ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা কী? কেন এমনটি হলো?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্যাংকিং খাতের বর্তমান যে সমস্যাসংকুল অবস্থা, তার মূল কারণ সুশাসনের অভাব। এরপর রয়েছে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের নমনীয় অবস্থান।
আপনি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন, তখনো তো ব্যাংকিং খাতে সমস্যা ছিল। কীভাবে বিষয়গুলো সামাল দিতেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: বিভিন্ন সময় ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলোর জন্য বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি ও কমিশন তাদের সুপারিশ দিয়েছিল। সেটার ওপর ভিত্তি করেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কতগুলো আর্থিক নীতিমালা ও নির্দেশিকা তৈরি করা হয়। আমার সময় বিভিন্ন সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলো পরিমার্জন করে ব্যাংকিং আইনের আওতায় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ দিক ছিল—সব ব্যাংককে এগুলো পরিপালন করার জন্য বাধ্য করা হতো। যারা করতে পারত না, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। আরেকটা বিশেষ দিক ছিল—রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ কিছু থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমি আলাপ-আলোচনা করে সেগুলোকে প্রশমন করতাম। সম্পূর্ণ পেশাদারত্বের ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম চালানো হতো।
অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি মনে করেন, ঋণ নিলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। পরিস্থিতি এমন একটি জায়গায় এসে ঠেকল কীভাবে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: ঋণ নেওয়ার পর ঋণ ফেরত না দেওয়ার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেটার মূল কারণ খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নমনীয় হয়ে অনেক ছাড় দিয়েছে, সময় বাড়িয়েছে—এগুলোর কোনো ইতিবাচক ফল মেলেনি। বিশেষ করে আমাদের দেশের ব্যাংকঋণগুলো বড় ও সীমিতসংখ্যক ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমার সময় প্রথমবার ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের ক্ষেত্রে বকেয়া ঋণের ১০ শতাংশ শোধ করতে হতো। দ্বিতীয়বার পুনঃ তফসিলীকরণের সময় ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়বার পুনঃ তফসিলীকরণের সময় ৩০ শতাংশ শোধ করতে হতো। এটা এখন এসে ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন কৌশলে অযৌক্তিক ক্ষেত্রে ঋণ নেওয়া, ঋণ নিয়ে সেটা অন্যত্র ব্যবহার করা এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া।
সম্প্রতি আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ দিয়ে টিকিয়ে রাখছে, যার মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের মতো একদা সবল ও বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংকও আছে। কেন এমনটি হলো?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: সম্প্রতি কতগুলো ব্যাংক, কিছু কিছু দুর্বল এবং ভালো ব্যাংকও নানা রকম সমস্যায় পতিত হয়েছে। বিশেষ করে তাদের তারল্যসংকট দেখা দিয়েছে। এর মূল কারণ হলো খেলাপি ঋণ আদায় কম এবং সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতের ওপর গ্রাহকের আস্থার কিছুটা ঘাটতির ফলে আমানত কমে যাওয়া। এ সময় আপৎকালীন পদক্ষেপ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার কথা বলা হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংকারদের বৈঠকেও এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। এটি আদৌ কার্যকর হবে বলে মনে করেন? ২০১৬ সালে আপনারা ঢাকা ফোরাম থেকে একই আহ্বান জানিয়েছিলেন।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: ইদানীং কিছু দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়ার কারণ হলো ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। সেটা কমিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের সুবিধার্থেই বাংলাদেশ ব্যাংক এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ৬১টি ব্যাংক থেকে ৪৫টিতে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। অথচ গত দেড় দশকে নতুন বেশ কিছু ব্যাংক দেওয়া হয় ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের এবং তা রাজনৈতিক বিবেচনায়। একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সবল ব্যাংক ও দুর্বল ব্যাংক—দুই পক্ষকেই সম্মত হতে হবে, কাজটি সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে সম্পদ ও দায় কীভাবে একীভূত করা হবে, সেটা একটা জটিল প্রক্রিয়া।
২০১৬ সালে আমি ঢাকা ফোরামের সভাপতি হিসেবে এটা করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। দুঃখের বিষয়, সেটা তখন কর্ণপাত করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকে আমার সময় বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে একটি মার্জার বা অ্যাকুইজিশন নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছিল। সেটার ব্যবহার বা পরিমার্জনের বিষয়ে আমি কিছু শুনিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় দ্বৈত নীতি বহাল আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকার পরও অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক বিভাগ থাকার প্রয়োজনীয়তা কী?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশের ব্যাংক-ব্যবস্থায় দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ, অর্থাৎ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক দায়িত্ব ও জবাবদিহিরও ঘাটতি দেখা যায়। ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে আর্থিক বিভাগ থাকার কোনো যৌক্তিকতাই নেই, সব ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতাভুক্ত থাকতে হবে। বর্তমানে যে ব্যবস্থা, এটি একটি উদাহরণ, যা অন্য কোনো দেশে আছে বলে আমার মনে হয় না।
প্রথম আলো: বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। অনেকের অভিযোগ, ব্যাংকগুলো এখন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। উত্তরণের উপায় কী?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পারিবারিক সদস্যেরা ব্যাংককে তাঁদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করেন। এতে সুশাসনের ঘাটতি, আর্থিক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতকে সংকটজনক অবস্থায় নিয়ে এসেছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংস্কার বরং উল্টো রথের যাত্রার মতো, প্রথমে পরিবারের সদস্য ছিল দুজন, তারপর করা হলো চারজন। এখন কমিয়ে এনে তিনজন করা হয়েছে, যাঁরা ৯ বছর পর্যন্ত পর্ষদে থাকতে পারবেন। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক পদক্ষেপ।
সরকার আশা করছে, আইএমএফের তৃতীয় কিস্তির অর্থ পেলে ডলার-সংকট কমে যাবে। আপনার বিশ্লেষণ কী?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: শুধু আইএমএফের ঋণ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সমাধান করা যাবে না। কিস্তির অর্থ পেলে সংকটের কিঞ্চিৎ প্রশমন হবে। এটার ওপর নির্ভর না করে বরং আমাদের ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হবে, রপ্তানি রেমিট্যান্স ও বিদেশিদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ চুরি নিয়ে সিআইডির তদন্তে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানসহ ১২ কর্মকর্তার দায় পেয়েছে। এই দায় কি কেবল কারিগরি ও পেশাগত অদক্ষতা, না অন্য কিছু?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ চুরির ব্যাপারে কারিগরি, পেশাগত দক্ষতা ও তদারকির অভাব ছিল। এ বিষয়ে যথাযথ তদন্তকারী সংস্থা জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে।
জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশে করের হার সবচেয়ে কম। অনেক দিন ধরেই করনীতি সংস্কারের কথা শোনা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরাই কি এটি ঠেকিয়ে রেখেছেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: জিডিপি করহার বাংলাদেশে কম হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর আদায়ের সীমাবদ্ধতা। বিশেষ করে আয়করের হার ও শ্রেণিবিন্যাসে যৌক্তিকতার অভাব, তদুপরি রয়েছে ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক—উভয় পর্যায়ে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার ও আধুনিকায়নে গতির মন্থরতা। আরেকটি কারণ, পাচারের টাকা ফেরত আনার ব্যাপারে বাজেটে নানা রকম প্রণোদনা, যা ভালো করদাতাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
এই মুহূর্তে জনজীবনের প্রধান সমস্যা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে ডলার-সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দেওয়া হয়। কিন্তু দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও কেন লাগামছাড়া বাড়ছে? এর পেছনে কাদের হাত রয়েছে বলে মনে করেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: মূল্যস্ফীতি একটি প্রধান সমস্যা, যা মূলত সরবরাহজনিত। অর্থাৎ বাজারে ন্যায্য দামে পণ্য সরবরাহ হচ্ছে না, উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের চাঁদা আদায়, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের প্রচেষ্টা। এ ক্ষেত্রে আরেকটি কারণ হচ্ছে বাজার তদারকির অভাব। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা মাঝেমধ্যে লোকদেখানো পদক্ষেপ নেয়, যেটাতে অসাধু বিক্রেতারা মোটেও ভয় পান না। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে আমদানি করা পণ্যের মূল্য বেড়ে যায় ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে, কিন্তু সেটা মূল কারণ নয়।
সার্বিকভাবে অর্থনীতি যে সংকটে আছে, এটা সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও স্বীকার করছেন। কিন্তু পরিস্থিতি উত্তরণে কোনো টেকসই কর্মপরিকল্পনা দেখছেন কি? যদি না দেখেন, আপনার পরামর্শ কী?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: প্রথমত, সমস্যাগুলো নীতিনির্ধারক ও সরকারি কর্মকর্তাদের গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। অনেক সময় বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের মনোভাব বিবেচনায় না নিয়ে সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য মোটাদাগে প্রয়োজন কঠোরভাবে সংস্কার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা। তারপর সরকারি নিয়ন্ত্রণকারী এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতা সুনিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো নীতি বা কৌশল বাস্তবায়ন, সরকারি পরিষেবা দেওয়া, সাধারণ মানুষের অভিযোগ প্রশমিত করা—এসব ক্ষেত্রে মোটেও সফলতার পরিচয় দেয়নি। এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এখন সময় এসেছে আমাদের ইতিবাচক অর্জনগুলো সুসংহত করার এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য উপরিউক্ত বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া, সেই সঙ্গে সব ক্ষেত্রে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা।
ব্যাংক খাতে যে বড় সংকট চলছে, তা নিজেই বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পথনকশা ঘোষণা করে খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি বেনামি ও প্রতারণার ঋণ শূন্যে নামিয়ে আনার কথাও বলছে। এটা কতটা সুফল দেবে বলে মনে করেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্যাংক খাতের সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ১১টি কার্যক্রম খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য ও ৬টি সুশাসন আনার জন্য—মোট ১৭টি কার্যক্রম দিয়ে একটি পথনকশা দিয়েছে। খেলাপি ঋণ এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যেও কতগুলো অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ কমানোর যে টার্গেট দেওয়া হয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন হবে।
২০০৯ এর পর থেকে খেলাপি ঋণ ১৮ হাজার কোটি টাকা থেকে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ক্রমাগত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে, সেগুলো সমাধান না করে রোডম্যাপে কতগুলো কার্যক্রম দেওয়াই যথেষ্ট নয়, উপরন্তু কার্যক্রমগুলো আংশিক। সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, এগুলো পূর্বের অন্যান্য পদক্ষেপের মতোই ইচ্ছাপূরণের অংশ। খেলাপি ঋণ ও সুশাসন—দুটোই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অতএব ১৭টি কার্যক্রমই সমন্বিতভাবে গ্রহণ না করলে উদ্দেশ্য সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো দেড় দশক ধরে কিছু ভুল নীতি ও কৌশলের ফলে বর্তমানে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোর সংশোধন জরুরি, যা ১৭টি কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কঠিন হবে।
এত দিন পর এসে পরিচালক হওয়ার বয়স ন্যূনতম ৩০ বছর নির্ধারণ করা হলো। স্বতন্ত্র পরিচালকদের কিছুটা ক্ষমতা দেওয়া হলো। এর কী প্রভাব পড়তে পারে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: পরিচালকদের অভিজ্ঞতা ও বয়সসংক্রান্ত যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটা একটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু শুধু পরিচালকদের ওপর নির্ভর করেই ব্যাংকগুলোকে ঠিক করা যাবে না। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের যে আইন ও আর্থিক নীতি আছে, সেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যথাযথ পরিপালন বা প্রয়োগ করা হয় না। তা ছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালকের বিষয়েও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু তাঁদের অভিজ্ঞতা ও সম্মানী ভাতা–সম্পর্কিত পদক্ষেপ তেমন কাজে আসবে না। অনেক ক্ষেত্রেই এসব পরিচালক পদে চেয়ারম্যান ও পর্ষদের পরিচালকদের বন্ধুবান্ধব অথবা পরিচিত লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
তাঁদের মতামত পর্ষদের সভায় তেমন আমলে নেওয়া হয় না। এমনকি তাঁদের আপত্তিও উপেক্ষা করা হয়। সার্বিকভাবে ব্যাংক পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা এবং পরিবীক্ষণ ও তদন্ত—সব পর্যায়েই কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। তাহলেই সুশাসনের দিকটা কিছুটা নিশ্চিত করা যাবে।
এক পরিবারের কাছে পাঁচ ব্যাংক, একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এটা কীভাবে হলো? নীতিনির্ধারণ ও প্রয়োগে এটা সমস্যা তৈরি করছে কি না?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা পরিবারের কাছে একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। এতে করে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব দেখা যায়। বাংলাদেশে এটা বিশেষত ক্ষমতার বলয়ে যেসব ব্যক্তি আছেন, তাঁরা বিভিন্নভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি বিভিন্ন নীতিনির্ধারণে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেন। এমনকি প্রভাবশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাঁদের সখ্য থাকে। এসবের কারণেই বর্তমানে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে আর্থিক খাতে একচেটিয়া ব্যবসায়ী প্রভাব বাড়ে এবং প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ কতগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, যা মানুষের মনে শঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও হতাশার সৃষ্টি করেছে। সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে সুযোগগুলো দেখা যায়, যেমন প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়—এগুলো সন্তোষজনক হলেও এগুলোর সুফল নিচের দিকের, অর্থাৎ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। আয় ও সম্পদের বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলোও অনেকের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সার্বিক উন্নতি বলতে আমরা যেটা বুঝি, সেটা আমরা অর্জন করতে পারিনি।
আরেকটি বিষয় হলো টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা, অর্থাৎ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ভঙ্গুরতা কমানোর বিষয়ে আমরা তেমন সফলতা দেখতে পারিনি। কোনো রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য নেতিবাচক প্রভাবে আমাদের উন্নয়ন মন্থর হয়ে যেতে পারে, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অচল হয়ে যেতে পারে।
শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে পড়ার ঝুঁকি নেই তো?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: শ্রীলঙ্কার মতো বিপর্যয়ের অবস্থা আমাদের দেশে বিরাজমান নয়। বাংলাদেশ গত ৫২ বছরে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে উন্নয়নের একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এটাকে সুসংহত করে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। এর জন্য প্রয়োজন উন্নয়ন কৌশলের পরিবর্তন ও পরিমার্জন। সেই সঙ্গে নীতি ও কৌশলের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, সরকারি সম্পদের অপচয় রোধ, দুর্নীতি দমন, জনগণের চাহিদার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সব ধরনের নীতি, কৌশল ও প্রকল্প প্রণয়ন; যা সম্ভব হবে যদি সব ক্ষেত্রে সুশাসন ও আইনের শাসন সন্তোষজনকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।