জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসকের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো। এই সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?
ফয়জুল হাকিম: আমরা মনে করি, অভ্যুত্থানটি শেষ হয়ে যায়নি। এটি চলমান। জনগণ নজর রাখছে অন্তর্বর্তী সরকার কী করছে, অন্তর্বর্তী সরকার আগের কালো আইনগুলো বাতিল করছে কি না, গণহত্যাকারীদের বিচার হচ্ছে কি না, লুটেরাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হচ্ছে কি না ইত্যাদির ওপর। একই সঙ্গে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে যে ভারতীয় আধিপত্য শক্তির প্রভাব, সেটা হ্রাস পাচ্ছে কি না, তা–ও জনগণ দেখতে চাইবে।
গত দুই মাসে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন কি?
ফয়জুল হাকিম: অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো আদালতের অনুমোদন নিয়ে। অর্থাৎ পুরোনো ধারাতেই তারা চলল। এখন পর্যন্ত গণ–অভ্যুত্থানে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাই হলো না। আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে গিয়েছি। তারা জানিয়েছে, সরকারের কোনো লোক তাদের কাছে যাননি, খোঁজখবর নেননি। আশা করব, সরকার অবিলম্বে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করবে। একই সঙ্গে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে।
এটা খুবই হতাশাজনক যে আহত ব্যক্তিদের অনেকে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার পাশাপাশি নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে পুনর্বাসন করাও সরকারের দায়িত্ব। শ্রমিকেরা বহু বছর ধরেই বঞ্চিত ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার তাঁদের ১৮ দফা দাবি মেনে নিয়েছে। তবে মালিকেরা সেটি বাস্তবায়ন করছেন কি না, সে বিষয়ে নজরদারি কম।
গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে নিয়ে যেতে সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। আপনাদের পর্যবেক্ষণ কী?
ফয়জুল হাকিম: ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশে শাসকশ্রেণি যেভাবে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে, যেভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে, জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও অবাধ লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম করেছে, এসবের আমূল পরিবর্তন সংস্কারের মাধ্যমে সম্ভব বলে মনে করি না। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিশনগুলো কী প্রস্তাব দেয়, তা দেখার অপেক্ষায় আছি। সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থান কেবল সাবেক স্বৈরাচারকে উচ্ছেদ করেনি, বিদ্যমান সংবিধানকেও নাকচ করেছে। আমাদের দাবি, নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করতে হবে।
তাহলে সংস্কার কমিশনগুলোর কাজ কী হবে?
ফয়জুল হাকিম: তারা যেকোনো বিষয়ে সুপারিশ করতে পারে। মূল কাজটা করবে জনগণের নির্বাচিত সংবিধান সভা। সংবিধান সংস্কারের এখতিয়ার কোনো কমিশন বা অনির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের থাকার কথা নয়। আমরা মনে করি, গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটি নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এর জন্য গণবিপ্লব জরুরি।
সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক চলছে। আপনাদের অবস্থান কী?
ফয়জুল হাকিম: অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু কোনো বিপ্লবী পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে না, সেহেতু নির্বাচন ও সংস্কারকাজ একসঙ্গে চলতে পারে। নির্বাচন দেরি হলে নানা সমস্যা তৈরি হবে। আমাদের প্রথম প্রশ্ন, অন্তর্বর্তী সরকার ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে কি না?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে, তারা বৈষম্যের বিলোপ চায় কি না? কৃষক–শ্রমিকসহ প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা যেমন বর্তমান সংবিধানে নেই, তেমনি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকারও স্বীকৃত নয়। আগামী দিনে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরা যদি এসব বিষয়ে মৌলিক সংস্কার না করেন, মানুষ আবার রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন।
সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থানের পর স্বৈরাচারী শাসকের পতন হয়েছে, এটা আশার দিক। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে—যেমন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মানুষের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রচার ইত্যাদি।
ফয়জুল হাকিম: গণ–অভ্যুত্থানের বিজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারচর্চার একটা পরিসর তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিজেদের চিন্তা সমাজে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা নানা রকম চক্রান্ত করছে।
সমাজ ও রাষ্ট্রে যে বৈষম্য আছে, এসব সংস্কারে তার কতটা অবসান হবে বলে মনে করেন? আপনারা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনে কোনো প্রস্তাব পাঠাবেন কি?
ফয়জুল হাকিম: বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুটিকয় মানুষের হাতে ব্যাপক ধনসম্পদ পুঞ্জীভূত। অন্যদিকে সমাজের বৃহত্তর অংশ বঞ্চিত। এ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না করে শ্রমিক ও কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে আমরা জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের পক্ষে ১০ দফা জরুরি দাবি পেশ করেছিলাম। এতে নতুন সংবিধানের জন্য নতুন সংবিধান সভার প্রয়োজনীয়তার কথা আছে। আমরা কমিশনে আলাদা করে প্রস্তাব পাঠাব না। জনগণের কাছে আমাদের আহ্বান ও প্রস্তাব নিয়ে যাব।