প্রথম আলো: ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন। আলোচনা শুরু করতে চাই আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। সাতচল্লিশের দেশভাগের কথা কি আপনার মনে আছে?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: দেশভাগের সময় আমার বয়স ৯ বছর। কিছু কিছু মনে আছে। আজ বাংলাদেশে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তার করছে এবং ক্ষমতার রাজনীতি তা দেখেও না দেখার ভান করছে, সে সময়ে কিন্তু সে রকম ছিল না। আমার মনে আছে, চট্টগ্রামে মুসলিম লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনেই দাঙ্গা দমনে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, হিন্দুদের ওপর হামলা হলে হামলাকারীদের গুলি করে মারা হবে। বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে সে সময়ে সামাজিক সম্প্রীতি অনেক সুদৃঢ় ছিল। সাধারণ মানুষ দাঙ্গাবাজদের রুখে দিয়েছে। ছেলে দাঙ্গায় জড়িত ছিল বলে চট্টগ্রাম মুসলিম লীগের সভাপতি তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। এখন কি এমনটি ভাবা যায়?
প্রথম আলো: দেশভাগের সময় আপনার পরিবারও তো ভাগ হয়ে গেল। আপনি এখানে থেকে গেলেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: সাতচল্লিশে আমার মা-বাবা, ভাই-বোন—সবাই এখানে ছিলেন। ১৯৬২ সালে দুই ভাই ভারতে চলে যান। এক ভাইয়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছিল। বাবা চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬২ সালে আমি প্রথম গ্রেপ্তার হই। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে মা–বাবা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। আমি তখন চট্টগ্রাম জেলে। কারা কর্তৃপক্ষ কুমিল্লা জেলে পাঠানোর আগে মা–বাবার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেয়। বাবা বললেন, আমি তোমাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে বলেছিলাম। তুমি দেশের দায়িত্ব নিতে রাজনীতিতে গেলে। আমাদের দেখার কেউ রইল না। এ অবস্থায় ভারতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমি যেই ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা আসি, সেই ট্রেনেই মা–বাবা দেশান্তরিত হলেন।
প্রথম আলো: কীভাবে ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হলেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: ১৯৫৭ সালে আমি চট্টগ্রাম স্কুল থেকে বহিষ্কার হই। ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমরা মিছিল বের করতাম। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করি। নবম শ্রেণিতে পরীক্ষা দেওয়ার পর আমার ফল স্থগিত করা হলো। আমি ভালো ফুটবল খেলতাম। ফলে অন্য স্কুল আমাকে সাগ্রহে ভর্তি করল। আমাদের স্কুল জেলায় চ্যাম্পিয়ন হলো। জাতীয় পর্যায়ে রানার্স আপ হয়। ১৯৫৮ সালে কলেজে ভর্তি হই। সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর প্রকাশ্যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ইউএসপিসি নামে সংগঠিত হতে থাকেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম। জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র। সেখানে ঋষিতুল্য মানুষ অধ্যাপক জি সি দেবের সান্নিধ্যে আসি। তিনি ছাত্রদের সন্তানের মতো দেখতেন। ১৯৬২ সালে একবার জেলে যাই। ১৯৬৪ সালের মোনায়েম খানের সমাবর্তন বানচাল করার দায়ে আবার গ্রেপ্তার হই।
প্রথম আলো: পাকিস্তান সরকার আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছিল। তার পটভূমি কী ছিল?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয় ১৯৬৭ সালে। আমি ন্যাপের রিকুইজিশন সম্মেলনের মঞ্চ তৈরি ও নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলাম। মূলত ছয় দফা প্রশ্নে ন্যাপ ভাগ হয়ে যায়। মাওলানা ভাসানী বললেন, ডোন্ট ডিস্টার্ব আইউব। আমরা বললাম, আইউব শাহিকে ক্ষমতা থেকে হটাতে হবে। আল হেলাল হোটেলে খেতে গেলে গোয়েন্দা পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করল। একনাগাড়ে চার দিন তিন রাত আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। বিরতিহীন। জিজ্ঞেস করা হলো, আমি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস, ট্যুরিস্ট হোটেলে, কক্সবাজারে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছি কি না। উপাচার্যদের কাছে লেখা একটি চিঠি দেখাল। বলল, ওই চিঠিতে নাকি আমি তাঁদের ভয় দেখিয়েছি, ছাত্রছাত্রীদের কর্মসূচি পালন করতে না দিলে পরিণতি খারাপ হবে। আসলে এ রকম কোনো চিঠি আমি লিখিনি। এটি ছিল মোনায়েম খানের ষড়যন্ত্র। আমার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করতে চাইল। কিছুই পেল না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাকে সরাসরি জেল হাসপাতালে পাঠানো হলো।
প্রথম আলো: স্বাধীনতার পর আপনারা প্রকৃত বিরোধী দল হতে পারতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে গেলেন কেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: আমরা বিলীন হইনি। তৎকালীন বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে। চীনও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছিল। ইতিমধ্যে জাসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের বন্ধুদেশগুলোর অভিমত ছিল, মুজিবকে যাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উৎখাত করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। আমরা তাদের পরামর্শ মেনে চলি। যেখানে আমাদের প্রকৃত বিরোধী দল হওয়ার কথা, সেখানে অনুগত বিরোধী দল হয়েছি। তিয়াত্তরের নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিয়াত্তরের ১ জানুয়ারির ঘটনায় দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের ডানপন্থীরা সামনে চলে এল।
প্রথম আলো: আপনারা বাকশালে কেন যোগ দিলেন? এটি কি ভুল ছিল না?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি মিলে গণঐক্য জোট গঠিত হয়েছিল। আমরা বলেছিলাম ৫১ শতাংশ এমপি দুর্নীতিবাজ। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি হিসাব করে দেখেছি ৩০ শতাংশ। তিনি এ–ও বললেন, আমি এই আওয়ামী লীগ রাখব না, লেজে জুড়ে দেব। তিনি একদলীয় ব্যবস্থার কথা বললেন। কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মণি সিংহ বললেন, ব্রিটিশ প্রবর্তিত বহুদলীয় ব্যবস্থার প্রতি উপমহাদেশের মানুষের প্রবল আগ্রহ আছে। তাই জোট, যুক্তফ্রন্ট হতে পারে। কিন্তু একদলে যাওয়ার আগে চিন্তা করা প্রয়োজন, মানুষ কীভাবে নেবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনারা সারা বিশ্বে একদলীয় শাসন করবেন আর এখানে ভিন্ন কথা বলবেন, তা হয় না। কোন কমিউনিস্ট দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা আছে? অনেকের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নের পরামর্শে বাকশাল হয়েছে। এটি ঠিক নয়। বঙ্গবন্ধুই বললেন, ফিদেল কাস্ত্রো তাঁকে এই ধারণা দিয়েছেন। তিনি (কাস্ত্রো) বলেছেন, ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থা অনুসরণ কোরো না। যেসব দেশ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়, সেসব দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করতে দেওয়া আত্মহত্যার শামিল। আমাদের মূল্যায়ন হলো, একদলীয় ব্যবস্থা ভালো হয়নি।
প্রথম আলো: সারা জীবন বাম রাজনীতি করলেন। এখন কি মনে হয় না অর্জনের চেয়ে বিসর্জনের পাল্লাই ভারী।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: আমি রাজনীতিকে দেখি দেশসেবা হিসেবে। ষাট বছর ধরে মানুষের সঙ্গে আছি, এটাও কম প্রাপ্তি নয়। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বড় অর্জন। সংবিধানে চার মূলনীতি ছিল। তবে আমরা অনেক কিছুই ধরে রাখতে পারিনি। বাংলাদেশ এখন ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিবর্তনের সময় এসেছে। তবে শুভ শক্তির হাতে যাবে না অশুভ শক্তির হাতে, সেটি বলা কঠিন। কেন গণপিটুনিতে মানুষ মারা যাচ্ছে, কেন শিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, কেন এজলাসে হত্যার ঘটনা ঘটছে? তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
প্রথম আলো: এর প্রতিকার কী?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: জনগণের ভোটের মালিকানা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ভোটের অধিকার তো তাঁদের কাছে নেই। রাজনৈতিক মহলে যেসব গুঞ্জন শুনতে পাই তা রাজনীতিকদের জন্য মোটেই মর্যাদাকর নয়। কেউ যদি এসে বলেন, ‘আপনি তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি। আপনাকে কেন সালাম দেব, সেটি কী লজ্জার কথা।’ ভোটের মালিক পুলিশ কিংবা প্রশাসন নয়, ভোটের মালিক জনগণ। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ভোটের মালিকানা ফিরিয়ে আনতেই হবে, না হলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ থাকবে না। এখন সংসদে যে বাজেট হয়, তা জনগণের কল্যাণে নয়। ব্যবসায়ীবান্ধব বাজেট হলে আমাদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু এটি ‘দুই নম্বরি’ ব্যবসায়ীদের বাজেট। রাষ্ট্রপতি বলেছেন সংসদে ৮২ শতাংশ ব্যবসায়ী। রাজনীতি ও রাজনীতিকদের অবমূল্যায়ন করতে করতে পরিস্থিতি এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, গণতন্ত্রের নিবু নিবু আলোটিও আর থাকছে না।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা কেমন আছেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: এককথায় বলতে হয়, সংখ্যালঘুরাও ভালো নেই। তারা ভয়ভীতিতে দিন কাটাচ্ছে। পাহাড়ের মানুষও ভালো নেই। সমতালের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষগুলো ভালো নেই। পাহাড়ের জনপ্রতিনিধিরাও নিরাপদ নন। অর্থনৈতিক কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। যাঁরা বাধা দিতে পরতেন, তাঁরা দিচ্ছেন না। আমরা দলীয় অবস্থান থেকে, সামাজিক সংগঠন থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেও কেউ শুনছে না। সারা দেশে একধরনের সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। হয়তো ভারতের ঘটনাবলিও প্রভাব ফেলছে।
প্রথম আলো: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রিয় বালা সাহা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: প্রিয় বালা সাহা সংখ্যালঘু নিখোঁজ হওয়ার যে সংখ্যা বলেছেন, তা সঠিক না হতে পারে। কিন্তু সংখ্যালঘুরা যে নিরাপত্তাহীনতায় আছে, অনেকে দেশ ত্যাগ করছে, তা তো মিথ্যে নয়। প্রিয় বালার বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি, তাতে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ আরও জোরদার মনে হয়েছে। অনেক সময় ওয়াজ মাহফিল থেকেও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়। সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেককে কাছে পাই না, আবার অনেককে পাই। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলসহ সব দলের জন্যই এ কথা
প্রযোজ্য। সরকারের সঙ্গে দলের কোনো সমন্বয় নেই। সরকার টিকে আছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ভর করে।
প্রথম আলো: ৮০তম জন্মদিনে আপনার অনুভূতি কী?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: দেশে এখন ডেঙ্গু মহামারি রূপ নিয়েছে। মেয়র ও মন্ত্রীরা যা করছেন, তা দায়িত্বশীল আচরণ নয়। গণপিটুনিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। কৃষক ধানের ন্যায্য দাম পাননি। আড়াই লাখ শিক্ষার্থী কলেজে ভর্তি হতে পারছে না। সরকারি দলের অনেকে বিহ্বল অবস্থায় আছেন। আবার বিরোধী দলও নিষ্ক্রিয়। এ সময়ে বিভিন্ন দলের মানুষ আসে আকুতি নিয়ে। মানুষ বিকল্প চায়; যারা মানুষের দুঃখ নিয়ে মশকরা করবে না; দুঃসহ অবস্থা থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকবে। ব্যাপকভিত্তিক দায়বদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটাতে হবে, ভোটের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেবে। আশা করি, বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: ধন্যবাদ।