২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

নির্বাচন বর্জন করে লাভ হবে না বিএনপির

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য বিরোধ চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগীরা মনে করে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। বিএনপি ও এর সহযাত্রীদের মতে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হতে হবে। এ বিরোধের মীমাংসা কী, এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর-রশিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসানরাফসান গালিব

ড. হারুন-অর-রশিদ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে একটি সংকট চলছে। উত্তরণের উপায় কী?

হারুন-অর-রশিদ: আমি মনে করি, নির্বাচন নিয়ে দেশে কোনো সংকট নেই। বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছে, যা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া না হওয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যের একটি সম্পর্ক আছে। আশা করি, সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে, সেখানে বিএনপিও থাকবে। ২০১৪ সালে বিএনপির নির্বাচন বর্জন ছিল আত্মঘাতী।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বিএনপি তো ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, তারপরও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। দিনের ভোট রাতে হওয়ার অভিযোগ আছে। মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আগামীবার যে তারা ভোট দিতে পারবে, এর নিশ্চয়তা কী?

হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলে রাজনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে। ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও নেতৃত্বের সংকট ছিল। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচিত হয়েও শপথ নিতে পারেননি। লন্ডন থেকে তাঁকে পদত্যাগ করতে বলা হলো। তিনি সংসদে থাকলে দলের কথা আরও জোরালোভাবে বলতে পারতেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বিএনপি যদি দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে না যায়, কী পরিস্থিতি তৈরি হবে?

হারুন-অর-রশিদ: একতরফা নির্বাচন হবে। আর একতরফা নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু হয় না। তাই বলব, বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার বিকল্প নেই। নির্বাচনে গিয়েই তাদের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে হবে। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছে, কিন্তু এর পক্ষে তো মানুষকে মাঠে নামাতে পারছে না। এর অর্থ তাদের দাবির প্রতি জনগণের সমর্থন নেই।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বিএনপি বলছে, সরকার তাদের মতো করে একটি নির্বাচন করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চাইছে। ক্ষমতাসীনেরা চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক।

হারুন-অর-রশিদ: আওয়ামী লীগ না চাইলেও বিএনপির উচিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করা। জনগণ তাদের সঙ্গে থাকলে কেউ ভোটের ফল উল্টে দিতে পারবে না। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের সফরে অনেকেই উৎসাহিত হয়েছেন। কিন্তু আমি তো দেখছি এতে উৎসাহের কিছু নেই। বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা তো বিএনপির আমলে শুরু হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। তখন কি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেনি? বিদেশিদের চাপে নয়, গণতন্ত্র রক্ষার জন্যই একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বিগত কে এম নূরুল হুদা কমিশন ও বর্তমান কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন কি? তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় ডেকেছিল। বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা যায়নি।

হারুন-অর-রশিদ: আমরা তো অতীতের ভুল ও বিভিন্ন ঘটনা থেকে শিক্ষা নিই। দৃশ্যত বর্তমান কমিশন আগের কমিশন থেকে ভালো করছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী অল্প ব্যবধানে জিতেছেন। আপনি যে নির্বাচনী পরিবেশের কথা বলছেন, সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিলেই সেটি সম্ভব। একতরফা নির্বাচন হলে নয়। রাজনৈতিক সংকট দূর না হলেও আগামী নির্বাচন সামনে রেখে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে। নির্বাচন কমিশনের সংলাপে বিএনপির যাওয়া উচিত ছিল।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সমস্যাটি কি আদর্শগত না ক্ষমতার? আজ যারা বিএনপির সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে, তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গেও আন্দোলন করেছে নব্বইয়ের দশকে। কেউ কেউ আওয়ামী লীগ সরকারেও ছিল।

হারুন-অর-রশিদ: সমস্যাটি আদর্শগত ও ক্ষমতার—উভয়ই। ক্ষমতার জন্যই মানুষ রাজনীতি করে। কিন্তু ক্ষমতার জন্য আদর্শকে বাদ দেওয়া যাবে না। বিএনপি একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করেছে, মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী করেছে। তাঁদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক লড়াই তো থাকবেই। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পরও বিএনপি গত নির্বাচনে তাদের জোটসঙ্গী করেছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করার পরও কিন্তু সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেনি।

হারুন-অর-রশিদ: আমি মনে করি, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা উচিত।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আওয়ামী লীগ যদি নিজেকে এতই জনপ্রিয় মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে নির্বাচন দিচ্ছে না কেন?

হারুন-অর-রশিদ: কেন করবে? জনগণ তো এই দাবি সমর্থন করছে না। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসেনি। আর তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা তো বিএনপিই নষ্ট করেছে। পছন্দের বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করতে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মানলাম বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নষ্ট করেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ তো গত দুই নির্বাচনে প্রমাণ করতে পারেনি যে দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে।

হারুন-অর-রশিদ: আমি আগেও বলেছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক ভারসাম্য থাকা জরুরি। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় সেই ভারসাম্য নষ্ট হয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নির্বাচনী সংকট তো কাটেনি।

হারুন-অর-রশিদ: সংকট কাটাতে হলে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিরোধী দল যাতে সভা-সমাবেশ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে বিরোধী দলকেও বর্জনের নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে সংঘাত অনিবার্য। বর্জন দিয়ে যে কিছু অর্জন করা যায় না, ২০১৪ সালের নির্বাচনই তার প্রমাণ। ২০১৫ সালে তারা আন্দোলনের নামে দেশব্যাপী সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য চালিয়েছে। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হোক, কেউ চায় না। তাদের মনে রাখতে হবে, বাইরের কেউ এসে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না। জনগণের রায় নিয়েই ক্ষমতায় যেতে হবে। জনগণ ভোট দিতে না পারলে আন্দোলন গড়ে উঠবে। মানুষ মাঠে নামবে। কিন্তু ভোট বর্জন করলে সেটি হবে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছেন। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কি এর অন্তরায় নয়?

হারুন-অর-রশিদ: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তো কেবল বাংলাদেশে নেই, অনেক দেশেই আছে। আমি তো দেখছি, বাংলাদেশে সাংবাদিকেরা অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। ডিজিটাল মাধ্যমে যেসব অপরাধ হয়, তা রোধ করার জন্য এই আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রশ্ন হলো এই আইন অন্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না। তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যাতে বাড়াবাড়ি না হয়, নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার না হয়, সরকারকে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। নাগরিকদের যেমন দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, সরকারকেও সহনশীল হতে হবে। আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে অনেক দুর্বলতা আছে। রাতারাতি সেগুলো দূর করা যাবে না। ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

হারুন-অর-রশিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।