সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শান্তিপূর্ণভাবে হলেও ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে হামলা, মামলা, গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী হিসেবে এ ঘটনায় আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
কায়সার কামাল: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে অরাজকতা ঘটেছে, এর একটা প্রেক্ষাপট আছে। ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনেও প্রথম হস্তক্ষেপ করা শুরু হয়। সেই সময় বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক আইনজীবীরা সেই ফলাফল ঘোষণা করতে দেননি।
আমরা এই ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। এভাবে এক বছর কেটে যায়। এরপর ২০২৩ সালের নির্বাচন চলে আসে। সেই নির্বাচনের শুরু থেকেই নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছিল। আমরা এগুলোর প্রতিবাদ করেছিলাম। সেই সময় পুলিশ আইনজীবী সমিতির ভবনে ঢুকে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের বেধড়ক মারধর করেছিল। সেবার একতরফা একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার সমর্থকেরা নিজেদের আইনজীবী সমিতির নেতা হিসেবে ঘোষণা দেন।
এবার নির্বাচনের আগে আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। ভোট গ্রহণের দুই দিনেই অনেক জাল ভোট দেওয়া হয়েছে। এরপরও আমরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করব—এমন আভাস পাই। এ কারণে আমরা নির্বাচন থেকে সরে যাইনি। কিন্তু ভোট গণনার সময় নতুন নাটক মঞ্চস্থ করা হলো।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে এবার যা ঘটল, অনেকেই সেটাকে আইনজীবীদের মধ্যকার বিভক্তির ফলাফল বলছেন। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?
কায়সার কামাল: এবারের নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হবেন—আমরা এ রকম আভাস পাচ্ছিলাম। এটা যাতে না হতে পারে, সেই কারণে সরকার সমর্থক আইনজীবীরা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। ভোট গণনা নিয়ে যে হামলা, মামলার ঘটনা; সেগুলোকে আমরা তারই অংশ মনে করি।
আমরা কোনো মারামারি বা বিরোধের মধ্যে ছিলাম না। তারপরও রুহুল কুদ্দুস কাজলকে গ্রেপ্তার করা হলো। সেই মামলায় এক নম্বর আসামি আওয়ামী লীগ ঘরানার আইনজীবী।
এবারের নির্বাচনে ঘোষিত ফলাফল অনুসারে সম্পাদকসহ ১০টি পদ পেয়েছে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্যানেল। আর সভাপতিসহ ৪টি পদ পেয়েছে বিএনপি-সমর্থিত প্যানেল। আপনারা কি নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছেন?
কায়সার কামাল: আমরা এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিইনি, বরং তা প্রত্যাখ্যান করেছি। আমাদের সভাপতি প্রার্থীসহ অন্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমরা পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হতাম। এবার ভোট গণনার নামে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। সত্যিকারের নির্বাচন আর নিজেদের ইচ্ছেমতো ফলাফল ঘোষণা এক বিষয় নয়।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, এর সঙ্গে কি জাতীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক আছে?
কায়সার কামাল: অবশ্যই সম্পর্ক আছে। আমাদের গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন ছিল একতরফা ও প্রশ্নবিদ্ধ। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে ‘জোর যার মুল্লুক তার’—এ রকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের এই প্রভাব এখন অন্যান্য ক্ষেত্রেও পড়ছে।
আইনজীবীদের বড় অংশ সব সময় গণতন্ত্রের পক্ষে থেকেছেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁরা ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ কারণে বর্তমান সরকার আইনজীবীদের ভয় পায়। নিজ দলীয় আইনজীবীদের মাধ্যমে সরকার আইনজীবী সমিতিগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি পেশাজীবী সংগঠন। আইনজীবীদের পেশাগত মানোন্নয়ন এবং তাঁদের সুবিধা-অসুবিধা দেখাই এর প্রধান কাজ হওয়া উচিত। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, গত কয়েক বছরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে বিরোধ বা ঝামেলার কারণ হলো দলাদলি বা অতিরিক্ত রাজনৈতিকীকরণ। আপনি একজন আইনজীবী, এর পাশাপাশি রাজনীতিকও। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
কায়সার কামাল: আইনজীবীরা নানা মতাদর্শে বিশ্বাস করলেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে তা নিয়ে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টা হচ্ছে, গণতন্ত্রমনা আইনজীবীরা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সংবিধান মেনে চলা ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য বিভিন্ন সময় কথা বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম করেন। এটা অবধারিতভাবে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যায়। এ কারণে অনেক সময় রাজনীতি বা দলাদলির বিষয়টি বলা হয়।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কায়সার কামাল: আপনাকেও ধন্যবাদ।