বিশেষ সাক্ষাৎকার: ফরহাদ মজহার

আমাদের চেতনার মূল বীজ রোপিত হয়ে গেছে

ফরহাদ মজহার। কবি, ভাবুক এবং পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী। বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে কয়েক দশক ধরে চর্চা করছেন। তিনি রাজনীতি ও দর্শনবিষয়ক সাময়িকী ‘চিন্তা’ এবং সাহিত্যবিষয়ক সাময়িকী ‘প্রতিপক্ষ’-এর সম্পাদক। চিন্তা ও ভাববৈঠকী নামে দুটি পাঠচক্রের সঙ্গেও যুক্ত। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং সংস্কৃতি ও ধর্ম প্রসঙ্গে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজ্জাদ শরিফ ও রাফসান গালিব

প্রথম আলো:

কোনো রাজনৈতিক দল যেটা পারল না, ছাত্ররা সেখানে কীভাবে সারা দেশের মানুষকে এক করল এবং শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করে ছাড়ল? আমাদের পরিচিত রাজনৈতিক শক্তির বাইরে থেকে এসে কীভাবে এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব হলো?

ফরহাদ মজহার: শেখ হাসিনা কিন্তু স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী ছিলেন না, যেটা অনেকে বলেন। আমাদের সমাজে ফ্যাসিবাদী প্রবণতাটা সব সময় ছিল, তার মধ্যেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বা অন্যান্য সংগঠন ফ্যাসিস্ট শক্তি আকারে পরিগঠিত হয়েছে। তারপর তারা সংবিধান সংশোধন করল। বলল, এর বিরুদ্ধে বললে রাষ্ট্রদ্রোহ হবে। তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইন করল। এসব কিছু মিলিয়েই একটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন। মানুষ ব্যাপারটা অনুভব করত, তবে তরুণেরা আরও তাড়াতাড়ি বুঝেছে। বিষয়টা কি বিএনপি বুঝত না? বুঝত। কিন্তু বিএনপি তো লুটেরা–মাফিয়া শ্রেণির রাজনীতির আরেকটি ধারা মাত্র। কথাটা নিন্দার্থে বলছি না।

অবাধ বাজারব্যবস্থার নয়া–উদারতাবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো লুটেরা–মাফিয়া শ্রেণির দল হিসেবেই গড়ে ওঠে। তারপরও যে খালেদা জিয়া নির্বাচনে গেলেন না, তিনি যথার্থ ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া মানে তাকে বৈধতা দেওয়া। তাঁর এই অবস্থানও কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথটা তৈরি করে দিয়েছিল। জনগণ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা কথা বলতে পারছিল না, মানুষকে গুম করে আয়নাঘরে ঢোকানো হচ্ছিল, র‍্যাব দিয়ে মানুষ খুন করা হচ্ছিল—এসব কারণে বাংলাদেশ একটি গণ–অভ্যুত্থানের জন্য তৈরি হয়ে ছিল। ছাত্ররা যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করল, আদৌ সেটা বড় আন্দোলন হিসেবে দানা বাঁধবে কি না, তা নিয়ে আমি সংশয়ে ছিলাম।

যখন তারা সে আন্দোলনকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পরিণত করল, তখন তাদের বলেছিলাম, এবার তোমরা ‘বিশেষ’ (পার্টিকুলার) থেকে ‘সামান্যে’ (ইউনিভার্সাল) এলে। সুনির্দিষ্ট একটি দাবির আন্দোলন তখন জাতীয় আন্দোলনের রূপ পেল। বলতে না বলতেই আন্দোলনটি গণ–অভ্যুত্থানের রূপ নিল। এর মধ্যে অনেকের অবদান আছে। বাম, ডান, বিএনপি, ইসলামি শক্তি—সবাই এ আন্দোলনে ছিল। শেষে সেটা এক দফার দাবিতে গিয়ে পৌঁছায়, মানে শেখ হাসিনার পতন চাই। আমি তখন বলেছি, আমরা কিন্তু শুধু একটি সরকার পতনের রাজনীতিতে আর নেই। আমাদের অবশ্যই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা বিলোপের কথা বলতে হবে। নাহিদ ইসলাম তখন এক দফা দাবি ঘোষণার সময় ফ্যাসিবাদ বিলুপ্তির কথাটা বললেন। দাবিটা তখন আমাদের সামনে স্বপ্নের আকারে হাজির হলো।

প্রথম আলো:

ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রবণতাই হলো সংবিধান ও আইনকে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছার অধীন করা। গণ–অভ্যুত্থানের সময় নাগরিকেরা সেই আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যায়। তারা নিজেরাই তখন আইন…

ফরহাদ মজহার: অবশ্যই। এটাই গণ–অভ্যুত্থানের সহজ ও আইনি রাজনৈতিক মর্মবাণী। এ জন্য দার্শনিকেরা বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ নিজেকে বর্তমান করে। কোনো সংবিধান জনগণকে দাবিয়ে রাখলে সেই সংবিধানকে উৎখাত করে জনগণ নিজেই হাজির হয়ে যায়। এই দশাকে দার্শনিকেরা বলেন পপুলার সভরেন্টি (গণসার্বভৌমত্ব)। এরই মানে গণতন্ত্র।

প্রথম আলো:

এই নতুন বাস্তবতার মধ্যে নাগরিকদের কর্তব্য তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে?

ফরহাদ মজহার: বাংলাদেশকে নতুন করে গঠন করতে হবে, এটাই জনগণের রণধ্বনি। এর প্রতি সবাইকে মনোযোগী হতে হবে। এটাই আগামী দিনে আমাদের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু ঘটনাটা কী ঘটল? গণ–অভ্যুত্থান হওয়ার পর এটিকে ঢুকিয়ে ফেলা হলো পুরোনো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের অধীনে। একটি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকারের মানে হলো, তাকে ঘোষণা দিতে হবে যে আমরা ক্ষমতা গ্রহণ করলাম, যারা পুরোনো কোনো ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীন নয়। গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের যে অলিখিত অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে, সেটিকে লিখিত রূপ দেওয়াই আমাদের একমাত্র ঐতিহাসিক দায়। এ সময়ে তারা বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। শুধু আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ আইনগুলো বাতিল হয়ে যাবে। যতক্ষণ না আমরা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করি, ততক্ষণ এটা চলবে।

আন্তর্জাতিকভাবে, অর্থাৎ বিশ্বসভায় স্বীকৃত নাগরিক ও মানবাধিকার–সম্পন্ন একটি গঠনতন্ত্র আমাদের তৈরি করতে হবে। তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে উত্তর–ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা। সারা পৃথিবীর অবাধ বাজারব্যবস্থায় অল্প কিছু বহুজাতিক কোম্পানির বিস্তার করে রাখা আধিপত্যের বাইরে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে গঠন করার দিকে এগোতে হবে। আমাদের এখন কয়েকটি কাজ। জনগণের ক্ষমতাকে সংহত করা। সেটিকে রূপ দিতে পারে তেমন একটি সরকার গঠন। আমাদের সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক ও ধর্মীয় বিতর্কগুলো মীমাংসা করা।

গণ–অভিপ্রায়কে বাস্তবায়ন করতে দুটি মন্ত্রণালয়ের কাজ এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। নতুন বাংলাদেশ গঠন চাইলে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে হবে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দুটি ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে, শিক্ষা এবং সাহিত্য–সংস্কৃতি। এখানেই আগামী দিনের রাষ্ট্র গঠনের কেন্দ্র।

ফরহাদ মজহার
প্রথম আলো:

গণ–অভ্যুত্থানের সাড়ে তিন মাস পার হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নানা ঘটনা ঘটে গেল। এই ঘটনাক্রমকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ফরহাদ মজহার: সহজভাবে আমি দেখি, গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে মানে জনগণ তার অভিপ্রায় প্রকাশ করার অধিকার লাভ করেছে। এটাই দারুণ ইতিবাচক। মানুষকে তো কথা বলতে দিতে হবে। গণ–অভ্যুত্থানকে যারা নেতৃত্ব দেবে, তাদের এখন মানুষের সব দাবিদাওয়া থেকে সামান্য দাবিদাওয়াগুলো বের করে আনতে হবে। ধরুন, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আট দফা দাবি দিয়েছে। পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেই তাদের সব দাবি পূরণ হয়ে যায়। আলাদা করে আর কিছু করতে হয় না। এটা তো জরুরি। কারণ, প্রতিটি মন্দির বাংলাদেশেরই মন্দির। সেগুলো একই সঙ্গে আমাদের প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং পর্যটনশিল্পের জন্য জরুরি, অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও কেন্দ্র। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের অন্তর্গত করে একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে তাদের গঠন করতে পারলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে?

বাংলাদেশ পুরো উপমহাদেশে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র আকারে হাজির হবে, যেখানে কোনো ধর্মীয় মৌলবাদ নেই। যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক রয়েছে পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা আধুনিক জাতিবাদের। উগ্র আধুনিক জাতিবাদের ধর্মীয় রূপ মোকাবিলা করে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কী হতে পারে, তার একটা রূপ আমরা দেখিয়ে দিতে পারি। শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বী নয়, বৌদ্ধ ইতিহাসও তো আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। একইভাবে ইসলামও। ধর্মবাদ ও জাতিবাদ পরিত্যাগ করে ধর্মের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত অবদানকে যখন আমরা বৃহত্তর রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে আত্মস্থ করব, তখন উপমহাদেশের পুরো পরিবর্তনের নেতৃত্ব বাংলাদেশের হাতে চলে আসবে। উগ্র ধর্মবাদকে আমরা ঠেকিয়ে দিতে পারব।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশে তো কোনো সরকারই রাষ্ট্র নিয়ে জনগণের সঙ্গে চুক্তির তোয়াক্কা করেনি। রাষ্ট্রকে তারা দখল ও পদানত করেছে। আপনি ভালো একটা গঠনতন্ত্র বা সংবিধান করলেন। ভবিষ্যৎ সরকারগুলো যে সেটা লঙ্ঘন করবে না, সেই গ্যারান্টি আমরা কোথায় পাব?

ফরহাদ মজহার: আমি যাকে গঠনতন্ত্র বলি, সেটা কিন্তু ওপর থেকে চাপিয়ে দিলে হবে না। আমি যে সংবিধান চিন্তা করছি, সেটা মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার। সংক্ষিপ্ত, সহজ, জনগণের বোধগম্য কিন্তু পরিসর ব্যাপক। এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না, যা নির্বিশেষে কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার হরণ করে কিংবা প্রাণ–প্রকৃতি–পরিবেশ ধ্বংস করে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিভাজনটা কীভাবে হবে, প্রেসিডেন্ট না প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতির সরকার চাই, আইনসভা দুই কক্ষ না এক কক্ষের হবে, এক কক্ষের হলে কি সেখানে বিকেন্দ্রীকৃত জেলাগুলোও থাকবে, যাদের অনুমতি ছাড়া কোনো অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা যাবে না, স্থানীয় সরকারের চরিত্র কেমন হবে, সেটিকে বিকেন্দ্রিত করলে বিভাগগুলোকে কী বলব—সংবিধান এভাবেই করতে হবে। যাদের নদী, হাওর, জলমহাল বেদখল হয়ে গেছে, আপনাকে গ্রামে–গ্রামে ইউনিয়নে–ইউনিয়নে কাউন্সিল করে সেসব মানুষের কথা শুনতে হবে।

এসব সম্পদ জনগণের অধীনে রেখে তার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা লাগবে। অথচ সরকার তো আবারও ওপর থেকেই সংবিধান চাপিয়ে দিচ্ছে। আলী রীয়াজের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, তিনি তো অন্তত সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলেছেন। বদিউল আলম মজুমদারেরও হয়তো কিছু ভালো আইডিয়া আছে। কিন্তু সব তো ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতির একটা শ্বেতপত্র তৈরি করা হয়েছে। খুব ভালো একটা কাজ। কিন্তু পড়লে মনে হয়, এটি করা হয়েছে দুদকের জন্য। তাঁরা এখনো পুরোনো নয়া–ধ্রুপদি অর্থনীতির বাজার ও চাহিদার মধ্যে আছেন। এটাই তো আমার সমস্যা।

রাষ্ট্রের ওপর আন্তর্জাতিক বাজারের বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণের কারণে আমাদের অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারছি না, আমাদের সম্পদ বাড়াতে পারছি না। ট্যাক্স তুলতে পারছি না। আমাদের ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হাজির করতে হবে। এই শ্বেতপত্র খুবই সুন্দর, কিন্তু রাষ্ট্র গঠনে কোনো কাজে আসবে না। অথচ দরকার গণসার্বভৌমত্বের ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে, অবাধ বাজারব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের নীতি ও কৌশলের প্রস্তাব করা।

প্রথম আলো:

প্রশ্নটা অন্যভাবে করি। পুনর্গঠন বা সংস্কারের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রব্যবস্থাই আমরা গড়ে তুলি না কেন, সেটা তো চালাবে রাজনৈতিক দলগুলোই। তাদের স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা আমরা ঠেকাব কী করে? তারা রাষ্ট্রের সংস্কারের কথা বলছে, কিন্তু নিজেদের সংস্কারের কথা তো বলছে না।

ফরহাদ মজহার: রাজনৈতিক দলগুলো গণ–অভ্যুত্থানকেই পূর্ণ স্বীকৃতি দিক না। গণ–অভ্যুত্থানের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ ক্ষমতা দিক না। তাহলেই দেখবেন রাজনৈতিক দলগুলোকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারটা দুর্বল করে রেখেছে। তারা বলছে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া এটা বা ওটা করা যাবে না। আমি তো বলি ড. ইউনূসের সরকার নির্বাচিত। আমাদের ছেলেরা শহীদ হয়ে তাঁকে নির্বাচিত করেছে।

আমরা অবশ্যই এই সরকারের সমালোচনা করব। তিনি সরকার চালাচ্ছেন, গ্রামীণের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। হয়তো সেখানে দুর্বলতা আছে কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যে বলছে, তিনি নির্বাচিত নন—তা শুনতে আমরা রাজি নই। তিনি রক্ত দিয়ে নির্বাচিত। আমরা বরং তাঁকে পূর্ণ ক্ষমতা দিইনি। পূর্ণ ক্ষমতা দিলে তিনি সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে পারতেন। জলমহাল, নদী, খাল উদ্ধার করা যেত। এলাকায় এলাকায় বিএনপির দখলবাজির শায়েস্তা করতে কম সময় লাগত। একটি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করাই এখন প্রধান কাজ। সেটি করতে পারলে বাকি সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে।

আপনি যে রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলছেন, তারা আসলে রাজনৈতিক দল কি না, তা আমরা ঠিক করব নতুন গঠনতন্ত্রের মধ্য দিয়ে। এই যে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে আইন করা হয়েছে, সেই আইনই তো বলে দেয় কে রাজনৈতিক দল আর কে নয়? তাহলে নতুন গঠনতন্ত্রই সাব্যস্ত করবে কারা রাজনৈতিক দল আর কারা নয়। তারপর কথা। তা ছাড়া ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে কি রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত? কিংবা যে দল ১৯৭১ সালে পুরো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তাকে কি এই নামে রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত? ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ, এটি আমার ইতিহাসের অংশ। কিন্তু সেটি কীভাবে থাকবে, তা তো আলাপ-আলোচনার বিষয়। ইসলামি রাষ্ট্র বানালে তো ইসলাম কায়েম হবে না। ইসলাম আমার দৈনন্দিন বাস্তবতা, নৈতিকতা, সংস্কৃতি এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। সেটিকে আমার আত্মস্থ করতে হবে। এ জন্য আমি গঠনতন্ত্র শব্দটা বলি।

ফরহাদ মজহার
প্রথম আলো:

গণ–অভ্যুত্থানের সময়কার বাস্তবতা এখন আর নেই। আপনি যে প্রস্তাবগুলো দিচ্ছেন, সেগুলো এখন কতটা বাস্তবায়নযোগ্য? আপনাকে কি আমি কল্পনাবাদী বলব?

ফরহাদ মজহার: গণ–অভ্যুত্থান ও গঠন: বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ প্রসঙ্গে বইটি কিন্তু আমি ২০২৩ সালে লিখেছিলাম। তখনই গণ–অভ্যুত্থানের ইঙ্গিত দিয়েছি। সব রাজনৈতিক দলকে বোঝানোর জন্য মানবাধিকার মঞ্চ তৈরি করে বলেছিলাম, গণ–অভ্যুত্থানই করতে হবে। গণ–অভ্যুত্থান তো হয়ে গেল। এটি করে ফেলার পর তো আমার মধ্যে প্রচুর আত্মবিশ্বাস। বাংলাদেশ হবে পুরো উপমহাদেশকে পুনর্গঠন করার কেন্দ্র। নেতৃত্ব আমাদের তরুণদেরই নিতে হবে। আমি নিশ্চিত, আমি যে কথাগুলো বলছি তা বাস্তবায়িত হবে।

প্রথম আলো:

অন্য একটা প্রসঙ্গে যাই। শেখ হাসিনার সরকার তাদের সব অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির ন্যায্যতা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একটা সংকীর্ণ বয়ান হাজির রেখে। ফলে তাদের পতনের পরে অনেকে আশঙ্কা করছেন, মুক্তিযুদ্ধই প্রশ্নের মধ্যে পড়ে গেল কি না।

ফরহাদ মজহার: দেখুন, ১৯৪৭ সালে আমাদের লড়াইটা কী ছিল? জমিদার আর মহাজন শ্রেণি আমাদের শোষণ করছে। আমাদের জমিহারাদের রক্ত ও ঘামের ওপর কলকাতা শহর গড়ে উঠেছে। এটাই ইতিহাস। আমরা তো সাতচল্লিশে দেশভাগ চাইনি; চেয়েছি একটি ইউনাইটেড বেঙ্গল নেশন। ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়া হতে পারলে ইউনাইটেড বেঙ্গল হতে পারবে না কেন? সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বোস প্রমুখ তাই চেয়েছিলেন, জিন্নাহরও সম্মতি ছিল। আমরা তো দেশভাগ করতে চাইনি। আমাদের শেখানো হয়েছে মুসলমানরা নাকি দেশভাগ চেয়েছে। এখন ঐতিহাসিকদের গবেষণায় প্রমাণিত এই কাজ উচ্চবর্ণের বাবুরা করেছেন। দেশভাগের পর কী হলো? আমরা একটা ধর্মবাদী রাষ্ট্র গঠন করলাম। ভারতও ধর্মবাদী ছিল, যেটা এখন হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র আকারে পরিগঠিত হয়েছে।

আমাদের জমির সমস্যা যখন মিটে গেছে, তখন বায়ান্নতে আমরা সংস্কৃতি ও ভাষা দিয়ে লড়েছি। আমরা রক্ত দিয়ে বাঙালি হয়েছি। আমরা নিছক ভারতীয় নই, পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয়ও নই। বাঙালি হওয়ার জন্য আমাদের শহীদ হতে হয়েছে। বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য, রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার জন্য আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ যেকোনো প্রশ্নের একেবারে ঊর্ধ্বে। তাই কেউ যদি বলে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান দিয়ে একাত্তরকে বাদ দিচ্ছি, সেটা একেবারে বাজে কথা। তাহলে ঘটনাটা কী ঘটল? একাত্তরে আমরা একটা স্বাধীন ভূখণ্ড আদায় করেছি। কিন্তু এর পরে অনেকগুলো ভাবাদর্শগত প্রশ্নের মীমাংসা আমরা করতে পারিনি। এ কারণে শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্ট সরকার পেয়েছি। সেসব ভাবাদর্শগত প্রশ্নের মীমাংসার জন্যই চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে। এবার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করবার পালা।

এর মধ্য দিয়ে সাতচল্লিশ থেকে পরবর্তী ইতিহাসের ধারাবাহিকতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করলাম, এই দেশ শুধু বাঙালির নয়, সকলের, ছোট–বড় সকল জাতিসত্তার, সকল ধর্মের সকল বিশ্বাসের, আস্তিক কি নাস্তিক সকলের ইত্যাদি। এই বাংলাদেশ পুরো উপমহাদেশ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক অভ্যস্ত চিন্তা থেকে এ জন্য সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলা এখন বিভিন্নভাবে আসবে।

বখতিয়ারের ঘোড়া আকারে নয়, কিন্তু ইসলাম উপমহাদেশের ইতিহাসের অঙ্গাঙ্গি অংশ। উপমহাদেশের ইতিহাস ইসলামেরও ইতিহাস। অর্থাৎ আমরা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান তার প্রমাণ। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সেদিকে নিয়ে যাবে। এটা করতে গিয়ে আমাদের অনেক দুর্বলতা বের হবে। অনেক ব্যর্থতা থাকবে। কিন্তু আমরা তা কাটিয়ে উঠব। আমরা ইতিহাসের আরেকটা স্তরে উপনীত হতে পারব।

প্রথম আলো:

বাঙালি জাতীয়তাবাদ আকারে পরিগঠিত সংস্কৃতি আমাদের এখানে ধর্মের প্রশ্নটা মীমাংসা করতে পারেনি। তার বিপরীতে আমরা ধর্মবাদী রাজনীতির উত্থান দেখলাম। আমরা আবারও সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছি না তো?

ফরহাদ মজহার: আমরা এখনো ধর্ম বলতে যা বুঝি, সেটা পশ্চিমাদের দ্বারা সংজ্ঞায়িত। ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা পশ্চিমা আধুনিকতা নিয়ে আলোচনা করি। এ ধরনের প্রাথমিক স্তরের মূর্খতা আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। ধর্মের কথা বলা মানেই তো ধর্মরাষ্ট্র স্থাপন করা নয়। আইনি বিবর্তনের জায়গা থেকে দেখলে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোও আসলে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণাটাই তো খ্রিষ্টান ধারণা। সার্বভৌমত্ব আদিতে ছিল আল্লাহর কাছে। সেখান থেকে যিশু, গির্জা আর রাজার হাত ঘুরে মানুষের কাছে এসেছে। ফলে স্বভাবতই ইসলামি রাষ্ট্র বলে কিছু থাকতেই পারে না। ইসলামে তো সার্বভৌমত্ব গায়েবের কাছে। তার কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হয়। আর ইহকালে তার কাজ হলো মজলুমের পক্ষে জালিমের বিরুদ্ধে লড়াই করো। এটাই ইসলাম।

ইসলামি রাষ্ট্র বলে কিছু থাকতে পারে না, কারণ রাষ্ট্র নিজেই জালিম হয়ে উঠতে পারে। রাষ্ট্র জালিম হয়ে উঠলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, যেটা আমরা করেছি। আমাদের সমস্যা হচ্ছে ইসলাম বা কোরআন শরিফকে আমরা দর্শন আকারে পড়িনি। আল্লাহ মানুষকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তাঁর খলিফা হিসেবে বিবেক, বুদ্ধি, যুক্তি আর কল্পনা দিয়ে। এগুলো ব্যবহার করে পড়া মানেই দার্শনিকভাবে পড়া। আমাদের নিজের চিন্তাগুলো এভাবে পড়তে পারলে আমরা পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যকে ছুড়ে ফেলে নতুন ধরনের জনগোষ্ঠী আকারে হাজির হতে পারব।

প্রথম আলো:

আমাদের নদীবিধৌত বাংলার তো নিজেরই একান্ত বহু ধর্মীয় ভাব আছে—নাথ, বৈষ্ণব, শাক্ত, বাউল, মারেফতপন্থা। এদেরও তো বিরাট দাবি আছে।

ফরহাদ মজহার: অবশ্যই। আমাদের মধ্যে এসব ভাব তো একাকার হয়ে আছে। ফকির লালন সাঁই, জালালউদ্দীন খাঁ, রাধা বল্লভ, খালেক দেওয়ান, আবদুল হালিম বা ফকির–দরবেশ–বয়াতিদের হাতে এটা হয়েছে। সুফিরা করেছেন। তারও আগে বৌদ্ধ সহজিয়ারা করেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে পূর্ব বাংলাতেই এটা হয়েছে। বাংলা সব সময় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধর্মের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। নামাজ হচ্ছে; আবার তার পাশেই গান হচ্ছে, ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এ মন্ত্রণা কে দিয়েছে?’

ধর্মকে দর্শন আর আইন আকারে হাজির করা পাশ্চাত্যের অবদান। ইসলামে আল্লাহ সব সময় কোনো না কোনো রুহানির পথ আপনাকে দেখাচ্ছে। কোনো ব্যক্তি সত্যের দাবি করতে পারে না। কারণ, মানুষ মৃত্যুর দ্বারা সীমিত। স্থানকালে আবদ্ধ। আপনি নশ্বর। মহানবী (সা.) মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করলেন যে মানুষের মধ্যে রক্ত, গোত্র, জাতিকেন্দ্রিক কোনো পরিচয়বাদ থাকতে পারে না। মানুষের একটাই পরিচয়, সে আদম ও হাওয়ার সন্তান। মূলে সে একটাই জাতি।

নৃতাত্ত্বিক অর্থে বিভিন্ন জাতি ও ভাষা তৈরি করে আল্লাহ বলছেন, তারা যেন পরস্পরকে চেনার চেষ্টা করে। তাদের সবাইকে নিয়ে বিশ্বসমাজ গড়তে হবে। এর সঙ্গে কমিউনিজমের কী তফাত? মার্ক্স তো কমিউনিজমকে কোনো ইডিওলজি বা ধর্ম বলেননি, বিশ্বসমাজ গঠনের দিক থেকে মানবেতিহাসের অভিযাত্রা বুঝিয়েছেন। তাই না?

প্রথম আলো:

আমাদের লড়াইয়ের এই যে দীর্ঘ পথ, এখানে দাঁড়িয়ে আপনি বাংলাদেশের কী ভবিষ্যৎ দেখেন?

ফরহাদ মজহার: আমি মনে করি, বাংলাদেশ হিসেবে আমরা সাংঘাতিক ভালো করেছি। পশ্চিমকে কত শতাব্দী পার করে এখানে পৌঁছাতে হয়েছে ভেবে দেখুন! আমরা তো মাত্র ৫০ বছরে এত দূর চলে এলাম। আমরা এখন ঢাকায় বসে সাহস করছি পশ্চিমকে মোকাবিলা করার। বায়ান্নতে রফিক, জব্বাররা শহীদ হলেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি,’ এর মধ্য দিয়ে নতুন চেতনার যে বীজ পোঁতা হলো, সেটি দিয়েই তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। চব্বিশে আমরা আরেকটা বড় বীজ বুনেছি। এটি মহিরুহ হবেই। তার কাছে আগামী আরও ৫০ বছরও কিছু না।

এখনকার তরুণ প্রজন্ম অদ্ভুত সব চিন্তা করছে, স্বপ্ন দেখছে। এই বাংলাদেশ তো পরাজিত হতে পারে না। আপনি মারপিট করতে পারেন, গৃহযুদ্ধ বাধাতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশ কখনোই সিরিয়া হবে না। মধ্যপ্রাচ্যে তো আমাদের তরুণদের মতো এমন চিন্তা বিকশিত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটনা ঘটছে, তার তো কিছু খোঁজখবর রাখি আমি। আর ইসলাম মধ্যপ্রাচ্যে এসেছে দেড় হাজার বছর আগে। আমরা এখানে তারও বেশি সময়ের দীর্ঘ ইতিহাস বহন করে চলেছি। বিভিন্ন ধর্মভাব, ভাবান্দোলন, কাব্য, সাহিত্য—নানাভাবে আমাদের সমৃদ্ধ করেছে।

এই পুরো মন নিয়েই আমাদের দাঁড়াতে হবে। এ জন্য যে রাজনৈতিক পরিসর দরকার, সেটা আমরা বাংলাদেশে তৈরি করতে চাই। ভারত এখানে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। হিন্দুত্ববাদের কারণে দৌড়ে সে আমাদের সঙ্গে পারবে না। বাংলা ভাষার মধ্যেই এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবটা ঘটবে। আমাদের চেতনার মূল বীজটা রোপিত হয়ে গেছে। পাটাতন তৈরি হয়ে গেছে। আমি এক ফোঁটাও হতাশ নই।

প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
ফরহাদ মজহার: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।