বিশেষ সাক্ষাৎকার: মাহবুবউল্লাহ 

উসকানিমূলক বক্তব্য নয়, কোনো অঘটন চাই না

আজ ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিরোধী দল বিএনপির মহাসমাবেশ, সরকারও পাল্টা কর্মসূচি ডেকেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কা ও জনমনে নানা প্রশ্ন নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুবউল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব

প্রশ্ন:

আজ ২৮ অক্টোবর সরকার ও বিরোধী দুই পক্ষেরই কর্মসূচি। ১৭ বছর আগে দেশের রাজনীতির জন্য ঘটনাবহুল দিন ছিল এটি। একই দিনে আজকের এই কর্মসূচিকে কীভাবে দেখছেন?

মাহবুবউল্লাহ: ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছিল, তা টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছিল, সেই দৃশ্য দেখে গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দল ও বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের আহ্বানে ঢাকায় লগি-বইঠার সমাবেশ হয়েছিল। সেদিন সেই নৃশংসতার ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাবহুল দিনটির কথা মনে রেখে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কথা ও আচরণে দায়িত্বশীল হতে হবে। সেখানে যাতে উসকানিমূলক কিছু না থাকে। আজকে আরেকটি ২৮ অক্টোবর আমাদের সামনে এসেছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, অতীতের মতো আজকেও কোনো বিয়োগান্ত বা বেদনাদায়ক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে কি না? একই দিন হলেও, পরিপ্রেক্ষিতও কিছুটা মিল থাকলেও, আমি মনে করি বিজ্ঞান সে কথা বলে না। আজকের দিনের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ ও স্বস্তিদায়কভাবে শেষ হবে। কারণ, দুই পক্ষই শান্ত থাকতে চাইছে।

প্রশ্ন:

কিন্তু একই দিনে দুই পক্ষের কর্মসূচির কারণে জনমনে নানা শঙ্কা কাজ করছে

মাহবুবউল্লাহ: যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা মনে করছেন, বিরোধী দল একা মাঠে নেমে কর্মসূচি পালন করলে জনগণ মনে করতে পারে তঁাদের শক্তি ফুরিয়ে গেছে। এমন চিন্তা থেকে মাঠে সরকারদলীয় পাল্টা কর্মসূচি আমরা দেখছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পাল্টাপাল্টি করে কি রাজনৈতিক লড়াইয়ে জয়ী হওয়া সম্ভব? আসলে তা সম্ভব না। সেটি নির্ভর করে দলের কর্মসূচি কী, অতীতে কী কর্মকাণ্ড ছিল এবং ভবিষ্যতে কেমন থাকবে, দেশ পরিচালনায় কতটা গণতান্ত্রিক আচরণ ছিল বা গণতান্ত্রিক নৈতিকতা কতটা মানা হয়েছে, তার ওপর। জনগণ কিন্তু এভাবেই মূল্যায়ন করবে। আমি বলব, রাজনীতিতে এ ধরনের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি উত্তেজনাকর ও ক্ষতিকর। সবাই শান্ত থাকতে চাইছে। কিন্তু বলা তো যায় না, বিশাল জনসমাবেশের মধ্যে মাত্র কয়েকজন লোকের অনভিপ্রেত কাজ বা কথার জন্য বড় ধরনের অঘটন ঘটে যেতে পারে। এ কারণেই পাল্টাপাল্টি যে কর্মসূচির ধারা আজকে চালু হয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত।   

প্রশ্ন:

আপনি বলছেন, দুই পক্ষই শান্ত থাকতে চাইছে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে উত্তেজনাকর বক্তব্য আমরা শুনতে পাচ্ছি।  

মাহবুবউল্লাহ: দুই পক্ষই নিজেদের মধ্যে নিশ্চয়ই চিন্তাভাবনা করবে সহিংসতায় জড়ালে সেটির প্রাপ্তি বা ফল তাদের জন্য কী হতে পারে। সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ আছে এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তাতে এটিই স্পষ্ট হচ্ছে, আন্দোলন হবে কিন্তু তা সহিংস হতে পারবে না। তবে গণরাজনীতিতে অনেক সময় মানুষ জেনেবুঝে বা পরিকল্পনা নিয়ে সহিংসতা করে না, এটি হঠাৎ যেকোনো একটা কিছু থেকে ঘটে যায় এবং ছড়িয়ে পড়ে। তারপরও শান্তিকামী নাগরিক হিসেবে আমি আশা করব, রাজনৈতিক নেতারা এমন বক্তব্য দেবেন, যাতে ভয়াবহ কোনো পরিস্থিতি বা নেতিবাচক কিছু না হয়।   

প্রশ্ন:

সরকার তো সংবিধান মেনে নির্বাচন করার ব্যাপারে অটল। বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে, তাহলে দেশ কি আবারও একতরফা নির্বাচন দেখবে? 

মাহবুবউল্লাহ: এটি ২০১৪ সালও না, ২০১৮ সালও না। এর মধ্যে নদীতে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। মানুষও অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। কাজেই এখানে আমার মনে হয়, অতীতে যা করে সাফল্য পাওয়া গিয়েছিল অর্থাৎ সঠিকভাবে ভোটপ্রক্রিয়া না করেই সরকার গঠন হয়েছে, এবার মনে হয় সেটি করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের উন্নয়নের যারা অংশীদার, তাদের নজরদারি থাকবে আমাদের রাজনীতির ওপর। তাদের নজরদারিকে গুরুত্বহীন মনে করার কোনো কারণ নেই। 

প্রশ্ন:

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বেশ তৎপর। তাদের এই ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন? 

মাহবুবউল্লাহ: আমরা একসময় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক এমন স্লোগান দিয়েছি। দুনিয়ার দেশে দেশে তাদের কর্মকাণ্ডকে নিন্দাজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়েছিল। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সমালোচনা করেছি, এখনো হয়তো করব। কিন্তু আবার দেখতে হবে, রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতটা কী? বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির বড় একটি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। আরও অন্যান্য অনেক কিছু স্বার্থ তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। আমাদের এলিট শ্রেণি তাদের ছেলেমেয়েদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয় উচ্চশিক্ষার জন্য। ফলে এই এলিট শ্রেণিও কালচারালি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। তো সব ধরনের নির্ভরশীলতা মিলিয়ে যেটি বেরিয়ে আসে, যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আমাদের সমালোচনা থাকতে পারে, তাদের কর্মকাণ্ডকে আমরা হস্তক্ষেপ বলতে পারি, কিন্তু যে বাস্তবতা এখন তৈরি হয়েছে, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।    

প্রশ্ন:

 আপনি বলছেন সামনের নির্বাচন পূর্ববর্তী দুই নির্বাচনের মতো করা সম্ভব হবে না। তাহলে কি সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করছেন আপনি?  

মাহবুবউল্লাহ: আমাদের রাজনীতির বড় একটি সমস্যা হচ্ছে আস্থাহীনতা। নির্বাচন তো হয় একটি রাষ্ট্রের কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। সেখানে পুলিশসহ নানা নিরাপত্তা বাহিনী, আমলাতন্ত্র—এগুলো কী অবস্থায় আছে বা কীভাবে চলছে, তার ওপরে নির্ভর করবে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে বা আদৌ সুষ্ঠু হবে কি না। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে, নতুন দামি গাড়ি দেওয়া হচ্ছে, এগুলো প্রকারান্তরে ঘুষ দেওয়া। নির্বাচনের ফলাফলকে সরকার নিজেদের পক্ষে নিশ্চিত করতে এসব করা হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে আমাদের রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় সমঝোতা দরকার। আমি সব সময় বলি, আমাদের রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় যেসব প্রশ্ন, সমস্যা বা বিরোধগুলো রয়েছে, সেগুলোর মীমাংসার জন্য নতুন করে একটা সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা সামাজিক চুক্তির দিকে আমাদের যেতে হবে। আমাদের ব্যাপক আকারে গণতান্ত্রিক সংলাপের মধ্যে যেতে হবে। এবারের নির্বাচন সামনে রেখে হয়তো সেটি করা সম্ভব হবে না, কিন্তু আজ বা কাল হোক, সেটি আমাদের করতে হবে।   

প্রশ্ন:

বিএনপি এক–দেড় বছর ধরে সভা-সমাবেশ করে আসছে। তারা কি শেষ পর্যন্ত সফল হবে বলে মনে করেন? 

মাহবুবউল্লাহ: মুক্তিযুদ্ধের আগে এখানে যে ধরনের রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল, স্বাধীনতার পর তেমনটি দেখা যায় না। সেসব অভ্যুত্থানে শুধু রাজনৈতিক কর্মীরা নয়, সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। যখন সাধারণ মানুষ একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেয়, তখন সেটা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে তার একটি নমুনা দেখা গিয়েছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে। এখন যেটি হচ্ছে প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিকভাবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তারা সভা–সমাবেশ বা মিছিল করছে, কিন্তু এটিকে যদি দূরবর্তী অবস্থানে যারা আছে, তাদের কাছে পর্যন্ত নিয়ে না নেওয়া যায় বা তাদের যুক্ত করা না যায়, তাহলে কিন্তু পরিবর্তনটা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। এখন বিএনপির বাইরে লোক, যারা এসব সমাবেশে গেছে, তাদের কাছ থেকে শুনি, সেখানে দলীয় লোকের বাইরেও মানুষ অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু আমার মনে হয়, এই অংশগ্রহণ যথেষ্ট নয়। আরও ব্যাপকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা প্রয়োজন।  

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মাহবুবউল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।