বিশেষ সাক্ষাৎকার: বদরুদ্দীন উমর

বাংলা ভাষাটা শিক্ষিত লোকের চেয়ে গরিবদের অনেক বেশি দরকার

বদরুদ্দীন উমর বামপন্থী লেখক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তিনি মৌলিক ও বিশদ গবেষণা করেছেন। তাঁর লেখা পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইটি এ বিষয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও আকরগ্রন্থ। এ সাক্ষাৎকারে তিনি ভাষা আন্দোলন, তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তাঁর বইয়ের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

প্রথম আলো:

বর্ধমান থেকে ঢাকায় এসে ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। শুরুতেই জানতে চাই, ঢাকার তখনকার রাজনৈতিক আবহটা কেমন দেখেছিলেন?

বদরুদ্দীন উমর: আমার বাবা আবুল হাসিম সাহেব মুসলিম লিগের খুব গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। ১৯৪৮ সালে আমাদের গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে তিনি বর্ধমানে নতুন বাড়ি করেছিলেন। ঢাকায় আসতে চাইলে তিনি সেখানে বাড়ি করতেন না। কিন্তু বর্ধমানে সে রকম রায়ট না হলেও আমাদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার কারণে বাবা খুব বিচলিত হয়ে উঠলেন। ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন।

আমাদের পরিবারটা একটা রাজনৈতিক পরিবার। রাজনীতি ছাড়াও বড় বড় চাকরি করতেন অনেকে। জেলা পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে আমাদের আত্মীয়স্বজন ছিলেন। পূর্ব বাংলায় আমার বাবা আবুল হাসিম সাহেব খুব পরিচিত ছিলেন, অনেক ঘুরেছিলেন, কাজ করেছিলেন। কিন্তু আমার সে রকম জানাবোঝা ছিল না। ঢাকায় যখন এলাম, তখন এখানে সংবিধান নিয়ে আন্দোলন চলছিল। আরও নানা বিষয়ে আন্দোলন ছিল। পঞ্চাশ সালেও ঢাকার অবস্থা বেশ গরম ছিল। আমি তো এখানকার কিছুই জানতাম না। সে জন্য সব মিটিংয়ে যেতাম। আগেকার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব সুন্দর পরিবেশ ছিল, বিভিন্ন বিষয়ে আমতলায় ছাত্রদের মিটিং হতো।

প্রথম আলো:

ভাষা আন্দোলন নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতি শুনতে চাই।

বদরুদ্দীন উমর: দ্বিতীয় পর্বের ভাষা আন্দোলনের মিটিংগুলো শুরু হয়েছিল একান্ন সালের শেষদিকে। আবদুল মতিন (ভাষা মতিন নামে যিনি পরিচিত) এবং আরও কয়েকজনের উদ্যোগে নতুন কমিটি হলো। আটচল্লিশ সালের আন্দোলন বলা চলে ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী সেখানে ছিলেন। তখনও ভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের যুক্ততা খুব বেশি ছিল না।

প্রথম আলো:

ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা ও গবেষণাধর্মী বই লেখার আগ্রহটা কখন আপনার ভেতরে জন্ম নিল। কেন এই তাগিদ অনুভব করলেন?

বদরুদ্দীন উমর: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকা অবস্থায় ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি ভাবলাম, সাতচল্লিশ সাল থেকে পাকিস্তানের যে বৃহত্তর ইতিহাস, তার ওপরে কাজ করব। এ জন্য আমি চিন্তা করতে থাকলাম। এর মেথডোলজি কী হবে, তা নিয়ে আমি চিন্তা করলাম। প্রথমে ঠিক করলাম, রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে, তাঁদের সঙ্গে কিছু আলাপ করি। সেই ভাবনা থেকেই কামরুদ্দীন আহমদের সঙ্গে প্রথম আলাপ শুরু করি।

আমার কাছে মনে হয়েছিল, মেথডোলজির দিক থেকে সাক্ষাৎকার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমার প্রথম সাক্ষাৎকার কামরুদ্দীন আহমদের। বেশ কয়েক দিন ধরে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেছিলাম। তখন রেকর্ডারও ছিল না। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতাম, শর্ট নোট নিতাম। সেদিনই বাড়িতে ফিরে সবকিছু বিস্তারিত লিখে ফেলতাম। কামরুদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলোচনা করে সাতচল্লিশ সাল থেকে এ দেশে কী ঘটেছে, তার সঙ্গে পরিচিত হলাম। যে সমস্ত ঘটনার কথা তিনি বললেন, সেগুলোর সূত্র ধরে আমি সংবাদপত্রে খবর খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম।

প্রথম আলো:

তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা একেবারেই সহজ ছিল না। সেই কষ্টসাধ্য অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলবেন?

বদরুদ্দীন উমর: তখন আমি মূলত আজাদ পত্রিকা দেখতে শুরু করলাম। সংবাদপত্র অনুসন্ধান থেকে আরও অনেক ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হলাম। তখনো ভাষা আন্দোলনের ওপরে বই লিখব, সেটা ভাবিনি। আমার ভাবনায় ছিল ইতিহাস লিখব। এ জন্য কলকাতার নিউজপেপার লাইব্রেরিতেও কিছু কাজ করলাম। সেখানে পুরোনো কাগজপত্র দেখলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বিশেষ কিছু পাইনি। সিলেটের মুসলিম সাহিত্য সংসদের লাইব্রেরি আমার কাজে অনেক সহায়তা করেছিল। সেখানে অনেক পত্রপত্রিকা ছিল।

তথ্য সংগ্রহের কাজগুলো যখন করছি, তখন আমার এক আত্মীয় বললেন, ভাষা আন্দোলনের ওপর আলাদা করে ছোট একটা বই লেখেন। আমি তাঁকে বললাম, ঠিক আছে, অন্য কাজের মধ্যে ভাষা আন্দোলন নিয়ে শ’খানেক পৃষ্ঠার একটা বই লিখব। তখন ভাষা আন্দোলনের ওপর বিশেষভাবে নজর দিলাম। আমি দেখতে পেলাম, ভাষা আন্দোলন নিয়ে তখন লোকে খুব গভীরভাবে চিন্তা করত না। ভাষা আন্দোলনের যে ক্যানভ্যাস ও গভীরতা এবং ভাষা আন্দোলনের যে গুরুত্ব, সেটা কারও লেখার মধ্যে পাওয়া যেত না।

প্রথম আলো:

১৯৪৭–৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব আর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের মধ্যে বিশাল এক গুণগত পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে এই পরিবর্তনের কারণ কী?

বদরুদ্দীন উমর: তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে একটা জিনিস লক্ষ করলাম, আটচল্লিশ সালের ভাষা আন্দোলন আর একান্ন-বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন—দুইয়ের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য। আটচল্লিশ সালে ছাত্রদের পুরান ঢাকার লোকেরা মারপিট করেছে। কিন্তু বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনের যে উত্থান হয়েছিল, তাতে পুরান ঢাকার লোকেরাই ছিল প্রধান শক্তি। তাঁরা এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিল। ভাষা আন্দোলন ঢাকাতে যে আকার ধারণ করেছিল, পুলিশ-মিলিটারি পালিয়ে গিয়েছিল। তিন-চার দিন ঢাকা একরকম আন্দোলনকারীদের দখলে ছিল।

আটচল্লিশ সালে পাকিস্তানের প্রতি মানুষের যে সদয় অনুভূতি ছিল, সেটা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। দেশে কী এমন ঘটল, যার জন্য এই পরিবর্তন ঘটে গেল? এ প্রশ্ন থেকে আমি সামগ্রিক একটা অনুসন্ধান করতে শুরু করলাম। অর্থনীতি, সামাজিক নীতি, নানা রকম রাজনৈতিক আন্দোলন, প্রতিরোধ আন্দোলন, কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা, সিভিল সার্ভিস বা আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অনুসন্ধান করতে লাগলাম। আমার কাছে মনে হলো, ভাষা আন্দোলন একটা বিশাল ব্যাপার। এরপর বই লেখায় হাত দিলাম। এত সব বিষয় এসে গেল যে ১০০ পৃষ্ঠার বই লেখার কথা বাদ দিয়ে আমাকে ভাবতে হলো একটা বড় ইতিহাস বই লিখব। ভাষা আন্দোলনের বই লেখার ক্ষেত্রে আমার কারও কাছ থেকে এক পয়সার ফান্ড নিতে হয়নি।

প্রথম আলো:

ভাষা আন্দোলন নিয়ে আপনার এই মৌলিক ও বিশদ গবেষণায় কাদের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করতে চান।

বদরুদ্দীন উমর: প্রাথমিকভাবে যাঁরা আমাকে গবেষণার কাজে খুব সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কামরুদ্দীন আহমেদ ছিলেন। অলি আহাদের কাছ থেকেও কিছু জিনিস পেয়েছি। তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকেই নথি ও তথ্য পেয়েছি সবচেয়ে বেশি। তাজউদ্দীনের একটা অভ্যাস ছিল তখনকার দিনের নথিপত্র সংগ্রহ করার। আগেকার দিনে দেখা যেত, একটা লিফলেট বা পাম্পলেট বের হলো, কিন্তু তাতে কোনো তারিখ থাকত না। তাজউদ্দীন সাহেবের অভ্যাস ছিল, তিনি যেদিন লিফলেটটা পেতেন, সেই তারিখ লিখে রাখতেন। তাঁর কাছ থেকে যে লিফলেট, পাম্ফলেট পেয়েছিলাম, সেগুলোর তারিখ সম্পর্কে জানা গিয়েছিল। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

তাজউদ্দীনের সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তবু কামরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে তাজউদ্দীনের বাড়িতে গিয়ে আনুষ্ঠানিক ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। তখন তিনি বললেন, ‘আমি একটা ডায়েরি লিখেছিলাম, সেই ডায়েরি আপনার কোনো কাজে লাগবে কি না, দেখেন।’ তাজউদ্দীনের ডায়েরিগুলো ছিল ছোট ছোট। ইংরেজিতে লেখা। সাতচল্লিশ সালে লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, ছাপ্পান্ন সাল পর্যন্ত লিখেছিলেন।

সেগুলো দেখে আমি বললাম যে এগুলো তো মহামূল্যবান সম্পদ। তাজউদ্দীন বললেন, ‘আপনি এগুলো নিয়ে যান, দেখেন আপনার কোনো কাজে আসে কি না। আমি আমার কাজের জন্য বায়ান্ন সাল পর্যন্ত ডায়েরি নিজের কাছে রাখলাম। বাকিটা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে এলাম।’ তাজউদ্দীন সাহেবের ডায়েরিটা খুব উল্লেখযোগ্য এ জন্য যে সেখানে সাতচল্লিশ থেকে শুরু করে প্রতিদিনের এন্ট্রি ছিল।

আরেকটা মস্ত বড় সহায়তা করেছিলেন শহীদুল্লা কায়সার। তখন তিনি মস্কোপন্থী রাজনীতি করতেন। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির পুরোনো যত ডকুমেন্ট, সমস্ত কিছুর দায়িত্বে ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার। আমি তখন কোনো রাজনীতি করি না, কিন্তু শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে নিজেই বললেন, ‘আমার কাছে পার্টির অনেক দলিলপত্র আছে, সেগুলো আপনি ব্যবহার করতে পারেন।’
পার্টির আর্কাইভ থেকে তিনি আমাকে বায়ান্ন সালে প্রকাশিত পার্টির অনেকগুলো লিফলেট দিয়েছিলেন, এমনকি ইনার পার্টি সার্কুলারও দিয়েছিলেন। এসব নথি থেকে ভাষা আন্দোলনের সময় কমিউনিস্ট পার্টির কী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তাদের অংশগ্রহণ কী ছিল, সেটাও বোঝা গিয়েছিল। শহীদুল্লা কায়সারের কাছে যে সহযোগিতা পেয়েছিলাম, সেটা তো কোথাও পাওয়া সম্ভব ছিল না।

সরকারি আক্রমণেও অনেক নথি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আবার লোকে ভয়ে অনেক নথি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এমন অনেক সাধারণ লোকও ছিলেন, যাঁদের কাছ থেকে হয়তো একটা লিফলেট ও পাম্ফলেট পেয়েছি।

প্রথম আলো:

আপনি লিখেছেন, ভাষা আন্দোলনের সত্যিকার নায়ক ছিল পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনগণ। আপনার বইটিও তাদের উৎসর্গ করেছেন। এ প্রসঙ্গটা ব্যাখ্যা করবেন?

বদরুদ্দীন উমর: ভাষা আন্দোলনে কোনো নায়ক ছিল না। আমি আমার বইয়ের উৎসর্গে সেটা লিখেছি। কোনো পার্টিও এ আন্দোলনের নায়ক নয়। সংগঠন হিসেবে ইয়ুথ লিগই ভাষা আন্দোলনে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব ছিল ইয়ুথ লিগের ওপর। ২০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে পরবর্তী যে সময়টা, সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোক ছিলেন ইয়ুথ লিগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ। এ ছাড়া ইয়ুথ লিগের যুগ্ম সম্পাদক ইমদাদ হোসেন, মোহাম্মদ সুলতান , গাজীউল হক—তাঁদেরও ভূমিকা ছিল।

প্রথম আলো:

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হতে না হতেই গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগের মতো সংগঠন গড়ে উঠছে। তারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি জানাচ্ছে। এই বিষয়টাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

বদরুদ্দীন উমর: অনেকের ধারণা, ভাষার ব্যাপারটা শিক্ষিত লোকেদের বিষয়। কিন্তু বাংলা ভাষাটা শিক্ষিত লোকের চেয়ে গরিবদের অনেক বেশি দরকার। কেননা, শিক্ষিত যাঁরা ছিলেন, তাঁরা তো ইংরেজি কিছুটা জানতেন, তাঁদের বাংলা না হলেও চলত। কিন্তু যাঁরা গরিব, তাঁদের তো বাংলা ছাড়া অন্য উপায় নেই। কাজেই আমি আমার ভাষায় কথা বলতে পারব না, ভাষার ওপর এই আক্রমণ তাঁদের জন্য বিরাট একটা ব্যাপার ছিল। তাছাড়া দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাবের একটা ব্যাপার ছিল।

মানুষ তো স্বপ্ন দেখেছিল একটি সোনার পাকিস্তান হবে। কিন্তু দেখা গেল যে প্রথম থেকেই মুসলিম লিগ মানুষকে না খাইয়ে রাখল, তাদের কিছুই দিল না। উপরন্তু তাদের ওপর নির্যাতন চলতে থাকল। খুব অল্প দিনের মধ্যে সামগ্রিক সমাজের মধ্যে পরিবর্তন হলো। এর ফলে উনপঞ্চাশ সালে যখন টাঙ্গাইলে উপনির্বাচন হলো, তাতে দেখা গেল মুসলিম লিগের প্রার্থী টাঙ্গাইলের জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করলেন তরুণ প্রার্থী শামসুল হক।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেকে বলে থাকেন, ভাষা আন্দোলনের জন্যই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এটা কিন্তু ঠিক নয়। পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে যে সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল, সেই দ্বন্দ্বের অবসান হয়ে গেল। এর জায়গায় বাঙালি-অবাঙালি নতুন দ্বন্দ্ব আরম্ভ হলো। রাজনীতির অসাম্প্রদায়িকীকরণ শুরু হলো।

আসলে বলা চলে বাংলাদেশের জন্মের প্রক্রিয়া ১৯৪৭ সালেই শুরু হয়েছে। পাকিস্তান কোনো টেকসই রাষ্ট্র ছিল না। গণ আজাদী লিগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন তারই প্রতিফলন। এই সংগঠনগুলো যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা তো মুসলিম লিগ করতেন। কিন্তু তাঁরা দেখলেন যে পাকিস্তান হওয়ার পরে মুসলিম লিগের রাজনীতির আর কোনো ভিত্তি নেই। তারপর বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন হলো।

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা যখন বলেছিলেন উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা, তখন তার সঙ্গে আরও নির্যাতন, শোষণ, নিপীড়ন সম্পর্কিত ছিল। সব মিলিয়ে ভাষা আন্দোলন একটা বিস্ফোরণ। ভাষা আন্দোলন রাজনীতির অসাম্প্রদায়িকতার একটা বড় প্রতিফলন। ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার রাজনীতির অসাম্প্রদায়িকীকরণের একটা মস্ত বড় মাইলস্টোন। যে প্রক্রিয়া সাতচল্লিশ সালে শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় উনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান হলো, একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সামগ্রিকভাবে বাংলা ভাষার চর্চাকে কীভাবে দেখেন?

বদরুদ্দীন উমর:  ভাষা আন্দোলনের দাবি ছিল, শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যম হতে হবে বাংলা ভাষা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো পরিকল্পনা ছাড়া রাতারাতি শিক্ষার মাধ্যম করা হলো। একটা ভাষা থেকে আরেকটা ভাষায় শিক্ষার মাধ্যম বদলাতে গেলে সেটা খুবই পরিকল্পিতভাবে করতে হয়। বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করতে গেলে বই লাগবে। আগে ইংরেজিতে শুধু বক্তৃতা দেওয়া হতো না, বাংলা ছাড়া সব বিষয়ে বই ইংরেজিতেই ছিল। রাতারাতি শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করায় কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় বক্তৃতা শুরু হলো। ইংরেজি বই গায়েব হয়ে গেল। শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে বাংলাতে অথচ বাংলায় বই নেই। ফলে রাতারাতি শিক্ষার মান পড়ে গেল। এর ফলে অল্পদিনের মধ্যে আজেবাজে নোট বই বের হতে লাগল। ছাত্রছাত্রীরা মূল বই না পড়ে ছোট ছোট নোট বই পড়ে শিখতে লাগল। এভাবে যারা শিক্ষিত হলো, পরে তারা আবার মাস্টার হলো।

এই যে বাংলা ভাষার দুর্গতি, এর সঙ্গে দেখা গেল কিছু লোক চুরি–দুর্নীতিসহ নানা উপায়ে যারা অর্থবিত্তের মালিক হলেন, তারা তাদের সন্তানদের ভালোভাবে শিক্ষিত করতে চায়। তার ফলে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর জন্ম হতে লাগল। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও বড়লোকদের ছেলেমেয়েরা সেখানে ভর্তি হতে থাকল। তার ফলে বাংলা ভাষার চর্চা কী অবস্থায় গিয়ে পৌঁছাল, তা সহজেই বোঝা যায়। এখন অবস্থা হয়েছে ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়ে, তারা বাংলা জানে না। বাংলা না জানায় তারা আমাদের দেশের ইতিহাস, আমাদের দেশের সাহিত্য, আমাদের দেশের সংস্কৃতি থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কাজেই বাংলাদেশের ইংরেজি স্কুল পাস করা শিক্ষিতরা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

প্রথমেই দরকার ছিল বড় আকারের একটা অনুবাদ সংস্থা করা। এখানে সামান্য যেটুকু অনুবাদ হয়েছে, সেটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে হয়েছে। সেই অনুবাদ সংস্থা এখনো হলো না। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্যের বইয়ের বাংলা অনুবাদের বই নেই। এখানে বড় আকারের সরকারি উদ্যোগ দরকার। এখন বই যারা পড়ছে তারা বাংলা জানে না, আর বাংলা যারা পড়ছে, তারা বই পড়ছে না। এই সংকটের মধ্যে বাংলা ভাষার চর্চা কীভাবে হবে।

প্রথম আলো:

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

বদরুদ্দীন উমর: আপনাকেও ধন্যবাদ।