বিশেষ সাক্ষাৎকার : রানা দাশগুপ্ত

আমরা ভারতেরও দালাল নই, আওয়ামী লীগেরও দালাল নই

রানা দাশগুপ্ত। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের অঙ্গীকার করলেও মেয়াদ প্রায় শেষ হলেও এর কোনোটি পূরণ হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এই নেতা। আলোচনায় এসেছে আগামী জাতীয় নির্বাচনও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান মনোজ দে

রানা দাশগুপ্ত
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: দেশভাগের ৭৫ বছর হয়ে গেল। উপমহাদেশের তিন দেশের নাগরিকদের একাংশ কেন এখনো সংখ্যালঘু থেকেই গেল। এ ব্যর্থতা কার?

রানা দাশগুপ্ত: দেশভাগের ৭৫ বছর পরে এসে আমি কেবিনেট মিশনকে স্মরণ করতে চাই। মুসলিম লীগ যখন অখণ্ড ভারতের দুই অংশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের প্রস্তাব করে বলেছিল, এর মাধ্যমে ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সমস্যার মীমাংসা করা সম্ভব, তখন কেবিনেট মিশনে পরিষ্কার করে একটা রূপরেখা দিয়ে বলা হলো, দেশ ভাগ করা হলে বিরাটসংখ্যক মুসলমান, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী দুই দিকেই থেকে যাবে এবং এর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যার সমাধান হবে না। হয়ওনি।

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান যেমন হয়নি, আমরা যদি ভারতের দিকে তাকাই, সেখানেও সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির উত্থানের মধ্য দিয়ে সেখানকার মুসলিম সম্প্রদায় অসহায়ত্বের দিকে যাচ্ছে। ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হয় একতরফা সহিংসতা। ভারতে এক পক্ষ হামলা করতে এলে আরেক পক্ষ প্রতিরোধ করে। এ প্রতিরোধের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি কী? গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। এর মাঝে তারা একটা মানসিক ও রাজনৈতিক শক্তি খুঁজে পায় বলেই দেশ ছাড়ে না। কিন্তু আমরা যদি পূর্ব বাংলা কিংবা আজকের বাংলাদেশের কথা বলি, রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের পক্ষে আছে, সেটা তারা মনে করে না, রাজনীতি তাদের সহায়ক, সেটাও তারা ভাবে না। তারা দেখে যে এখানে একটা দায়মুক্তির সংস্কৃতি আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের নির্লিপ্ততা তাদের অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেয়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তো অনেক বেশিই ছিল?

রানা দাশগুপ্ত: পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রশক্তি ছিল সাম্প্রদায়িক। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা তৈরি হয়। চুয়ান্নর নির্বাচনটি হয়েছিল পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে। তখন সংখ্যালঘুদের জন্য সংসদে আসন ছিল ৭১টি। ১৯৫৭ সালে যুক্ত নির্বাচনের বিল পাস হয়। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈরিতার বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার উন্মেষ হতে থাকে। ষাটের দশকে এ ধারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে। সত্তরের নির্বাচন হয়ে একাত্তরে স্বাধীনতা আসে। কিন্তু বাহাত্তরের পর কী দেখলাম? মাওলানা ভাসানী ভারতবিরোধী রাজনীতি শুরু করলেন। জাসদের রাজনীতির মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর লোকজন ঢুকে পড়ল। ৭ নভেম্বর যে লিফলেট প্রচার করা হলো, তাতে পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি সামনে আনা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী স্লোগান উঠল, সেটি কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেয়নি।

যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছে, তাদের অনেকে দিয়েছে। অর্থাৎ আমাদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনাটি ছিল অসম্পূর্ণ ও ভঙ্গুর। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের আশাভঙ্গের শুরু স্বাধীনতার পর থেকেই। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর চার মূলনীতি নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়েছে, তার আগের মাসে অক্টোবরে শারদীয় দুর্গাপূজায় পূজামণ্ডপে হামলা হয়। হামলাকারীরা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়েছে। সেদিনের সরকার ও প্রশাসন এর বিপদ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর পঁচাত্তরের পর তো সংবিধানই বদলে দেওয়া হলো। জিয়াউর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলেন, এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন থেকে আমরা রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত হলাম।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আপনাদের শঙ্কা ও প্রত্যাশা কী?

রানা দাশগুপ্ত: আশাও করছি, শঙ্কাও আছে। আশা হচ্ছে, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, জনগণ অবাধভাবে সেই নির্বাচনে ভোট দিতে পারুক। সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল একত্র হয়ে গণতন্ত্র সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে কাজ করুক। এবার আশঙ্কার কথাটা বলি। এবারে জন্মাষ্টমীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, একটা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হতে পারে, আপনারা সবাই সজাগ, সতর্ক থাকবেন। এর চার দিন পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বললেন, সামনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হতে পারে এবং বিএনপির বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, দুই পক্ষেরই শঙ্কা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদও ছয় থেকে সাত মাস আগে থেকেই বলে আসছে, সামনের দুর্গাপূজা ও নির্বাচনের আগে-পরের সময়টাতে আমাদের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত। আমাদের সেই শঙ্কা কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোও স্বীকার করে নিল। আমরা মনে করি, নির্বাচনের পরে কিংবা আগে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা যাতে না হয়, সে বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ঐকমত্য হবে বলে কি আশা করেন?

রানা দাশগুপ্ত: আমরা সব সময় আশা করতে চাই। আবার নিরাশ হতেও খুব বেশি সময় লাগে না। ২০২১ সালের দুর্গাপূজার সময় ৩২টি জেলায় সহিংসতা হয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালে আমরা সেটা দেখিনি। আমাদের মনে হয়েছে, প্রশাসন সচেষ্ট ছিল বলেই সহিংসতা হয়নি। কিন্তু এবার এ পর্যন্ত আট থেকে নয়টি জায়গায় বিগ্রহ ভাঙচুর হয়েছে। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার সম্পর্কে পুলিশ বলেছে, সে পাগল। ২০২১ সালেও আমরা দেখেছিলাম কুমিল্লার ঘটনায় ইকবালকে যখন ধরা হলো, বলা হলো সে পাগল।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ২০২১ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর আমরা দেখেছিলাম, সহিংসতা করার ব্যাপারে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। এটিকে কীভাবে দেখেন?

রানা দাশগুপ্ত: ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে। তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে একানব্বইয়ে নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচনের প্রচারকালে আমরা এমন সব স্লোগান শুনেছি, যেগুলো পাকিস্তান আমলে দেওয়া হতো। তবে নির্বাচনের আগে সহিংসতার কোনো ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনে জেতার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিবৃতি দিলেন। সেই বিবৃতিতে আমরা আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু পরদিন থেকেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হলো। এরপর ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত আমরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখেছি। ২০১১ সালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা থেকে শুরু করে রংপুরে ছোট-বড় অনেক সহিংসতা হতে দেখেছি। এসব ঘটনায় যুক্ত ছিল সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যারা রাজনীতিতে ছিল, এর সঙ্গে বেশ কিছু যুক্ত ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের ধ্বজাধারী একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। আগে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় মামলা নেওয়া হতো না। এখন মামলা নেওয়া হয়। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই চার্জশিটে আওয়ামী লীগের কারও নাম আসে না।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এই যে মামলা থেকে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের নাম বাদ দেওয়া হয়, এর পেছনে কি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই বলে মনে করেন?

রানা দাশগুপ্ত: আমাদের কাছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বলে মনে হয়নি। এখানে আছে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা, গাফিলতি অথবা ইচ্ছাকৃত কর্মকাণ্ড। ২০২১ সালে দুর্গাপূজায় অষ্টমীর দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকবে। তাঁর এ ঘোষণার পরও ২৫ দিন সহিংসতা চলেছে। এখানেই আমরা বলেছি, প্রশাসনে পাকিস্তান আছে, সরকারি দলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তি আছে এবং তৃণমূলের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। একদিকে তাদের বিচার হচ্ছে না, মামলা হলেও ধরা পড়ছে না, ধরা পড়লেও দুই দিন পর বেরিয়ে আসে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আপনাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন, সংখ্যালঘু কমিশন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন এবং সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ভূমি কমিশন করার অঙ্গীকার করেছিল। পাঁচ বছর পর কী দেখলেন?

রানা দাশগুপ্ত: ২০২১ সালে আমরা যখন দেখলাম এসব অঙ্গীকারের কোনোটাই বাস্তবে পূরণ করা হয়নি, আমরা আন্দোলন শুরু করলাম। আন্দোলনের একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠক হলো। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আমাদের বৈঠক হয়। কিন্তু বাস্তবায়নের উদ্যোগ না দেখে আমরা অনশন করি। সে সময় আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো–চেয়ারম্যান কবির বিন আনোয়ার আশ্বাস দিলেন, অক্টোবরের অধিবেশনে সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। রাজনৈতিক নেতাদের ওপর আমাদের আশা ও আস্থা নেই। কিন্তু আমরা বলেছি, প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের আশা ও আস্থা আছে। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের ব্যাপারে সদিচ্ছা দেখিয়েছেন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে?

রানা দাশগুপ্ত: ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করে। পরে বিএনপির সময়ে আইনটি অকার্যকর করে রাখা হয়। ২০১১-১৩ সাল পর্যন্ত এ আইনে আরও ছয়টি সংশোধনী হলো। এ সংশোধনীগুলোয় আমলাদের সঙ্গে আমরাও যুক্ত ছিলাম। ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনালে প্রায় দেড় লাখ আবেদন জমা পড়ল। ১০ বছরে ট্রাইব্যুনাল ৩০ শতাংশের মতো আবেদন নিষ্পত্তি করতে পেরেছেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা সম্পত্তি ফেরত পায়নি। আইন হলো, ট্রাইব্যুনালে রায় দেওয়ার পর যাঁরা সংক্ষুব্ধ হবেন, তঁারা আপিল আদালতে যাবেন। সেখানকার আদেশই চূড়ান্ত আদেশ। বাস্তবতা হলো, আদালত ও আপিল আদালতে ধীরগতি আছে। যেগুলো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে, তার ১০ ভাগ ভুক্তভোগীও জমি ফেরত পায়নি। জেলা প্রশাসকেরা আটকে রেখেছেন। অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রেও একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে আমরা আটকা পড়েছি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনারা বলেছেন যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটি হবে না। এর মধ্য দিয়ে কী বার্তা দিতে চান?

রানা দাশগুপ্ত: অনেকেই মাঝেমধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে বলেন, তারা ভারতের দালাল, তারা আওয়ামী লীগের দালাল। আমরা পরিষ্কার করে বলছি, আমরা ভারতেরও দালাল নই, আওয়ামী লীগেরও দালাল নই। আমরা বাংলাদেশের দালাল, মুক্তিযুদ্ধের দালাল। আমরা বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আওয়ামী লীগ একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেয়নি।

রানা দাশগুপ্ত: এটা দুঃখজনক। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তারা এটা করে ফেলতে পারত। কিন্তু আওয়ামী লীগ করেনি বলে আমরা আন্দোলনে আছি। উপমহাদেশের রাজনীতি বদল হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যেমন বলা হয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সঙ্গে সংবিধানের কোনো সংঘর্ষ নেই, ভারতে বিজেপিও বলতে শুরু করেছে রাষ্ট্রধর্ম হিন্দু হলে সংবিধানের সঙ্গে সেটা কোনো সাংঘর্ষিক হবে না। কিন্তু এগুলো মিথ্যা যুক্তি। আমরা চাই বাংলাদেশ হোক, ভারত হোক, সব জায়গায় ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে মানুষ শান্তিতে, সম্প্রীতিতে, স্বস্তিতে সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিয়ে বাস করুক।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এই সংসদে ২২ জন সংখ্যালঘু সংসদ সদস্য রয়েছেন। তাঁদের কতজন আপনাদের অধিকারের নিয়ে কথা বলছেন?

রানা দাশগুপ্ত: দুঃখজনক হলেও সত্যি, সংসদে তিন থেকে চারজনের বাইরে আমরা কাউকে সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রশ্নে কথা বলতে শুনি না। অন্যরা নিশ্চুপ। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, কথা বললে পরবর্তী নির্বাচনে মনোনয়ন না-ও পেতে পারেন। তাঁরা সংসদে সম্প্রদায়ের স্বার্থ দেখেছেন, সেটা মনে করি না।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সে ক্ষেত্রে ঐক্য পরিষদ কি দাবিদাওয়া আদায়ে সংসদে যাওয়ার চিন্তা করবে?

রানা দাশগুপ্ত: পরিষদের সভায় অনেকে এ প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। কিন্তু আমরা এখনো চাই ঐক্য পরিষদ যেন রাজনৈতিক দলে পরিণত না হয়। রাজনীতিতে ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তরা লড়াই করেছেন। আমরা তাঁদের উত্তরসূরি। আমরা চাই না সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে একটা রাজনৈতিক দল হোক। যদিও আমাদের কেউ কেউ ক্ষোভ, বঞ্চনাবোধ থেকে মনে করেন ঐক্য পরিষদকে একটা রাজনৈতিক দলে পরিণত করা হোক। কিন্তু আমরা সেটা এখনো ভাবছি না।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো সুষ্ঠু নির্বাচন ও ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং ভোটারের অধিকার সুরক্ষা। ২০০১ সালে মানুষ ভোট দিতে পারলেও সংখ্যালঘু ভোটারদের নিরাপত্তা ছিল না। আর ২০১৮ সালে মানুষ ভোটই দিতে পারেনি। কী বলবেন?

রানা দাশগুপ্ত: রাজনৈতিক দলগুলোকেই উত্তরণটা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যারা গণতন্ত্রের কথা বলছে, জনগণের জীবনে যাতে দুঃখ নেমে না আসে, সে পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সংখ্যালঘুর প্রশ্ন নয়, গণতন্ত্র ছাড়া কোনো মানুষের সুরক্ষা সম্ভব নয়। এই গণতন্ত্রের জন্যই আমরা পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, সেই গণতন্ত্রই এখন দুর্বল।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?

রানা দাশগুপ্ত: একটা দেশ চিরকাল একইভাবে চলতে পারে না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের যাতে শুভবুদ্ধির উদয় হয়, সে জন্য নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ বজায় রাখতে হবে। বামপন্থীরা একটা বিকল্প তৃতীয় ধারা হতে পারলে আজ বাংলাদেশের রাজনীতি এমন অবস্থায় থাকত না। তারা সেটা পারেনি। বামধারাটা শক্তিশালী থাকলে গণতান্ত্রিক ধারাটা শক্তিশালী থাকত। সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অভয় পেত।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনারা কি মনে করেন, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রশ্নে বিএনপির নীতি পরিবর্তন হয়েছে?

রানা দাশগুপ্ত: আমরা মনে করি, কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আমরা একটা আহ্বান জানিয়েছিলাম—শারদীয় দুর্গাপূজার সময় কোনো রাজনৈতিক দল যাতে কোনো কর্মসূচি না দেয়। আমরা বিএনপির প্রতি কৃতজ্ঞ যে তারা দুর্গাপূজার মধ্যে কোনো কর্মসূচি দেয়নি। আওয়ামী লীগ ২৩ অক্টোবর একটা কর্মসূচি দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কাছে কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছি। আশা করি, তারা তারিখ পরিবর্তন করবে। বিএনপি ৩২ দফা দিয়েছে। তারা নির্বাচিত হলে কী কী করবে, সংবিধানে কী কী আনবে, সেটা বলেছে। এর একটায় বলেছে, ‘এই প্রথম, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার।’ এক মার্শাল ল ঘোষণায় সংবিধান সংশোধন করে দেশটাকে যে গর্তে ফেলে দেওয়া হলো, সেই গর্ত থেকে এখনো উদ্ধার করা যায়নি। তারা গণতান্ত্রিক সংশোধনী আনলে সেটাকে আমরা স্বাগত জানাব। কিন্তু তার আগে তারা বলুক না কেন, ২০০১-০৬ সালে তারা যা কিছু করেছে, ১৯৯২ সালে যা হয়েছে, তার জন্য তারা দুঃখিত। আওয়ামী লীগের সময় যেসব সহিংসতা ঘটেছে, তার জন্য দলটির কাছে একই দাবি করি। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আগামী নির্বাচন যদি সব দলের অংশগ্রহণে না হয়, সেটাকে কি বিপদ বলে মনে করেন?

রানা দাশগুপ্ত: পুরো জাতির জন্যই সেটা হবে দুঃখজনক। কার কী হবে, সেটা কিন্তু কেউ জানে না। এটা শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য বিপদ হবে না, গোটা জাতির জন্যই বিপদ হবে। যারা নির্বাচনে আসবে না কিংবা যারা নির্বাচনে আসার জন্য পথ উন্মোচিত করবে না, সবার জন্যই বিপদ হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

রানা দাশগুপ্ত: আপনাদেরও ধন্যবাদ।