাবৃদ্ধি বা ভাতাবৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা নেই। কোনো ভাতা বন্ধও হবে না। কেবল ত্রুটি দূর করতে ভাতা দেওয়ার কার্যক্রমে নজরদারি আরও বাড়ানো হচ্ছে।

শারমীন মুরশিদ: ভাতা পাওয়ার যোগ্য নয়, আবার ভুল জায়গায়ও ভাতা যাচ্ছে। একাধিক কৌশলে ভাতার টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সমস্যার কারণ উন্মোচন করে তা শোধরানোর চেষ্টা করছি। ভাতা বিতরণের ৭৫ শতাংশ কাজ ছিল মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ লিমিটেড’–এর। ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ভাতার বড় অঙ্কের টাকা জালিয়াতি করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নগদ পরিচালনায় প্রশাসক ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নগদের মাধ্যমে ভাতার টাকা দেওয়া বন্ধ করেছি। আমার ইচ্ছা, ভাতানির্ভর জনগোষ্ঠী তৈরি না করে ভবিষ্যতে আত্মনির্ভর জনগোষ্ঠী তৈরি করা। এটাই হওয়া উচিত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কৃপা ও দাক্ষিণ্যনির্ভর কর্মসূচি আত্মমর্যাদা দেয় না। এ জায়গাটায় নতুন করে ভাবতে হবে।

শারমীন মুরশিদ: ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়নি। তবে অপ্রয়োজনীয় কাজ থামিয়ে দেওয়া হবে। নির্মাণকাজে দুর্নীতি হয়েছে। দুই-তিন গুণ বেশি ব্যয়ে ভবন বানানো হয়েছে। সেই ভবন কোনো উপকারে আসবে কি না, তা দেখা হয়নি। এসব ভবন কর্মস্থল হয়ে ওঠেনি। কারণ, কোনো মানবসম্পদ তৈরি করা হয়নি। সব রকমের অপচয় বন্ধ করা প্রয়োজন। দুর্নীতি এ দেশে দেশদ্রোহের শামিল বিবেচিত হওয়া উচিত।

শারমীন মুরশিদ: আমরা সব প্রকল্প রাখতে চাই না। কিছু প্রকল্প আবার নকশা করতে হচ্ছে। পুরোনো রাজনৈতিক প্রকল্প রাখা যাবে না। ভালো কাজ খারাপভাবে করলে তা আর ভালো থাকে না। শত শত কোটি টাকার প্রকল্প কোনো মূল্যায়ন ছাড়া চলছে। অপচয় বন্ধে মূল্যায়ন হচ্ছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ভেতর আনার প্রয়োজনে যেটুকু রাখা যায়, সেটুকু রাখা হবে।

শারমীন মুরশিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।