বিশেষ সাক্ষাৎকার: পর্ব ২ মাহফুজ আলম

‘মানুষ নতুন একটা রাজনৈতিক পরিসর খুঁজছে’

মাহফুজ আলম ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী। অভ্যুত্থানের পরে ছাত্র, নাগরিক ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য গঠিত লিয়াজোঁ কমিটির তিনি ছিলেন সমন্বয়ক। আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশাস্ত্রের এই স্নাতক ছিলেন রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগীর দায়িত্বে। ছাত্রদের আন্দোলন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরে তাঁদের ভাবনা নিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। দুই পর্বের এই সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল গতকাল বুধবার। আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব।

প্রথম আলো:

আমরা এখন ইসলামপন্থী নানা দলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আপনি একে কীভাবে দেখছেন?

মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে যত ধরনের ইসলামপন্থী চিন্তাধারা আছে, গত ৫০ বছর তাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ না হওয়ায় সংক্ষুব্ধতার জন্ম হয়েছে। সংক্ষুব্ধতা মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে। যখন কেউ ভাবে যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তখন তার আর কী করার থাকে।

আমাদের শাসকগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের পরিচয় ছিল সেক্যুলার (ধর্মনিরপেক্ষ), কিন্তু কখনোই তারা সেক্যুলার কাঠামোয় ছিল না। সমাজে একটা দরিদ্র ছেলে কীভাবে বড় হয়? রাষ্ট্র তো তাকে খাওয়ায় না, খাওয়ায় এতিমখানা।

রাষ্ট্র কখনোই তাদের দিকে দৃষ্টি দেয়নি। তাই তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য এই পথ তৈরি করে নিয়েছে। এখন অনেকেই হাহুতাশ করে বলেন যে বাঙালি সংস্কৃতি কেন হলো না? হলো না, কারণ গ্রামে কিংবা মফস্‌সলে তো আপনি সে সংলাপে যাননি।

আপনি লালন আর হাসনদের সমাজ থেকে তুলে এনে রাষ্ট্রে বসিয়ে দিয়েছেন, অথচ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ভেতর দিয়েই কিন্তু লালন বা হাসন রাজারা হয়ে উঠেছেন।

গ্রামের মানুষ তো ঢাকা শহরকেই রাষ্ট্র হিসেবে দেখে। তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের কেউ কিছু দেবে না। নিজেদের ব্যবস্থা তারা নিজেরাই করে নিয়েছে। নিজেদের একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে। সেখানে আধুনিক জামাকাপড় পরে কেউ গেলে তারা সন্দেহ আ বিদ্বেষের শিকার হয়। কারণ, গ্রামের মানুষ তাদের নিজেদের মতো সীমানা তৈরি করে নিয়েছে—তুমি ঢাকায় যা খুশি করো, এখানে করতে পারবে না।

একটা কথা কেউ জানে না, শাপলা চত্বরের ঘটনার পর বহু মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর খাওয়ার সুযোগ চলে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের কারণে সেখানে কাউকে টাকা দিতে দেওয়া হতো না।

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পতনের পর শাহবাগে জনতার উল্লাস, ৫ আগস্ট ২০২৪
ছবি: আশরাফুল আলম
প্রথম আলো:

মাজার তো গরিব মুসলমানের প্রতিষ্ঠান। এগুলো ভাঙল কারা?

মাহফুজ আলম: আমি বহু মাজার জিয়ারত করেছি। পীর-আউলিয়াদের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে। ঐতিহাসিকভাবেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলায় ইসলাম প্রচারের ও বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিক জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সুফি সাধকদের ভূমিকা অসামান্য।

পাশাপাশি আবার এ কথাও সত্য, গত ১৫ বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশন চালিয়েছে সুফিবাদের অনুসারী লোকেরা। তাদের বড় একটা অংশ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। ফলে মাজার ভাঙার ঘটনার পেছনে একটা রাজনৈতিক আক্রোশ আছে। এর মধ্যে ধর্মটা কেবল চোখে পড়েছে।

ধরুন, ফ্যাসিবাদের পক্ষে যদি লালনকে ব্যবহার করা হয়, তার জন্য তো লালন দায়ী নন। ফ্যাসিবাদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতীক ভেঙে ফেলা হয়েছে, সেটা একটা দিক। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যেকোনো কিছু ভাঙার বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্ষণশীল থেকে উদার অংশ পর্যন্ত যে ভাগ আছে, তাদের মধ্যে কার শক্তি বেশি? কেউ কেউ তো খেলাফতের কথাও বলছেন?

মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে খেলাফতের কথা প্রথম শুরু করেছেন হাফেজ্জী হুজুর। তাঁর দলের নামও ছিল খেলাফত আন্দোলন। তাঁর রাজনীতির একটা মজার পরিভাষা আছে—তওবার রাজনীতি। মানে, পূর্বেকার রাজনৈতিক ভুলগুলো থেকে তওবা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে হবে। এই পরিভাষাটা রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের। তাদের রাজনীতিটাও গণতান্ত্রিক নির্বাচনী রাজনীতিই।

খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। জামায়াতে ইসলামীও কিন্তু খেলাফতই চায়, কিন্তু কথা হলো কীভাবে? বুঝতে হবে যে বর্তমান যুগে রাষ্ট্র এমন একটা নিপীড়নমূলক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে, যার সঙ্গে কোনো ধর্মই যায় না।

ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে সমাজে রাজনীতির প্রতি তুমুল আগ্রহ এখন। একটি গ্রাফিতিতে সেটিই প্রকাশ পেয়েছে।
প্রথম আলো:

ধর্ম তো প্রাণবান ও চিন্তাশীল একজন মানুষের নিজের উপলব্ধির বিষয়। অথচ রাষ্ট্র একটা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান তো নিজের হয়ে কোনো ধর্ম বরণ করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হলো, ইসলামের সঙ্গে মানুষের সংযোগ তাহলে কোন পরিসরে হবে?

মাহফুজ আলম: সমাজ, সংস্কৃতি, আচার আর অভ্যাস হলো ধর্মের পরিসর। ধর্ম থেকে রাষ্ট্রে কেবল একটা বিষয়ই আসতে পারে, সেটা নৈতিকতা। তবে ইসলাম এমন একটা ধর্ম, যার রাজনৈতিক প্রস্তাবনা আছে। তার কেবল হাইপোথিসিসই (প্রস্তাবনা) নেই, প্রোটোটাইপও (আদিরূপ) আছে, যেমন তিরিশ বছরের খেলাফতের ইতিহাস।

তিরিশ বছরের না ধরেও আমি নাহয় কেবল রাসুল (সা.)-এর মদিনার তেরো বছরই ধরলাম। কিন্তু আদিরূপ যেহেতু একটা আছে, তাই এর স্বপ্ন কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের তাড়িয়ে বেড়াবে।

কিন্তু রাষ্ট্র যদি ইসলামকে জায়গা করে দিতে চায়, তাহলে তো ইসলামই সীমিত ও নিপীড়নের অনুষঙ্গ হয়ে যাবে। ইসলামি উম্মাহর ধারণা তো বিশ্বজনীন। জাতিরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেটা খাটে না। বিদ্যমান জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোয় ইসলাম বা শরিয়াহ বাস্তবায়ন অসম্ভব। সে কারণে এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে গিয়ে আলেমরা বলেছিলেন, শরিয়াহ মুখ্য নয়, প্রয়োজন হলো মাকাসিদ-উশ শরিয়াহ, যার মূল কথা জীবন-মালের হেফাজত করা। এবার তাহলে আপনি মানবাধিকারের আদিকল্পে প্রবেশ করলেন। মীমাংসাটা হতে হবে এখানেই।

যদি পুরোপুরি শরিয়াহর প্রশ্ন আসে, তাহলে শরিয়াহও পাওয়া যাবে না, রাষ্ট্রও না। রাষ্ট্র একটা ত্রিশঙ্কু দশায় পড়বে। এখানকার মুসলমানরা আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে যাবে। আলেমদের এটা বোঝা উচিত। রাষ্ট্রের ভেতরে ধর্মের মীমাংসা সেরে ফেলা উচিত।

প্রথম আলো:

যে রাষ্ট্রীয় পরিসরের কথা আপনি প্রস্তাব করছেন, সেখানে ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যদের স্থানটা কেমন হবে?

মাহফুজ আলম: সে পরিসরে নাগরিক হিসেবে অবশ্যই সবার সমান হিস্যা থাকতে হবে। রাষ্ট্রীয় পরিসরের দিক থেকে মৌলিক যে নাগরিক অধিকার, তা তো একজন মুসলমানের জন্য যা, একজন আহমদিয়া, হিন্দু, বৌদ্ধ, চাকমা, সংশয়বাদী বা অবিশ্বাসীর জন্যও একই হতে হবে।

রাষ্ট্রের নৈতিকতার প্রশ্নেও বৈষম্যমূলক কোনো ধারা থাকা যাবে না। এটাই আমার পর্যবেক্ষণ। আমাদের ছাত্রশক্তির প্রস্তাবনায় একটা বিষয় ছিল, এখনো আছে। সেটি হলো, প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব যেসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রকাশ রয়েছে, তাতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না।

প্রথম আলো:

আপনার নানা কথায় ইতিহাসের প্রসঙ্গ আসতে দেখছি। ১৯৪৭, ১৯৭১, ২০২৪—ইতিহাসের এই পর্বগুলোকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?

মাহফুজ আলম: ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় এক শ বছর নানা লড়াই করেছে, নানা প্রশ্নের মীমাংসা করার চেষ্টা করেছে—ভাষার, সংস্কৃতির, সমাজের। সংগীতকে, নাট্যকলাকে, নৃত্যকলাকে, নারীকে কীভাবে দেখবে, সেসব প্রশ্নেরও।

বেগম রোকেয়ারও আগে মির্জা দেলোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি ইসলাম থেকেই যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, নারীর শৃঙ্খলমুক্তি প্রয়োজন। মুতাজিলা নামে লেখালেখি করতেন বলে তাঁকে নাস্তিক বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

এসব কারণে ১৯৪৭ সালকে আমি দেখি বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মুক্তির জায়গা থেকে। মার্ক্সীয় ধারণায় অনেকে একে দেখেন একটি দরিদ্র ভূখণ্ডবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হিসেবে। মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা বলেন, ইসলামের জন্যই এটা করা হয়েছে। এর অনেক ব্যাখ্যাই থাকতে পারে।

১৯৪৭ সালকে আমি আরও দেখি বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে নিম্নবর্গের হিন্দুদের মৈত্রী হিসেবেও। এই মৈত্রী ধর্মীয় নয়, নাম-পরিচয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে জুলুম ও নিপীড়নের জায়গা থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মৈত্রী।

দুর্ভাগ্যজনক হলো, মৈত্রীর এই সম্ভাবনা ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় এলোমেলো হয়ে গেল। যোগেন মণ্ডল কলকাতায় চলে গেলেন। এটাও আমাদের ইতিহাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাজকরেখা।

১৯৭১ হয়েছিল বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের দুটি বোঝাপড়া থেকে। ১৯৪৭ সালের আগপর্যন্ত ইসলামের সঙ্গে তার যে বোঝাপড়া ছিল, সেটা বদলে গিয়েছিল। তারা বুঝতে শুরু করল, বাংলার ইসলাম পাকিস্তানের ইসলামের সঙ্গে যায় না, এমনকি উত্তর ভারতের ইসলামের সঙ্গেও নয়। ফলে তারা পাকিস্তানি ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়াল।

বিষয়টা বোঝার জন্য এ বি এম হাবিবুল্লাহ বা আবদুল করিমের মতো কিছু ইতিহাসবিদকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে বলে করি। তাঁরা এ বয়ান তৈরি করেছেন যে আমরা যেমন ভারতীয় নই, তেমনি পাকিস্তানিও নই। এখানকার মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, এখানে ইসলামেরও বিশিষ্ট একটা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক রূপ আছে। এই জনগোষ্ঠীর এমন একটা ঐতিহাসিক সংগ্রাম আছে, পাকিস্তানিরা যা সমর্থন করছে না।

মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের লড়াইটা যেমন পাকিস্তানিদের কবল থেকে মুক্তির লড়াই, তেমনই ভারতের কাছ থেকেও। দ্বিজাতিতত্ত্বের দোষটা সব সময় পাকিস্তানের ঘাড়ে চাপানো হয়; কিন্তু মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বইটির মৃত্যুপরবর্তী সংযোজনীতেই স্পষ্ট বোঝা গেল, ভারত কী চেয়েছিল, নেহরু-প্যাটেলইবা কী করেছিলেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে মানুষের মুক্তির যে স্বপ্ন ছিল, সেটা নিছক কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল না। আমি কেবল বলতে চাইছি, মুক্তির এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে নিপীড়িত বাঙালি মুসলমানরা কেন এত বড় ভূমিকা রাখল, সেটা আমাদের বোঝা দরকার।

প্রথম আলো:

আপনি কোথাও বলেছেন, ১৯৭১ আর ১৯৭২ এক নয়। কথাটা কি একটু ভেঙে বলবেন?

মাহফুজ আলম: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নগুলো ১৯৭২ সালের জগদ্দল পাথরে চাপা পড়েছিল। ১৯৭২ সালে জাতীয় মীমাংসাকে একরৈখিক করে ফেলা হলো।সেক্যুলারিজমের কথিত পরিসরের মধ্যে বৃহত্তর বাঙালি মুসলমান সমাজকে যুক্ত করার কোনো অবকাশই রাখা হলো না। ফলে ইসলামকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের রাজনীতি করার বিস্তর সুযোগ তৈরি হলো। রাষ্ট্রে রাখা হলো না কৃষক-শ্রমিকদেরও।

পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির মতোই আরেকটা শাসকশ্রেণি চেপে বসল। রাষ্ট্রায়ত্তকরণের নামে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হলো। আওয়ামী লীগের লোকদের হাতে রাষ্ট্রের সম্পদ তুলে দেওয়া হলো। এভাবে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো।

পুঁজিবাদের যে উত্থান ও বিস্তার এবং সম্পদের যে বিচলন ও বিতরণ বাংলাদেশে হয়েছে, তা এক বিপুল সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে বুর্জোয়া সমাজ বিকশিত হলো না কেন? রাষ্ট্র বা জাতিকে নিয়ে ভাববে—এমন একটা জাতীয় বুর্জোয়া সমাজ আমাদের কেন নেই? ১৯৭২ সাল থেকেই সেই আদর্শিক ফাঁদ তৈরি হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম
ছবি: খালেদ সরকার
প্রথম আলো:

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের যোগসূত্র কোথায়?

মাহফুজ আলম: ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে ১৯৭১ সালে উন্মেষ ঘটা জাতির বাসনা পুনর্বিবেচনার নতুন সুযোগ তৈরি হলো। আমাদের পূর্বপুরুষের লড়াই এবং লাখ লাখ শহীদের আত্মদানের পেছনে যে বাসনা ছিল, সেটা আমরা আবার বাস্তবায়নের সুযোগ পেলাম। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে মুজিববাদ ১৯৭১-এর বাসনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল।

আওয়ামী লীগের চশমাটা সরে যাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধকে আমরা এখন খোলাচোখে দেখার সুযোগ পাচ্ছি। শহীদ, বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের উপলব্ধি করার মতো অনেক কাছাকাছি জায়গায় চলে এসেছি। কারণ, আমরা তাঁদের মতো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই গিয়েছি।

প্রথম আলো:

এবার নতুন বর্তমান আর ভবিষ্যতের প্রসঙ্গে আসি। আপনারা সরকারেও আছেন, নাগরিক কমিটিতেও আছেন। আপনারা কি রাজনৈতিক দল গঠন করতে চলেছেন?

মাহফুজ আলম: একজন ব্যক্তি বা একটা গোষ্ঠী চাইলেই কি একটা দল গঠন করে ফেলতে পারে? দল করার প্রশ্নটা তো মানুষের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে।

প্রথম আলো:

এ রকম একটা দল হলে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এটা একটা কিংস পার্টি।

মাহফুজ আলম: কেন উঠবে? সরকারের কাছ থেকে কোনো অর্থ বা সহায়তা পেলে এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। তা তো তাঁরা নিচ্ছেন না। হ্যাঁ, আমাদের কেউ কেউ সরকারে আছে। তবে এখানে একটা পার্থক্যও আছে। কিংস পার্টি কথাটা উঠেছিল ২০০৭-০৮ সালে। তখন ছিল সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তার থেকে এই অন্তর্বর্তী সরকার একেবারে আলাদা। সামরিক বাহিনীর অবস্থানও এবার সে রকম নেই। এই সরকার বানিয়েছে বাংলাদেশের আপামর জনগণের সবাই মিলে। যে সরকার সব দল ও জনগণের, তার কিংস পার্টি বানানোর প্রশ্ন ওঠে কোত্থেকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর নাগরিক কমিটি নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব জন-আকাঙ্ক্ষা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আমি তো মনে করি, সবাই-ই তাদের সমর্থন দেবে।

প্রথম আলো:

আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, সম্প্রতি একটা জরিপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মানুষ ছাত্রদের প্রতি একটা রাজনৈতিক সমর্থন জানিয়েছে?

মাহফুজ আলম: ছাত্রদের প্রতি মানুষের একটা আগ্রহ জন্মেছে সত্যি। কারণ, রাজনীতিতে একটা শূন্যতা দেখা যাচ্ছে। বিএনপি বড় একটা দল, কিন্তু তারপর কারা? জামায়াত? জামায়াত নিজেও জানে, বেশি আসন তারা পাবে না। তার চেয়ে বড় কথা, একক কোনো দলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার ভয় সবার মধ্যে জেঁকে বসেছে। না জানি বিজয়ী দল আবার আওয়ামী লীগের মতোই হয়ে ওঠে।

এই পরিস্থিতি থেকে মানুষের বেরিয়ে যাওয়ার একটা ব্যগ্রতা তৈরি হয়েছে। তারা নতুন একটা রাজনৈতিক পরিসর খুঁজছে। মানুষ চায়, বিএনপি পরিশুদ্ধ হয়ে আসুক। জামায়াত তার ঐতিহাসিক দায়ভার আর ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ফেলে আসুক। আওয়ামী লীগও বিচার ও রিডেম্পশনের (দায়মোচন) পর তার উগ্র ফ্যাসিবাদ বা মুজিববাদ পরিত্যাগ করুক।

কিন্তু তাতেও আসল পরিস্থিতির মীমাংসা হবে না। বাংলাদেশে তরুণের সংখ্যা বিপুল। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংস্কার না করলে, আদর্শের প্রশ্নে বড় সংস্কার না করলে মানুষ কেন তাদের ভোট দেবে? ‘না’ ভোটের বিকল্প থাকলে সে সংখ্যা বরং বেড়ে যাবে।

প্রথম আলো:

নাগরিক কমিটিতে বিচিত্র মত ও পথের লোক দেখা যাচ্ছে। বাম-ডান-মধ্যপন্থী, মুসলমান-হিন্দু-খ্রিষ্ট্রন, বাঙালি-পাহাড়ি। এই বৈচিত্র্যকে মিলিয়ে দেওয়ার সাধারণ ভিত্তিটা কী?

মাহফুজ আলম: তাদের দিকে খোলাচোখে তাকালে আপনি পুরো বাংলাদেশের একটা প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন। এরাই বাংলাদেশ। ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ সালও এই এখানে এসে মিলেছে।

প্রথম আলো:

সামনের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে আপনি কেমন দেখতে পাচ্ছেন?

মাহফুজ আলম: বাংলাদেশের নাগরিকদের আত্মমর্যাদা পেতে হবে। রাষ্ট্রকেও। আত্মমর্যাদা খুব জরুরি একটা অধিকার। বিভিন্ন রাষ্ট্রে দু-তিন শ বছরের উপনিবেশের পর অনেকের প্রশ্ন ছিল, উপনিবেশ কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? অনেকে উত্তর দিয়েছিল, ইউরোপের শক্তি বেশি ছিল বলে। তখন কেউ কেউ বলেছিল, না, উপনিবেশ সম্ভব হয়েছিল নিজেদেরই কারণে। আমরা উপনিবেশিত হওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম। আমি এই মাত্রাটা নিয়েই কথা বলছি।

এই উপনিবেশিত হওয়ার দশা বদলাতে হলে আমাদের দরকার দায় ও দরদের রাজনীতি। দায় ও দরদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যদি আত্মমর্যাদা গড়ে তোলা যায়, তাহলে কেউ আর তাকে অধীন করতে পারবে না। ভেবে দেখুন তো, এতগুলো মানুষ যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তাহলে আমরা কোন জায়গায় চলে যেতে পারি।

সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব পড়ুন