বিশেষ সাক্ষাৎকার: তছলিম উদ্দিন খান

মানুষের আস্থাই এসএমসিকে আজকের অবস্থানে এনেছে

সমাজবিজ্ঞান ও বিপণন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তছলিম উদ্দিন খান। সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানিতে (এসএমসি) কাজ করছেন ২৩ বছর। বর্তমানে এসএমসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এসএমসির সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে এ বছর। এসএমসির ৫০ বছর নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল

প্রথম আলো:

৫০ বছর কেমন গেল? ৫০ বছর আগে কি ভাবা গিয়েছিল যে এসএমসি এত বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, এমন আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারবে?

তছলিম উদ্দিন খান: ৫০ বছর আগে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমি ছিলাম না। আমার যুক্ততা ২৩-২৪ বছর। ২৩-২৪ বছর আগে আমাদের পণ্য ও সেবা দুই-ই কম ছিল। এখন তা অনেক বেড়েছে। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে এসএমসির কোনো না কোনো পণ্য পাওয়া যায়। আমাদের পূর্বসূরিরা স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু আজকের সাফল্য মনে হয় স্বপ্নের চেয়েও বড়। শুরু থেকে কঠোর পরিশ্রম, নতুন নতুন উদ্ভাবন এই সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে।

প্রথম আলো:

এসএমসি আসলে কত বড়? এর সেবার পরিধি কত? কত মানুষ কাজ করে? কত মানুষের সেবা দেয়?

তছলিম উদ্দিন খান: আমরা বেসরকারি খাত হিসেবে কাজ করি, উদ্দেশ্য সরকার মানুষের ওয়েলবিয়িং বা কল্যাণের জন্য যে কাজ করে, সেটাকে সহায়তা করা। বর্তমানে ৯০ লাখ দম্পতি এসএমসির ব্র্যান্ড জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহার করেন। লাখ লাখ শিশুর জীবন রক্ষা করেছে এসএমসির স্যালাইন। বছরে ১৫০ কোটি প্যাকেট খাওয়ার স্যালাইন বিক্রি হয়। বছরে আট লাখ গর্ভবতী নারী এসএমসির প্যাকেটজাত পুষ্টি খান। ৫০ লাখ নারী এসএমসির স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। দেশের চার কোটি পরিবারের এসএমসির কোনো না কোনো পণ্য বা সেবার অভিজ্ঞতা আছে। এই প্রতিষ্ঠানে এখন সাড়ে চার হাজার মানুষ কাজ করেন।

প্রথম আলো:

এত যে কাজ, এত বড় যে আয়োজন—এর পেছনে কী চিন্তা কাজ করেছিল?

তছলিম উদ্দিন খান: স্বাধীনতার পরপর জনসংখ্যা এক নম্বর জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হতো। পিল ও কনডম বিক্রির মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে কাজ করা শুরু ১৯৭৫ সালে। ১৯৮৫ সাল থেকে মানুষের কাছে দ্রুত ওআরএস পৌঁছে দেওয়া শুরু করলাম। ১৯৯০ সালে এসে দেখলাম বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানুষ এসএমসিকে কাছে পেতে চায়। মানুষের মধ্যে এত দিনে এসএমসির জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে। আমরা নতুন নতুন পণ্য ও সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা ভাবতে থাকি।

সারা দেশে আমাদের ‘ব্লুস্টার’ নামে ১৩ হাজার সহায়ক কর্মী আছেন। তাঁরা ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজ করেন। তাঁরা শিশু অপুষ্টি ও যক্ষ্মা শনাক্ত করেন এবং রেফার করেন। আছে সাড়ে পাঁচ হাজার ‘গ্রিন স্টার’। তাঁরা ওষুধ বিক্রি করেন। স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আছে একটি নেটওয়ার্ক। এর ৬৫০ জন সদস্যকে বলা হয় ‘পিঙ্কস্টার’। ৩৫০ জন শিশুবিশেষজ্ঞ নিয়ে আর একটি নেটওয়ার্ক আছে।

এ ছাড়া ১২০টি উপজেলায় প্রান্তিক নারীদের নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা সবাই উদ্যোক্তা। তাঁদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। তাঁদের প্রত্যেকের ডায়াবেটিস পরিমাপের যন্ত্র গ্লুকোমিটার ও শিশুদের ওজন পরিমাপ করার যন্ত্র আছে। তাঁরা উঠান বৈঠকে স্বাস্থ্য বার্তা দেন। যেমন ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়, ২০ বছরের আগে সন্তান নয়, ৩৫ বছরের পর সন্তান নয় এবং দুই সন্তানের জন্মের ব্যবধান তিন বছর। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তাঁরা এসএমসির পণ্য বিক্রি করেন, সেখান থেকে কি লাভ করেন।

প্রথম আলো:

আপনাদের এই কাজে সরকার বা দাতারা কী সহায়তা দিয়েছিল? বাংলাদেশ সরকার, ইউএসএআইডির ভূমিকা কী ছিল?

তছলিম উদ্দিন খান: বাংলাদেশ সরকার, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা পপুলেশন সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল এবং ইউএসএআইডির ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এসএমসির যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই থেকে এসএমসি সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। এত যে কাজ, তা সম্ভব হতো না সরকারের সম্মতি বা ছাড়পত্র ছাড়া।

অন্যদিকে ইউএসএআইডির সঙ্গে এসএমসির সম্পর্ক কৌশলগত। তারা আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা দেয়। ১৯৯০ সালে এসএমসি স্বাধীন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরুর পরও ইউএসএআইডির সহায়তা অব্যাহত আছে। তাদের সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। দেড় বছর পর তাদের আর্থিক সহায়তার একটি পর্যায় শেষ হবে। তবে আমরা আশা করি ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তারা সহায়তা অব্যাহত রাখবে।

প্রথম আলো:

আমলাতন্ত্র কি কখনো আপনাদের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?

তছলিম উদ্দিন খান: আমাদের জন্য সরকারের সুদৃষ্টি সব সময় ছিল। আমরা যেহেতু জরুরি চাহিদা পূরণে কাজ করি, তাই আমাদের কাজে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ান না। সম্প্রতি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সরবরাহে ইনজেক্টেবলর ঘাটতি দেখা গিয়েছিল। এটা জরুরি চাহিদা। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে বাজার থেকে ইনজেক্টেবল কিনে সরবরাহ ঠিক রাখায় সহায়তা করেছি। এ ক্ষেত্রে কেউ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এ রকম উদাহরণ আরও আছে।

প্রথম আলো:

এসএমসি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড তাহলে কী? এটা করার দরকার হলো কেন?

তছলিম উদ্দিন খান: এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড সামাজিক বিপণনের ক্ষেত্রে একটি বিজনেস মডেল। একটা বিষয় ভাবা উচিত, ইউএসএআইডির মতো দাতারা আমাদের কত দিন সহায়তা করবে? আমাদের তো দাতানির্ভরতা কাটাতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সেই চিন্তা থেকে সামাজিক বিপণনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা মানসম্পন্ন সেবা ও পণ্য দিয়ে থাকি। আমরা পণ্য বিক্রি করি সামান্য লাভে। যে লাভ হয়, তা আবার এসএমসির জন্যই ব্যবহৃত হয়। এই লাভ কোনো ব্যক্তির পকেটে যায় না।

আমাদের বোর্ডে বিভিন্ন পেশার মানুষ আছেন। তাঁরা দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তি। কিন্তু তাঁরা কোনো বেতন বা সম্মানী এখান থেকে পান না। তাঁরা যে সময় দেন, তার বিনিময়ে কোনো সম্মানী নেন না। সুতরাং এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের লাভ পুরোটাই প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসে।

প্রথম আলো:

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সোশ্যাল বিজনেসের কথা বলে আসছেন বহু বছর ধরে। মুহাম্মদ ইউনূসের সোশ্যাল বিজনেস আর আপনাদের বিজনেসের মধ্যে পার্থক্য কী?

তছলিম উদ্দিন খান: আমাদের বিজনেস মডেল ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। তবে আমরা আমাদের মডেলকে মুহাম্মদ ইউনূসের মডেলের সঙ্গে মেলাতে বা তুলনা করতে চাই না। এসএমসি যা করেছে, তা সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তা থেকে করেছে, স্বাধীনভাবে করেছে। এখান থেকে কোনো লাভ কোনো ব্যক্তি নিতে পারেন না।

প্রথম আলো:

এসএমসির অনেকগুলো বড় কাজ মানুষের মধ্যে বা সমাজের গভীরে প্রথিত বলা যায়। এ সফলতার কারণ কী?

তছলিম উদ্দিন খান: আমাদের একটি বিশেষ কৌশল আছে, আমরা ব্র্যান্ডের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিই। যেমন রাজা, মায়া এই ব্র্যান্ডগুলো সারা দেশে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমরা প্রথমে একটি ব্র্যান্ড চিহ্নিত করি। তারপর সেই ব্র্যান্ড নিয়ে ব্যাপক প্রচার করি।

কিছু বাণিজ্যিক কৌশল আছে। যেমন, আমরা যেকোনো একটি পণ্যের মূল্যের ধারণা জনসাধারণের কাছ থেকে নিই। আমরা জানতে চেষ্টা করি মানুষ এসএমসির পণ্যের দাম কত দিতে প্রস্তুত। আমরা জানার চেষ্টা করি, কোন সেগমেন্টের মানুষ কেমন দাম দিতে প্রস্তুত। গবেষণার মাধ্যমে আমরা তা জানার চেষ্টা করি।

এ ছাড়া আছে দেশজুড়ে আউটলেট। আমরা সারা দেশে আট লাখ আউটলেট থেকে আমাদের বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিতরণ করি। এ ছাড়া ১২০টি উপজেলায় আমাদের নারীদের একটি দৃঢ় নেটওয়ার্ক আছে। তবে আমাদের সাফল্যের প্রধান কারণ পণ্যের মান। আমাদের পণ্যের মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেন না, কারও সন্দেহ হয় না। মানের কারণে বহু বছর ধরে মানুষ আমাদের পণ্যের ওপর আস্থা রেখেছেন। একই সঙ্গে মানুষ দেখেছেন এসএমসির পণ্যের মূল্য তুলনামূলকভাবে কম, সহনশীল। মানুষ বিশ্বাস করেন, এসএমসি অযথা দাম রাখে না। এসএমসি ৫০ বছরে মানুষের এই আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে।

প্রথম আলো:

ভবিষ্যতে আপনারা নতুন কী করতে চান অথবা শুরু করেছেন, মানুষ ঠিকমতো জানে না।

তছলিম উদ্দিন খান: এসএমসির পণ্যের সোশ্যাল ভেল্যু বা সামাজিক মূল্য আছে। আমাদের সব পণ্যই থাকবে, নতুন পণ্যও আসবে। তবে আমরা এখন বিশেষভাবে গুরুত্ব দেব সেবার ওপর। মাত্র চার বছর বাজারে এনেছি কিন্তু তারই মধ্যে অনুপুষ্টি পাউডার জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

ভবিষ্যতে আমরা শিশু ও নারীর পুষ্টি ও স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করব। আমরা সব পরিবারের জন্য কৃমিনাশক বড়ি দিতে চাই। আমার চাই চারটি প্রসব-পূর্ব সেবার আওতায় বেশিসংখ্যক মাকে আনতে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব বাড়ানোর চেষ্টা আমরা চালাব, পাশাপাশি বাল্যবিবাহ কমানোর চেষ্টা আমাদের থাকবে। এগুলোই আমাদের সামনের দিনের ভিশন বা লক্ষ্য।

প্রথম আলো:

আপনারা ওষুধ তৈরি কারখানা স্থাপন করছেন? কেন, লাভ করতে চান?

তছলিম উদ্দিন খান: আমরা ওষুধ তৈরির কারখানা স্থাপন করেছি, উৎপাদনও শুরু করেছি। আমরা এখন ৪০টি ওষুধ তৈরি করি। আমাদের পরিকল্পনা আছে ওষুধ উৎপাদন বাড়ানোর। মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন করতে পারব, এই আত্মবিশ্বাস আমাদের আছে। ওষুধ থেকে উচ্চ মুনাফার ইচ্ছা আমাদের নেই। সুতরাং কম মূল্যে মানসম্পন্ন ওষুধ মানুষ এসএমসির কাছ থেকে পাবে, আমরা এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারি।

প্রথম আলো:

ওষুধের ক্ষেত্রে সরকার যদি কোনো সহায়তা চায়, আপনারা কি তা করতে প্রস্তুত আছেন?

তছলিম উদ্দিন খান: আমরা সব সময় সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি, সরকারকে পাশে পেয়েছি। ওষুধের বিষয়ে সরকার কোনো উদ্যোগ নিলে তার পাশে থাকতে আমাদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য লাভ করা নয়, সরকারও কোনো কাজ লাভ করার জন্য করে না। কিছু মিল আমাদের আছে। কিছু লাভ করতে হবে, এ কারণে যে আমাদের টিকে থাকতে হবে।

প্রথম আলো:

এসএমসিকে আপনি কোথায় দেখতে চান? এসএমসির মতো প্রতিষ্ঠান কি বিশ্বের অন্য কোথাও আছে?

তছলিম উদ্দিন খান: আমরা আগামী দিনগুলোয় স্বাস্থ্যের কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দিতে চাই। আমরা এখন ১২০টি উপজেলায় কাজ করছি প্রায় চার হাজার নারীর একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। আমরা কাজটি আরও বিস্তৃত করতে চাই। এর অর্থ আমরা আরও অনেক উপজেলায় আরও অনেক নারীকে নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চাই।

আমরা জানি, অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বিরাট শূন্যতা রয়েছে। আমরা অসংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ শুরু করতে চাই এবং কাজের পরিধি বাড়াতে চাই।

আমরা সাশ্রয়ী মূল্যে মানুষকে ওষুধ দিতে চাই। সাশ্রয়ী মূল্যে মানুষ ওষুধ পেলে স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসা ব্যয় কমে আসবে। স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বা আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার কমানো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। আমরা এ ব্যাপারে মানুষের পাশে থাকতে চাই। নতুন নতুন সেবা ও পণ্য নিয়ে আমরা মানুষের পাশে, মানুষের সঙ্গে থাকব।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

তছলিম উদ্দিন খান: প্রথম আলোকে ধন্যবাদ।