বিশেষ সাক্ষাৎকার: এ এম আমজাদ

কোটা আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ না ঢুকলে এমন পরিস্থিতি হতো না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের ফোরাম নীল দলের আহ্বায়ক এ এম আমজাদ। তিনি কথা বলেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রথম আলো:

১ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। কোনো রকম গোলমাল হয়নি। ছাত্রলীগ মাঠে নামার পরই ক্যাম্পাস পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর দায় কার?

এ এম আমজাদ: এটা আমারও প্রশ্ন। কোটা সংস্কারের দাবিতে যে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে, সেটা যৌক্তিক বলে মনে করি। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। সরকারও কোটা সংস্কার চায়। ছাত্রলীগও কোটা সংস্কারের পক্ষে। সংস্কার আন্দোলনের সুযোগে কিছু অশুভ এলিমেন্ট আন্দোলনকারীদের মধ্যে ঢুকে গেছে। তারাই পরিস্থিতি সংঘাত ও সহিংসতার দিকে নিয়ে গেছে।

প্রথম আলো:

কিন্তু ছাত্রলীগ মাঠে নামার পরই সংঘাত শুরু হলো। তারা যত দিন মাঠে ছিল না, তত দিন শান্তিপূর্ণভাবেই কর্মসূচি পালিত হলো।

এ এম আমজাদ: সোমবার সারা দিন আমি ক্যাম্পাসেই ছিলাম। কোটা আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি ছিল রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত। আর ছাত্রলীগের কর্মসূচি ছিল একই স্থানে বেলা ৩টা থেকে। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা জায়গা ছেড়ে দেয়নি। তাদের একটি অংশ বিজয় একাত্তর হলে গেলে ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় আন্দোলনকারীদের সমাবেশ থেকে উসকানিমূলক মাইকিং করা হচ্ছিল।

আমার ধারণা, কোটা সংস্কারের আন্দোলনটি যারা শুরু করেছিল, সেটি তাদের হাতে নেই। সেখানে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করেছে।

প্রথম আলো:

অতীতে দেখেছি, এ রকম সংঘর্ষ হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। শিক্ষকেরাও এগিয়ে আসেন। এবার শিক্ষকেরাও আন্দোলনে আছেন। বাধ্যতামূলক সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয় বাতিলের দাবিতে তাঁরা আন্দোলন করছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তো উচিত ছিল শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। লাঠিসোঁটা নিয়ে বহিরাগতরাও ক্যাম্পাসে ঢুকেছে, যার ছবি সংবাদমাধ্যমে এসেছে। প্রশাসনের এই নীরবতার উদ্দেশ্য কী?

এ এম আমজাদ: প্রশাসন নীরব ছিল, এ কথা ঠিক নয়। প্রশাসনের দিক থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে যখন সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ঢুকে যায়, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রথম আলো:

শিক্ষক হিসেবে আপনারা এই পরিস্থিতি কীভাবে মেনে নিলেন? শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে শিক্ষকেরা নির্বিকার থাকতে পারেন না।

এ এম আমজাদ: সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল, তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি আছে। আমরাও কোটা সংস্কারের পক্ষে। কিন্তু বিষয়টি যখন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, তখন সবারই উচিত ছিল সংযত হওয়া। আদালতের চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাদের দাবির বিষয়ে অনড় থাকল।

আন্দোলনকারীরা যেমন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেছে, তেমনি আন্দোলনকারীদের হাতেও চারজন সহকারী প্রক্টর নিগৃহীত হয়েছেন। আমরা মনে করি, কোনো শিক্ষার্থী শিক্ষকের গায়ে হাত দিতে পারে না। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে এসব করেছে। কোটা সংস্কার তাদের উদ্দেশ্য নয়। তারা অন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছে।

প্রথম আলো:

সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সহিংস ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসন কোনো ভূমিকা নেননি। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মেডিকেলের ভেতরে গিয়েও হামলার চেষ্টা করেছেন।

এ এম আমজাদ: বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একজন সহ-উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য মেডিকেলে আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে গিয়েছেন। অনেক শিক্ষক গিয়েছেন।

প্রথম আলো:

কোটা আন্দোলন নিয়ে তো সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার ঢাকা কলেজের সামনে একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। রংপুরে একজন শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক আহত হয়েছেন। চট্টগ্রামেও তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ পালিত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন?

এ এম আমজাদ: এ ঘটনায় আমরাও উদ্বিগ্ন। এর দ্রুত সমাধান হওয়া প্রয়োজন। যারা আন্দোলন করছে, তারাও আমাদের সন্তানতুল্য। কিন্তু সমস্যা হলো, আন্দোলনটি এখন আর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আজকের (মঙ্গলবার) আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে আমার মনে হয়, একটা পক্ষের কোনো ইলমোটিভ আছে। একটি পক্ষ কোটা আন্দোলনকে সামনে রেখে পুরো দেশকেই অস্থিতিশীল করে রাখতে চাইছে। অন্যথায় ‘তুমি কে’ ‘আমি কে—রাজাকার’ স্লোগান উঠত না।

প্রথম আলো:

এই স্লোগানকে আক্ষরিক অর্থে দেখার সুযোগ আছে কি? প্রধানমন্ত্রীর একটি উক্তিকে আন্দোলনকারীরা অপমানজনক মনে করেছেন। এ কারণেই তাঁদের কেউ কেউ এই স্লোগান দিয়েছেন। আবার তাঁদের মধ্যে এ রকম স্লোগানও তো উঠেছে, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’।

এ এম আমজাদ: এখানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে টুইস্ট বা ভুলভাবে উত্থাপন করা হয়েছে। তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেননি। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলে বাধা দেওয়া হবে না, সে কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। আন্দোলনের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ না ঢুকলে পরিস্থিতি এ রকম হতো না।

প্রথম আলো:

কোটা নিয়ে সারা দেশে যে সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, এর সমাধান কী?

এ এম আমজাদ: সরকারকেই এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সংযত আচরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

এ এম আমজাদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।