সংবিধান সংস্কার কমিশন এখন কী করছে। আপনাদের আড়াই মাসের অভিজ্ঞতা দিয়েই আমরা শুরু করতে পারি।
আলী রীয়াজ: আমরা এখন সুনির্দিষ্টভাবে সুপারিশগুলো লেখার কাজ করছি। আমরা দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এখানে এসেছি। এ প্রক্রিয়ায় আমরা অংশীজনদের মতামতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা বিবেচনা করেছি, নাগরিকেরা হলেন সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। এই বিবেচনা থেকেই আমরা প্রথমত একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সবার মতামত আহ্বান করেছিলাম।
আমরা প্রায় ৫০ হাজার মতামত পেয়েছি। তবে ওয়েবসাইটের এই মতামতের একটি দুর্বলতা হলো, এগুলো খুব বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ, কে কোথা থেকে মতামত দিচ্ছেন, কেউ একাধিকবার মতামত দিচ্ছেন কি না, কিংবা তাদের সঠিক পরিচয় নিয়েও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। এ ধরনের দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও মতামতগুলো থেকে সাধারণ নাগরিকেরা কী চাইছেন, সে সম্পর্কে একটি ধারণা আমরা করতে পেরেছি।
ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক প্রতিনিধিদের আমরা ছোট ছোট গ্রুপে ডেকেছি। ৪৩টি সংগঠন তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছে, তাঁদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা ২৭ জনের সঙ্গে কথা বলেছি। ১০ তরুণ চিন্তাবিদ এবং ৭ জন সংবিধানবিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এর পাশাপাশি আমরা ২৫টি রাজনৈতিক দল ও তিনটি জোটের কাছে লিখিত মতামত দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। তারা সেটি দিয়েছে। এর বাইরেও আরও কিছু রাজনৈতিক দল তাদের লিখিত মতামত দিয়েছে।
কাজের যে অগ্রগতি, তাতে কি আপনারা নির্ধারিত ৭ জানুয়ারির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবেন বলে আশা করছেন?
আলী রীয়াজ: আমরা আশা করছি, খসড়া আকারে হলেও ৭ জানুয়ারির মধ্যে আমাদের প্রতিবেদন দিতে পারব। আমাদের দায়িত্ব দুটি। প্রথমটি হলো সংবিধান পর্যালোচনা করা। আমরা এটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেছি। আমরা কী করতে চাই, তা যদি বুঝতে চাই, তাহলে বিদ্যমান সংবিধানের ত্রুটি ও শক্তিগুলো প্রথমেই চিহ্নিত করা দরকার। পর্যালোচনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশসহ ১২১টি দেশের সংবিধান আমরা পর্যালোচনা করেছি।
সংবিধান তো একটি রাজনৈতিক দলিল। বাহাত্তর সালে এই দলিল তৈরি হওয়ার একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। সেই পটভূমিটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। শুধু বাহাত্তরকে আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি না, বাহাত্তরের সংবিধান যেখানে এসে তৈরি হয়েছে, সেখানে এ জনপদের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম আছে। এটি কেবল ’৪৭ সাল থেকে নয়, তারও আগে উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের একটি দীর্ঘ পটভূমি আছে। আমরা সংবিধান পর্যালোচনায় এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছি। সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়াটি কী ছিল, তখনকার রাজনৈতিক সমালোচনা, সেগুলো দেখেছি।
বাহাত্তর থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সংবিধানে যে সংশোধনীগুলো হয়েছে, সেগুলো আমরা পর্যালোচনা করেছি, মূলনীতিগুলোও পর্যালোচনা করেছি। পর্যালোচনার অংশটাকে আমরা এমন গুরুত্ব দিয়েছি, তার কারণ হলো আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এর প্রেক্ষাপটটা বুঝতে হবে। আমাদের কাজের দ্বিতীয় অংশ, মানে সুপারিশ তৈরির জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।
জনগণ প্রধান অংশীজন; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তো এ ক্ষেত্রে প্রভাবক শক্তি। রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবগুলো নিয়ে আপনাদের উপলব্ধি কী?
আলী রীয়াজ: আমাদের উপলব্ধি হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো সার্বিক পরিস্থিতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। আমি এখানে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমরা তাদের কাছ থেকে লিখিত যে প্রস্তাবগুলো পেয়েছি, তার অধিকাংশ, সম্ভবত সবগুলোই গভীরভাবে বিবেচনা করে দেওয়া। প্রতিটি অনুচ্ছেদ লক্ষ্য করে তারা প্রস্তাবগুলো দিয়েছে। অকস্মাৎ এই প্রস্তাব তারা দিয়েছে, আমাদের পড়ে সেটি মনে হয়নি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে—এই প্রস্তাবগুলো, রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ, আন্তরিকতার যেমন বহিঃপ্রকাশ, আবার সংবিধান প্রশ্নে সুস্পষ্টভাবে তাদের অবস্থানকেও নির্দেশ করে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক একটি বিষয়। তারা ভেবেছে, চিন্তা করেছে, বিবেচনা করেছে, এরপর প্রস্তাব দিয়েছে। এই লিখিত প্রস্তাবগুলো দলিল হিসেবে থাকবে। ব্যক্তি, সংগঠন, নাগরিক সমাজ, তরুণ বুদ্ধিজীবী, ওয়েবসাইটের মতামতসহ অন্যান্য প্রস্তাব ও মতামত আমরা নথিভুক্ত করেছি।
এর পাশাপাশি আমরা একটি জরিপ করেছি। সেখানে ৪৬ হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। আমরা একপর্যায়ে এসব দলিল, নথি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেব, যাতে মানুষ জানতে পারে, এখানে আমরা কী করেছি। ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান সংবিধান নিয়ে মানুষের মধে৵ যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেই আকাঙ্ক্ষার দলিল থাকা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবকে কতটা বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়েছে? বাংলাদেশের বাস্তবতাকে তারা কতটা বিবেচনায় নিয়েছে?
আলী রীয়াজ: আমাদের কাছে মনে হয়েছে, তারা সেটা বিবেচনায় নিতে পেরেছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একটি ভাবাদর্শ থাকে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। সেটি তাদের গাইড করবে, তাড়িত করবে, সেটি তারা অর্জন করতে চাইবে, এটিই তো স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের যে বাস্তবতা, তার মধ্যেই তারা আছে; কিন্তু আমরা যখন পরিবর্তনের কথা বলি, যখন স্বপ্নের কথা বলি, আকাঙ্ক্ষার কথা বলি—সেটিকে শুধু আজকের বাস্তবতা দিয়ে বিবেচনা করা যায় না। অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, মানুষ একটি স্বপ্ন দেখছে। আমরা অনেকেই বলছি, প্রস্তাবগুলো বাস্তবোচিত হওয়া উচিত; কিন্তু স্বপ্ন না থাকলে, পরিবর্তন আসবে কী করে। পরিবর্তনের সুযোগ তো প্রতিদিন আর আসে না।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেওয়ার পর, আপনাদের ভূমিকা কী হবে?
আলী রীয়াজ: কমিশনের যে কাজের পরিধি, তাতে সুপারিশগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের কাজ শেষ হবে। এরপর একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হবে, সেটি কত দূর, কখন বাস্তবায়িত হবে। আমি যেভাবে দেখি, সেটি হলো, এই প্রক্রিয়ার দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে কী, আরেকটি হচ্ছে কীভাবে। আমরা কী-এর দায়িত্বে আছি, কীভাবে হবে সেটি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব। সেখানে আমাদের কমিশনের যদি কোনো ভূমিকা রাখার দরকার হয়, তা আমরা করব। কমিশনের সদস্যরা এ কাজকে তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখার সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ।
কমিশনে কাজ করার মধ্য দিয়ে আপনার একটি অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে। আপনি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও। পরের যে প্রক্রিয়াটা, বাংলাদেশের জন্য কোনটা উপযোগী হতে পারে, সে সম্পর্কে আপনি কি সরকারকে কিছু বলবেন?
আলী রীয়াজ: কমিশনের প্রধান হিসেবে আমি এটি বলব না। আপনারা যেহেতু আমার পেশাগত বিষয়টিকে বিবেচনায় নিচ্ছেন, সেখান থেকে আমি বলব যে এটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ঐকমত্য তৈরি করতে হবে। সেটি আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই করতে হবে। প্রাসঙ্গিকভাবে বলি, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা, রাজনৈতিক দলের দেওয়া প্রস্তাব—সব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমি দেখতে পেয়েছি, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঐকমত্যের জায়গাটা বেশি। অথচ আমাদের মধ্যে যতটুকু মতপার্থক্য, সেটিকে আমরা অনেক বড় করে ফেলি। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে তো ভিন্নমত থাকবেই।
আমাদের সমাজ বহুত্ববাদী সমাজ। দীর্ঘদিন ধরেই এটি একটি বিতর্কপ্রিয় সমাজ। আমরা বিতর্ক করে অভ্যস্ত; কিন্তু আমি আমাদের মধ্যে ঐকমত্যের জায়গাটাই অনেক বেশি দেখি। ফলে পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরুর আগে এই ঐকমত্যের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা দরকার। সেটির একটি তালিকা করে তার ওপর ভিত্তি করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একসঙ্গে কিংবা আলাদা আলাদা করে সরকার বসতে পারে। ঐকমত্যের জায়গাগুলোকে যদি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা খুব কঠিন কাজ নয়। হ্যাঁ, অকস্মাৎ সেটি হয়ে যাবে কিংবা আমরা একদিন বসে ঐকমত্যে পৌঁছে যাব, সেটা আমি বলছি না; কিন্তু আমি আশাবাদী।
ঐকমত্য তৈরি হলে একটি দলিল তৈরি করা যেতে পারে। তার ভিত্তিতে নির্বাচন হতে পারে। গণভোট দিয়েও সেই ঐকমত্যকে জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নেওয়া যেতে পারে। প্রক্রিয়াটা কী হবে, তা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বের করতে হবে। চূড়ান্ত বিচারে রাজনীতিবিদদের দেশটাকে চালাতে হবে। এত বড় একটি আন্দোলন হলো, এতগুলো মানুষের মৃত্যু হলো, এটি এক দিনে হয়নি, এর পটভূমি ৩৬ দিনেও রচিত হয়নি। ১৫-১৬ বছরের একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসন মোকাবিলা করে মানুষ এটি অর্জন করেছে। এর পরের কাজটা রাজনীতিবিদদের।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনা, দর–কষাকষির সময় আপনাদের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকছে কি?
আলী রীয়াজ : এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রাখতে চাইছেন। সেই বিবেচনায় আমাদের অবশ্যই ভূমিকা থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলাপ-আলোচনার জন্য যদি কোথাও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দরকার হয়, তা অবশ্যই আমরা দেব। শুধু আমাদের কমিশন নয়, আমার বিশ্বাস, অন্য কমিশনগুলোরও সেই প্রস্তুতি রয়েছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় অলিখিতভাবে কমিশনের একটি ভূমিকা থেকেই যাচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস ছয়টি কমিশনের প্রধানদের নিয়ে এরই মধ্যে ঐকমত্য কমিশন তৈরি করার ঘোষণা দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ক্ষেত্রে আমি কোনো পার্থক্য দেখতে পাই না। এখানে মূল কাজটা হলো পথটা বের করা। অন্যান্য আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুই পক্ষের মধ্যে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে না। ফলে পথ বের করার কাজটা সহজ।
আপনারা একটি প্রতিবেদন দেবেন, সুপারিশ দেবেন; কিন্তু সংবিধান রচনার কাজটি কীভাবে হবে? বাহাত্তরের সংবিধানটা কি বাতিল হয়ে যাবে, নাকি সংস্কার হবে, নাকি পুনর্লিখন করা হবে। আপনি এর আগে সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলেছিলেন।
আলী রীয়াজ: বাংলাদেশের সংবিধান এরই মধ্যে দুইবার পুনর্লিখিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে যে সংবিধান তৈরি হয়েছিল, সেটি কি বাহাত্তরের সংবিধান? সংসদে দাঁড়িয়ে, ম্যান্ডেট ছাড়াই (তিয়াত্তরের নির্বাচনে সংবিধান সংশোধন হবে, সেই ম্যান্ডেট আওয়ামী লীগ নেয়নি) সেটি করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সংবিধান পুনর্লিখিত হয়েছে। পুনর্লিখন শব্দটা শুনলে যাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, তাঁদের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ করব, বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাসটা ভালো করে দেখুন। সংবিধান পুনর্লিখন খুব বিপজ্জনক বিষয় নয়। তার কারণ হলো, সংবিধান কোনো ঐশী বাণী নয়। সংবিধান জনগণের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার দিকনির্দেশনা।
আমাদের সুপারিশগুলোর সবটা গ্রহণ করা হবে, তা আমরা মনে করি না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এর অনেকগুলো গৃহীত হবে, অনেকগুলো বাতিল হবে। গৃহীত সুপারিশগুলো কী প্রক্রিয়ায় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তা খসড়া তৈরির বিষয়। এটি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা করবেন। কিংবা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে বসে এটি করতে পারে। যেখানে প্রয়োজন হবে, সেখানে তারা পুনর্লিখন করবে।
এখনই কিছু কিছু বিষয়ে কিন্তু সাধারণ একটি ঐকমত্য তৈরি হয়ে গেছে। যেমন ধরুন, ক্ষমতার এককেন্দ্রিক করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টা সংবিধানে আনতে হবে। এখন ভারসাম্য কথাটার নানা ব্যাখ্যা থাকতে পারে। ফলে সংবিধানের কোথাও না কোথাও বদলাতে হবে, কোথাও না কোথাও নতুন করে লিখতে হবে। এখন এটিকে সংশোধন বলুন আর পুনর্লিখন বলুন, তাতে কিছু যায় আসে না। মূল বিষয়টা হচ্ছে, সংবিধান নিয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হচ্ছে কি না।
সংবিধানের এই খসড়া তৈরির কাজটা কি নির্বাচনের আগে হবে, নাকি পরে হবে বলে আপনার মনে হয়। এটি নিয়ে মানুষের মধে৵ কৌতূহল আছে, আবার বিভ্রান্তি আছে।
আলী রীয়াজ: আমি ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়টিকে এভাবে দেখি, রাজনৈতিক ঐকমত্য যখন তৈরি হবে, তখন একটা পথও বেরিয়ে আসবে। যেমন: একটি পথ হতে পারে সংবিধান সভা। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে, তাহলে সংবিধান সভা হতে পারে। আবার রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে, তারা এ ব্যাপারে একটি সনদ তৈরি করে নির্বাচন করবে এবং পরবর্তী সংসদে সুপারিশের ভিত্তিতে সংবিধান পুনর্লিখন কিংবা পরিবর্তন করবে; সেটিও হতে পারে। নির্বাচনের আগে এটি করা হোক, আর পরে করা হোক না কেন, একটি গণভোট করতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে গণভোটের পক্ষে। কারণ, এর জন্য জনগণের ম্যান্ডেট দরকার। একটি জাতি এই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছে, সুতরাং তাদের কাছ থেকে অবশ্যই অনুমোদন নিতে হবে।
নির্বাচন হয়ে গেলে ক্ষমতায় যাওয়া রাজনৈতিক দল যে সুপারিশ অনুযায়ী সংবিধানের পরিবর্তন আনবে, তার নিশ্চয়তা কী? এখানে যদি একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, সেটি ঠেকানোর পথ কী?
আলী রীয়াজ: আমি এখানে বিশৃঙ্খলা শব্দটি বলতে চাই না, অনিশ্চয়তা বলতে পারি। রাজনীতি অনিশ্চয়তার ব্যাপার। এখানে দুটি সমাধান আছে। একটি হচ্ছে সংবিধান সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার, বিচার বিভাগের সংস্কার, জনপ্রশাসনের সংস্কার; এগুলোর ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো যদি একমত হয় এবং তারা যদি একটি সনদ তৈরি করে, সেটি হবে জাতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি চুক্তি। এত প্রাণের বিনিময়ে মানুষের মধে৵ যে বিশাল আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংগতিপূর্ণ আচরণ না করে, তাহলে তারও তো একটি জবাবদিহির জায়গা দরকার হবে। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, আমাদের অতীত ইতিহাসে ব্যর্থতা আছে, তার কারণে আমরা শঙ্কিত হই। শঙ্কিত হওয়াটা ঠিক আছে, সেটি ভালোও; কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, শঙ্কার জায়গাটা এখানে প্রধান নয়।
আমাদের জাতির সামনে অভাবনীয় একটি ঘটনা ঘটে গেছে। বাংলাদেশের মানুষই এই অসাধ্য সাধন করেছে। এটি কিন্তু একবার আমরা করিনি। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান, সময় বিবেচনায় কাছের ঘটনা। আমরা এর আগে একাত্তরে সেটি করেছি, নব্বইয়েও করেছি। আমরাই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার মতো একধরনের ব্যবস্থা করতে পেরেছি; যেটা কোথাও ছিল না। আমাদের বাস্তবতা থেকে আমরা সেই পথ বের করেছি।
রাজনীতিবিদদের আমরা সমালোচনা করব; কিন্তু তাঁরা অনেক কিছু করেছেন, সেই স্বীকৃতিটা তাঁদের আমাদের দিতে হবে। আমি অনিশ্চয়তা দেখতে পাই; কিন্তু আশাবাদীও হতে চাই একাধিক কারণে। প্রথমটি হলো, এটি ২০২৪-এর বাংলাদেশ, এটি ১৯৯০-এর বাংলাদেশ নয়। দ্বিতীয়টি হলো, আমাদের রাজনীতিবিদেরা যে পারেন, সেটি তারা অতীতে দেখিয়েছেন।
আন্দোলনে ছাত্ররা ছিল, রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে মধ্যপন্থী, বামপন্থী সবগুলো পক্ষ ছিল। শেখ হাসিনাকে সরানোর ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে একটি সাধারণ ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল। অভ্যুত্থানের পর দেখছি, একটি বিভেদ তৈরি হয়েছে। সবারই নির্দিষ্ট ভাবনা আছে, রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে। এ অবস্থায় মৌলিক বিষয়গুলোতে জাতীয় ঐকমত্যের ব্যাপারে কতটা আশাবাদী হওয়া যায়?
আলী রীয়াজ: এটি সত্যি যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, নাগরিক সমাজের মধ্যে, ছাত্রদের মধ্যে বিভক্তি আছে; কিন্তু আমি দেখতে চাই, তাদের মধ্যে কোথায় কোথায় একমত আছে। তাদের মধ্যে একমতের জায়গা হচ্ছে, তারা আর ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ হতে দেবে না, এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা তারা চায়, যেখানে নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা পাবে, এমন একটি মানবাধিকার পরিস্থিতি সবাই চায়, যেখানে গুম হবে না, বিচারবহির্ভূত হত্যা হবে না। এই একমতের জায়গা দিয়েই আমরা শুরু করতে পারি। আমি যখন জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলছি, আমি তখন নিশ্চয়ই উত্তর কোরিয়া হওয়ার কথা বলি না।
সংবিধান সংস্কার কমিশনে যুক্ত হয়ে আমার নিজের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে, শাসন প্রশ্নে এ দেশের মানুষের আকাঙক্ষা খুব স্পষ্ট, খুব সহজ। এটি খুব যে বড়, তা কিন্তু নয়। তারা যে রাষ্ট্র ওলটপালট করে দিতে চাইছেন, তা–ও কিন্তু নয়। এই সামান্য চাওয়াটা যেমন রাজনীতিবিদদের চাওয়া, আবার সাধারণ মানুষেরও চাওয়া। শাসন প্রশ্নে মানুষের এই ঐকমত্যের জায়গাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি বারবার ঐক্যমতের কথা বলছেন। অংশীজনদের প্রস্তাবে সুনির্দিষ্টভাবে কোন কোন জায়গায় সেটি খুঁজে পেয়েছেন, ব্যাখ্যা করবেন কি?
আলী রীয়াজ: ঐকমত্যের জায়গাটাকে আমি দেখতে চাই, মানুষ আসলে কী চায়, সেই বিবেচনা থেকে। মানুষ চায় এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে নাগরিক হিসেবে তার অধিকারটা সুরক্ষিত থাকবে। এর প্রকাশটা কীভাবে হচ্ছে? তারা বলছে, বিচার বিভাগটা আলাদা করে দেন। কেন বলছে তারা এটি? বলছে কারণ হলো, তারা যদি বিপদে পড়ে, তাহলে কার কাছে যাবে? নির্বাহী বিভাগ তার কথা শুনল না, তাহলে তারা কার কাছে যাবে। তারা বলছে, ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ বন্ধ করেন। কেননা, ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ হলে তার কথা শোনা হয় না। তার মানে তারা জবাবদিহি চায়।
জবাবদিহি চাইতে গিয়ে তারা বলছে, স্থানীয় সরকারেও সংস্কার করেন, যাতে করে তার প্রতিনিধি যেন নির্বাহী বিভাগ দিয়ে পরিচালিত না হন। আমরা তো সবকিছু বড় পটভূমি থেকে দেখতে চাই; কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের কাতারে নেমে এভাবে ছোট ছোট প্রত্যাশার আকারে এগুলো দেখুন। আমরা এটিকে বড় করে বলছি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হোক; কিন্তু মানুষ একটিই জিনিস চায়, সেটি হলো সুবিচার। যেমন তারা বলছে বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের কথা। এটি বলছে এ কারণে নয় যে তারা তাদের বিভাগে বিচার বিভাগের বিল্ডিং দেখতে চায়। তারা দেখছে যে বিচারের জন্য ঢাকায় দৌড়াতে দৌড়াতে তারা ফতুর হয়ে যাচ্ছে। তারা এখান থেকে নিষ্কৃতি চায়। নির্বাচন প্রশ্নে তারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কথা বলছে। কেন বলছে সেটা? কারণ, তারা ভোট দিতে চায়।
আমাদের সংবিধান ভাষাগতভাবে বেশ কঠিন। ফলে এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব আছে। সংবিধানকে তারা একটি জটিল বিষয় মনে করে। সংবিধান তাদের কোন অধিকার দিয়েছে, সেটি তারা অনেক ক্ষেত্রে জানেও না। আপনারা কি মানুষ যেভাবে বোঝে, এমন ভাষায় সংবিধান লেখার সুপারিশ করবেন?
আলী রীয়াজ: হ্যাঁ, আমরা সংবিধানের ভাষা সহজ করার জন্য সুস্পষ্ট সুপারিশ দেব। অধিকাংশ অংশীজন আমাদের বলেছেন, সংবিধানটা ছোট করেন, সহজ করেন। তাঁরা বলেছেন, আমাদের কোন অধিকার আছে, সেটি আমাদের বুঝতে দিন। যাতে সেটি লঙ্ঘিত হলে আমরা কোথাও যেতে পারি, বলতে পারি। সংবিধান পড়ে যাতে তাঁরা বুঝতে পারেন, কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে তাঁরা মানবাধিকার কমিশন, বিচার বিভাগ, সংসদীয় কমিটি কোথায় যাবেন। সংবিধানে সেটি অবশ্যই বলে দিতে হবে। তাঁরা চান এই দলিল যেন তাঁদের সুরক্ষা দেয়।
সংবিধান কমিশনের ব্যাপারে একটি বড় সমালোচনার জায়গা—এই কমিশনে ধর্মীয়, জাতিগত ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর প্রতিনিধি নেই। আপনারা এ সমালোচনার কী উত্তর দেবেন? আপনারা কি কমিশনে তাঁদের ডেকেছিলেন?
আলী রীয়াজ: প্রথম কথা হচ্ছে, সংবিধান সংস্কার কমিশনে সদস্যদের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্য যেভাবে থাকার কথা ছিল, সেটি নেই। এটি আমাদের দুর্বলতা। এটিকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই; কিন্তু আমাদের কমিশন জাতিগত, ধর্মীয় ও অন্যান্য বিবেচনায় সংখ্যালঘু যাঁরা, তাঁদের অংশীজন ভাবেনি, সেটা নয়। আমরা মনে করেছি, তাঁদের কথা শোনা আমাদের নিশ্চিত করা দরকার। কারণ, বাংলাদেশ তাঁদেরও। আমরা দলিত সমাজের প্রতিনিধিদেরও ডেকেছি তাঁদের কথা শোনার জন্য। আমরা যে বহুত্ববাদিতার কথা বলছি, সেটি শুধু কথার কথা নয়। আমরা যত দূর সম্ভব তাঁদের সবার কথা শুনতে চেষ্টা করেছি।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আলী রীয়াজ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।