আমরা এখন ইসলামপন্থী নানা দলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আপনি একে কীভাবে দেখছেন?
মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে যত ধরনের ইসলামপন্থী চিন্তাধারা আছে, গত ৫০ বছর তাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ না হওয়ায় সংক্ষুব্ধতার জন্ম হয়েছে। সংক্ষুব্ধতা মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে। যখন কেউ ভাবে যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তখন তার আর কী করার থাকে।
আমাদের শাসকগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের পরিচয় ছিল সেক্যুলার (ধর্মনিরপেক্ষ), কিন্তু কখনোই তারা সেক্যুলার কাঠামোয় ছিল না। সমাজে একটা দরিদ্র ছেলে কীভাবে বড় হয়? রাষ্ট্র তো তাকে খাওয়ায় না, খাওয়ায় এতিমখানা।
রাষ্ট্র কখনোই তাদের দিকে দৃষ্টি দেয়নি। তাই তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য এই পথ তৈরি করে নিয়েছে। এখন অনেকেই হাহুতাশ করে বলেন যে বাঙালি সংস্কৃতি কেন হলো না? হলো না, কারণ গ্রামে কিংবা মফস্সলে তো আপনি সে সংলাপে যাননি।
আপনি লালন আর হাসনদের সমাজ থেকে তুলে এনে রাষ্ট্রে বসিয়ে দিয়েছেন, অথচ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ভেতর দিয়েই কিন্তু লালন বা হাসন রাজারা হয়ে উঠেছেন।
গ্রামের মানুষ তো ঢাকা শহরকেই রাষ্ট্র হিসেবে দেখে। তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের কেউ কিছু দেবে না। নিজেদের ব্যবস্থা তারা নিজেরাই করে নিয়েছে। নিজেদের একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে। সেখানে আধুনিক জামাকাপড় পরে কেউ গেলে তারা সন্দেহ আ বিদ্বেষের শিকার হয়। কারণ, গ্রামের মানুষ তাদের নিজেদের মতো সীমানা তৈরি করে নিয়েছে—তুমি ঢাকায় যা খুশি করো, এখানে করতে পারবে না।
একটা কথা কেউ জানে না, শাপলা চত্বরের ঘটনার পর বহু মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর খাওয়ার সুযোগ চলে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের কারণে সেখানে কাউকে টাকা দিতে দেওয়া হতো না।
মাজার তো গরিব মুসলমানের প্রতিষ্ঠান। এগুলো ভাঙল কারা?
মাহফুজ আলম: আমি বহু মাজার জিয়ারত করেছি। পীর-আউলিয়াদের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে। ঐতিহাসিকভাবেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলায় ইসলাম প্রচারের ও বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিক জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সুফি সাধকদের ভূমিকা অসামান্য।
পাশাপাশি আবার এ কথাও সত্য, গত ১৫ বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশন চালিয়েছে সুফিবাদের অনুসারী লোকেরা। তাদের বড় একটা অংশ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। ফলে মাজার ভাঙার ঘটনার পেছনে একটা রাজনৈতিক আক্রোশ আছে। এর মধ্যে ধর্মটা কেবল চোখে পড়েছে।
ধরুন, ফ্যাসিবাদের পক্ষে যদি লালনকে ব্যবহার করা হয়, তার জন্য তো লালন দায়ী নন। ফ্যাসিবাদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতীক ভেঙে ফেলা হয়েছে, সেটা একটা দিক। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যেকোনো কিছু ভাঙার বিরুদ্ধে।
ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্ষণশীল থেকে উদার অংশ পর্যন্ত যে ভাগ আছে, তাদের মধ্যে কার শক্তি বেশি? কেউ কেউ তো খেলাফতের কথাও বলছেন?
মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে খেলাফতের কথা প্রথম শুরু করেছেন হাফেজ্জী হুজুর। তাঁর দলের নামও ছিল খেলাফত আন্দোলন। তাঁর রাজনীতির একটা মজার পরিভাষা আছে—তওবার রাজনীতি। মানে, পূর্বেকার রাজনৈতিক ভুলগুলো থেকে তওবা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে হবে। এই পরিভাষাটা রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের। তাদের রাজনীতিটাও গণতান্ত্রিক নির্বাচনী রাজনীতিই।
খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। জামায়াতে ইসলামীও কিন্তু খেলাফতই চায়, কিন্তু কথা হলো কীভাবে? বুঝতে হবে যে বর্তমান যুগে রাষ্ট্র এমন একটা নিপীড়নমূলক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে, যার সঙ্গে কোনো ধর্মই যায় না।
ধর্ম তো প্রাণবান ও চিন্তাশীল একজন মানুষের নিজের উপলব্ধির বিষয়। অথচ রাষ্ট্র একটা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান তো নিজের হয়ে কোনো ধর্ম বরণ করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হলো, ইসলামের সঙ্গে মানুষের সংযোগ তাহলে কোন পরিসরে হবে?
মাহফুজ আলম: সমাজ, সংস্কৃতি, আচার আর অভ্যাস হলো ধর্মের পরিসর। ধর্ম থেকে রাষ্ট্রে কেবল একটা বিষয়ই আসতে পারে, সেটা নৈতিকতা। তবে ইসলাম এমন একটা ধর্ম, যার রাজনৈতিক প্রস্তাবনা আছে। তার কেবল হাইপোথিসিসই (প্রস্তাবনা) নেই, প্রোটোটাইপও (আদিরূপ) আছে, যেমন তিরিশ বছরের খেলাফতের ইতিহাস।
তিরিশ বছরের না ধরেও আমি নাহয় কেবল রাসুল (সা.)-এর মদিনার তেরো বছরই ধরলাম। কিন্তু আদিরূপ যেহেতু একটা আছে, তাই এর স্বপ্ন কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের তাড়িয়ে বেড়াবে।
কিন্তু রাষ্ট্র যদি ইসলামকে জায়গা করে দিতে চায়, তাহলে তো ইসলামই সীমিত ও নিপীড়নের অনুষঙ্গ হয়ে যাবে। ইসলামি উম্মাহর ধারণা তো বিশ্বজনীন। জাতিরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেটা খাটে না। বিদ্যমান জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোয় ইসলাম বা শরিয়াহ বাস্তবায়ন অসম্ভব। সে কারণে এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে গিয়ে আলেমরা বলেছিলেন, শরিয়াহ মুখ্য নয়, প্রয়োজন হলো মাকাসিদ-উশ শরিয়াহ, যার মূল কথা জীবন-মালের হেফাজত করা। এবার তাহলে আপনি মানবাধিকারের আদিকল্পে প্রবেশ করলেন। মীমাংসাটা হতে হবে এখানেই।
যদি পুরোপুরি শরিয়াহর প্রশ্ন আসে, তাহলে শরিয়াহও পাওয়া যাবে না, রাষ্ট্রও না। রাষ্ট্র একটা ত্রিশঙ্কু দশায় পড়বে। এখানকার মুসলমানরা আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে যাবে। আলেমদের এটা বোঝা উচিত। রাষ্ট্রের ভেতরে ধর্মের মীমাংসা সেরে ফেলা উচিত।
যে রাষ্ট্রীয় পরিসরের কথা আপনি প্রস্তাব করছেন, সেখানে ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যদের স্থানটা কেমন হবে?
মাহফুজ আলম: সে পরিসরে নাগরিক হিসেবে অবশ্যই সবার সমান হিস্যা থাকতে হবে। রাষ্ট্রীয় পরিসরের দিক থেকে মৌলিক যে নাগরিক অধিকার, তা তো একজন মুসলমানের জন্য যা, একজন আহমদিয়া, হিন্দু, বৌদ্ধ, চাকমা, সংশয়বাদী বা অবিশ্বাসীর জন্যও একই হতে হবে।
রাষ্ট্রের নৈতিকতার প্রশ্নেও বৈষম্যমূলক কোনো ধারা থাকা যাবে না। এটাই আমার পর্যবেক্ষণ। আমাদের ছাত্রশক্তির প্রস্তাবনায় একটা বিষয় ছিল, এখনো আছে। সেটি হলো, প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব যেসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রকাশ রয়েছে, তাতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না।
আপনার নানা কথায় ইতিহাসের প্রসঙ্গ আসতে দেখছি। ১৯৪৭, ১৯৭১, ২০২৪—ইতিহাসের এই পর্বগুলোকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
মাহফুজ আলম: ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় এক শ বছর নানা লড়াই করেছে, নানা প্রশ্নের মীমাংসা করার চেষ্টা করেছে—ভাষার, সংস্কৃতির, সমাজের। সংগীতকে, নাট্যকলাকে, নৃত্যকলাকে, নারীকে কীভাবে দেখবে, সেসব প্রশ্নেরও।
বেগম রোকেয়ারও আগে মির্জা দেলোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি ইসলাম থেকেই যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, নারীর শৃঙ্খলমুক্তি প্রয়োজন। মুতাজিলা নামে লেখালেখি করতেন বলে তাঁকে নাস্তিক বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
এসব কারণে ১৯৪৭ সালকে আমি দেখি বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মুক্তির জায়গা থেকে। মার্ক্সীয় ধারণায় অনেকে একে দেখেন একটি দরিদ্র ভূখণ্ডবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হিসেবে। মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা বলেন, ইসলামের জন্যই এটা করা হয়েছে। এর অনেক ব্যাখ্যাই থাকতে পারে।
১৯৪৭ সালকে আমি আরও দেখি বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে নিম্নবর্গের হিন্দুদের মৈত্রী হিসেবেও। এই মৈত্রী ধর্মীয় নয়, নাম-পরিচয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে জুলুম ও নিপীড়নের জায়গা থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মৈত্রী।
দুর্ভাগ্যজনক হলো, মৈত্রীর এই সম্ভাবনা ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় এলোমেলো হয়ে গেল। যোগেন মণ্ডল কলকাতায় চলে গেলেন। এটাও আমাদের ইতিহাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাজকরেখা।
১৯৭১ হয়েছিল বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের দুটি বোঝাপড়া থেকে। ১৯৪৭ সালের আগপর্যন্ত ইসলামের সঙ্গে তার যে বোঝাপড়া ছিল, সেটা বদলে গিয়েছিল। তারা বুঝতে শুরু করল, বাংলার ইসলাম পাকিস্তানের ইসলামের সঙ্গে যায় না, এমনকি উত্তর ভারতের ইসলামের সঙ্গেও নয়। ফলে তারা পাকিস্তানি ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়াল।
বিষয়টা বোঝার জন্য এ বি এম হাবিবুল্লাহ বা আবদুল করিমের মতো কিছু ইতিহাসবিদকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে বলে করি। তাঁরা এ বয়ান তৈরি করেছেন যে আমরা যেমন ভারতীয় নই, তেমনি পাকিস্তানিও নই। এখানকার মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, এখানে ইসলামেরও বিশিষ্ট একটা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক রূপ আছে। এই জনগোষ্ঠীর এমন একটা ঐতিহাসিক সংগ্রাম আছে, পাকিস্তানিরা যা সমর্থন করছে না।
মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের লড়াইটা যেমন পাকিস্তানিদের কবল থেকে মুক্তির লড়াই, তেমনই ভারতের কাছ থেকেও। দ্বিজাতিতত্ত্বের দোষটা সব সময় পাকিস্তানের ঘাড়ে চাপানো হয়; কিন্তু মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বইটির মৃত্যুপরবর্তী সংযোজনীতেই স্পষ্ট বোঝা গেল, ভারত কী চেয়েছিল, নেহরু-প্যাটেলইবা কী করেছিলেন।
তবে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে মানুষের মুক্তির যে স্বপ্ন ছিল, সেটা নিছক কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল না। আমি কেবল বলতে চাইছি, মুক্তির এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে নিপীড়িত বাঙালি মুসলমানরা কেন এত বড় ভূমিকা রাখল, সেটা আমাদের বোঝা দরকার।
আপনি কোথাও বলেছেন, ১৯৭১ আর ১৯৭২ এক নয়। কথাটা কি একটু ভেঙে বলবেন?
মাহফুজ আলম: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নগুলো ১৯৭২ সালের জগদ্দল পাথরে চাপা পড়েছিল। ১৯৭২ সালে জাতীয় মীমাংসাকে একরৈখিক করে ফেলা হলো।সেক্যুলারিজমের কথিত পরিসরের মধ্যে বৃহত্তর বাঙালি মুসলমান সমাজকে যুক্ত করার কোনো অবকাশই রাখা হলো না। ফলে ইসলামকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের রাজনীতি করার বিস্তর সুযোগ তৈরি হলো। রাষ্ট্রে রাখা হলো না কৃষক-শ্রমিকদেরও।
পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির মতোই আরেকটা শাসকশ্রেণি চেপে বসল। রাষ্ট্রায়ত্তকরণের নামে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হলো। আওয়ামী লীগের লোকদের হাতে রাষ্ট্রের সম্পদ তুলে দেওয়া হলো। এভাবে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো।
পুঁজিবাদের যে উত্থান ও বিস্তার এবং সম্পদের যে বিচলন ও বিতরণ বাংলাদেশে হয়েছে, তা এক বিপুল সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে বুর্জোয়া সমাজ বিকশিত হলো না কেন? রাষ্ট্র বা জাতিকে নিয়ে ভাববে—এমন একটা জাতীয় বুর্জোয়া সমাজ আমাদের কেন নেই? ১৯৭২ সাল থেকেই সেই আদর্শিক ফাঁদ তৈরি হয়েছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের যোগসূত্র কোথায়?
মাহফুজ আলম: ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে ১৯৭১ সালে উন্মেষ ঘটা জাতির বাসনা পুনর্বিবেচনার নতুন সুযোগ তৈরি হলো। আমাদের পূর্বপুরুষের লড়াই এবং লাখ লাখ শহীদের আত্মদানের পেছনে যে বাসনা ছিল, সেটা আমরা আবার বাস্তবায়নের সুযোগ পেলাম। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে মুজিববাদ ১৯৭১-এর বাসনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল।
আওয়ামী লীগের চশমাটা সরে যাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধকে আমরা এখন খোলাচোখে দেখার সুযোগ পাচ্ছি। শহীদ, বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের উপলব্ধি করার মতো অনেক কাছাকাছি জায়গায় চলে এসেছি। কারণ, আমরা তাঁদের মতো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই গিয়েছি।
এবার নতুন বর্তমান আর ভবিষ্যতের প্রসঙ্গে আসি। আপনারা সরকারেও আছেন, নাগরিক কমিটিতেও আছেন। আপনারা কি রাজনৈতিক দল গঠন করতে চলেছেন?
মাহফুজ আলম: একজন ব্যক্তি বা একটা গোষ্ঠী চাইলেই কি একটা দল গঠন করে ফেলতে পারে? দল করার প্রশ্নটা তো মানুষের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে।
এ রকম একটা দল হলে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এটা একটা কিংস পার্টি।
মাহফুজ আলম: কেন উঠবে? সরকারের কাছ থেকে কোনো অর্থ বা সহায়তা পেলে এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। তা তো তাঁরা নিচ্ছেন না। হ্যাঁ, আমাদের কেউ কেউ সরকারে আছে। তবে এখানে একটা পার্থক্যও আছে। কিংস পার্টি কথাটা উঠেছিল ২০০৭-০৮ সালে। তখন ছিল সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তার থেকে এই অন্তর্বর্তী সরকার একেবারে আলাদা। সামরিক বাহিনীর অবস্থানও এবার সে রকম নেই। এই সরকার বানিয়েছে বাংলাদেশের আপামর জনগণের সবাই মিলে। যে সরকার সব দল ও জনগণের, তার কিংস পার্টি বানানোর প্রশ্ন ওঠে কোত্থেকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর নাগরিক কমিটি নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব জন-আকাঙ্ক্ষা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আমি তো মনে করি, সবাই-ই তাদের সমর্থন দেবে।
আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, সম্প্রতি একটা জরিপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মানুষ ছাত্রদের প্রতি একটা রাজনৈতিক সমর্থন জানিয়েছে?
মাহফুজ আলম: ছাত্রদের প্রতি মানুষের একটা আগ্রহ জন্মেছে সত্যি। কারণ, রাজনীতিতে একটা শূন্যতা দেখা যাচ্ছে। বিএনপি বড় একটা দল, কিন্তু তারপর কারা? জামায়াত? জামায়াত নিজেও জানে, বেশি আসন তারা পাবে না। তার চেয়ে বড় কথা, একক কোনো দলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার ভয় সবার মধ্যে জেঁকে বসেছে। না জানি বিজয়ী দল আবার আওয়ামী লীগের মতোই হয়ে ওঠে।
এই পরিস্থিতি থেকে মানুষের বেরিয়ে যাওয়ার একটা ব্যগ্রতা তৈরি হয়েছে। তারা নতুন একটা রাজনৈতিক পরিসর খুঁজছে। মানুষ চায়, বিএনপি পরিশুদ্ধ হয়ে আসুক। জামায়াত তার ঐতিহাসিক দায়ভার আর ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ফেলে আসুক। আওয়ামী লীগও বিচার ও রিডেম্পশনের (দায়মোচন) পর তার উগ্র ফ্যাসিবাদ বা মুজিববাদ পরিত্যাগ করুক।
কিন্তু তাতেও আসল পরিস্থিতির মীমাংসা হবে না। বাংলাদেশে তরুণের সংখ্যা বিপুল। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংস্কার না করলে, আদর্শের প্রশ্নে বড় সংস্কার না করলে মানুষ কেন তাদের ভোট দেবে? ‘না’ ভোটের বিকল্প থাকলে সে সংখ্যা বরং বেড়ে যাবে।
নাগরিক কমিটিতে বিচিত্র মত ও পথের লোক দেখা যাচ্ছে। বাম-ডান-মধ্যপন্থী, মুসলমান-হিন্দু-খ্রিষ্ট্রন, বাঙালি-পাহাড়ি। এই বৈচিত্র্যকে মিলিয়ে দেওয়ার সাধারণ ভিত্তিটা কী?
মাহফুজ আলম: তাদের দিকে খোলাচোখে তাকালে আপনি পুরো বাংলাদেশের একটা প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন। এরাই বাংলাদেশ। ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ সালও এই এখানে এসে মিলেছে।
সামনের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে আপনি কেমন দেখতে পাচ্ছেন?
মাহফুজ আলম: বাংলাদেশের নাগরিকদের আত্মমর্যাদা পেতে হবে। রাষ্ট্রকেও। আত্মমর্যাদা খুব জরুরি একটা অধিকার। বিভিন্ন রাষ্ট্রে দু-তিন শ বছরের উপনিবেশের পর অনেকের প্রশ্ন ছিল, উপনিবেশ কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? অনেকে উত্তর দিয়েছিল, ইউরোপের শক্তি বেশি ছিল বলে। তখন কেউ কেউ বলেছিল, না, উপনিবেশ সম্ভব হয়েছিল নিজেদেরই কারণে। আমরা উপনিবেশিত হওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম। আমি এই মাত্রাটা নিয়েই কথা বলছি।
এই উপনিবেশিত হওয়ার দশা বদলাতে হলে আমাদের দরকার দায় ও দরদের রাজনীতি। দায় ও দরদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যদি আত্মমর্যাদা গড়ে তোলা যায়, তাহলে কেউ আর তাকে অধীন করতে পারবে না। ভেবে দেখুন তো, এতগুলো মানুষ যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তাহলে আমরা কোন জায়গায় চলে যেতে পারি।
সাক্ষাৎকারের ১ম পর্ব
আন্দোলন দিয়েই শুরু করি। ছাত্ররা যে এত বড় একটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিল, তাদের মোর্চা দানা বাঁধল কী করে?
মাহফুজ আলম: ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বেশ বড় দুটো আন্দোলন হয়েছিল—নিরাপদ সড়ক আর কোটা সংস্কার নিয়ে। আন্দোলন দুটিতে দেখা গেল, রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করতে ছাত্র-তরুণদের একটা অংশ রাস্তায় নেমে পড়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ দেশের জনগণ আগেরবারের মতো আবারও প্রতারিত হলো। এর পরের দুই-তিন বছর নানা সংকটের কারণে ছাত্র-তরুণেরা আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
প্রধানতম সংকট ছিল রাজনৈতিক অভিমুখের অভাব। ছাত্র-তরুণেরা রাজনীতিতে বড় কয়েকটি দাগে বিভাজিত ছিল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, আর বামপন্থী রাজনীতির ক্ষীণ ধারার বাইরে তারা কিছু কল্পনা করতে পারছিল না।
আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির যে বয়ান আওয়ামী লীগ তৈরি করেছে, সেটি টিকিয়ে রেখে আওয়ামী লীগকে কখনোই পরাজিত করা যাবে না।
মুক্তিযুদ্ধের পরে আওয়ামী লীগের কারণে জাতীয়ভাবে রিকনসিলিয়েশন (পুনর্মিলন) না হতে পারা একটা বড় ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে শত্রু বানিয়ে রেখেছে। খালি চোখে আমরা হয়তো কেবল জামায়াত–শিবিরকে দেখব, কিন্তু তাদের নামে সব সময় বড় একটা জনগোষ্ঠী নিপীড়িত হয়েছে।
আমাদের মনে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে এত হাজার হাজার শিক্ষার্থী এসেছে, অগ্রজরা এসেছেন? ডাকসুর নির্বাচনের সময় নারীরা কেন এসেছেন? নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর স্কুলের ছেলেমেয়েদের আর কেন পাওয়া গেল না? কেন তাদের কেউ আর রাজনীতিতে নেই? কেন তারা রাষ্ট্র নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারল না?
আমরা দেখতে পেলাম, ভাবাদর্শ আর সাংস্কৃতিক ফল্টলাইনে (বিভাজক রেখায়) বাংলাদেশকে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। এই বিভাজক রেখা নিয়ে বিভিন্ন ক্রীড়নকেরা ভূমিকা রাখছে। আমাদের তাই চিন্তা ছিল এই বিভাজক রেখাকে কীভাবে মুছে ফেলা যায়, কীভাবে এর মীমাংসা করা যায়। গত ৫০ বছরে এর মীমাংসা হয়নি, কিন্তু আমাদের চেষ্টা ছিল।
আপনারা কী চেষ্টা করেছিলেন?
মাহফুজ আলম: আমরা কিছু পাঠচক্র ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করি। জোনাকি গলির কারখানার ব্যানারে ফিল্ম অ্যাকটিভিজিম করি। নাগরিক কমিটির বর্তমান আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সীমান্ত–হত্যা বন্ধের দাবিতে ৫৪ দিন একটানা রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান করেছিলেন। সে অবস্থানের সমর্থনে আমরা পুস্তিকা আর পত্রিকা বের করেছি।
আবার আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আটস্তম্ভ প্রস্তাব করেছিলাম। সেগুলোর ভাবার্থ ছিল নিছক ভারত–বিরোধিতা না করে কীভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
আমরা অনেকে মিলে পড়াশোনা করলাম, লেখালেখি করলাম, নানাজন নানা উদ্যোগ নিল, করোনাকালে অনলাইনে কিছু পাঠচক্র হলো। দেখলাম, এভাবে হচ্ছে না।
২০২১ সালে অক্টোবর মাসে আমরা ‘গুরুবার আড্ডা’ নামে পাঠচক্র শুরু করলাম। প্রথমে নাহিদ ইসলামসহ আমরা ছিলাম চারজন। পরে আবু বাকের মজুমদারসহ আরও তিনজন যুক্ত হলেন।
গুরুবার, মানে বৃহস্পতিবার আমাদের আড্ডাটা বসত। আমরা নানা প্রশ্ন নিয়ে ভাবতাম—রাষ্ট্র, সমাজ, দর্শন, ইতিহাস আর ধর্মতত্ত্ব, যেটা অনেকে বাদ দিয়ে যান। আমরা কামরুদ্দীন আহমেদের লেখা যেমন পড়েছি, তেমনই লেনিনের বা ইসলামি রাষ্ট্রভাবনার বাস্তবতা নিয়েও আলোচনা করেছি। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, ইকবালকে নিয়ে আলোচনা করেছি।
এভাবে আমরা চিন্তা ও সাংস্কৃতিক রাজনীতির ব্যবধান যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। অনেকটা আড়ালেই এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। আমরা ছাত্রলীগের চক্ষুশূল হতে চাইনি। ছাত্রদের বিভিন্ন আন্দোলনে আমরা ছিলাম। আবার বড় বড় আন্দোলন হলে তার তাত্ত্বিক ভিত্তি দেওয়ারও চেষ্টা করেছি। পরবর্তী সময়ে ‘গুরুবার আড্ডা’র সূত্রে ছয়চক্র ও রসিক আড্ডাসহ বেশ কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন একই লক্ষ্যে কাজ করেছে।
আন্দোলন শুরু হলো কীভাবে? আপনারা কী করে তাতে সম্পৃক্ত হলেন?
মাহফুজ আলম: ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আমরা পূর্বপক্ষ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে একটা সেমিনারের আয়োজন করেছিলাম। পূর্বপক্ষ–এর পাটাতন থেকে আমরা বললাম, আমরা দায় ও দরদের সমাজ চাই।
অনেকে হয়তো মনে করছেন, আমরা হুটহাট করে এসব কথা বলছি। সেটা কিন্তু মোটেই নয়। রাষ্ট্রের সভ্যতাগত রূপান্তর ইত্যাদি নিয়ে আমরা গত বছরই লিখেছি। আমরা ততক্ষণে ৬০টির মতো আড্ডা দিয়ে ফেলেছি। সেসব আড্ডার ভিত্তিতে আমাদের মনে হলো, এসব তুলে ধরে আমরা একটা নতুন রাজনীতির প্রস্তাব করতে পারি। আমরা সমাজে হাজির হতে পারি।
এ সময় নুরুল হক নূরের সংগঠনের একধরনের সংকট দেখা দিল। তাঁর সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশটি লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। সেটা ছিল অনেকটা ভাবনা আর কর্মতৎপরতার মেলবন্ধন।
ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে ছিল ছাত্র অধিকার পরিষদ, আর বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে ছিলাম আমরা। এই দুইয়ের সম্মিলনে গঠিত হলো গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি। আমরা ছাত্রশক্তির রাজনীতিতে যুক্ত না হয়ে বরং পূর্বপক্ষ, রণপা, সিনেযোগ পত্রিকা এবং ওই আড্ডাগুলোর মাধ্যমে চিন্তা ও সংস্কৃতির চর্চা করেছি। বুদ্ধিবৃত্তিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আর রাজনৈতিক কার্যক্রম আলাদা ছিল। আমরা রাজনৈতিক বয়ান নির্মাণ করতে নেপথ্যে লেখালেখি বা গবেষণা করতাম।
আন্দোলনের সূচনা হলো কোটা সংস্কার নিয়ে। একপর্যায়ে সেটা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফায় গিয়ে পৌঁছাল। ধাপে ধাপে আন্দোলনটা যে সেখানে গিয়ে পৌঁছাল, তার কি কোনো গোপন লক্ষ্য আগে থেকেই ছিল?
মাহফুজ আলম: আমাদের প্রাথমিক বাসনা ছিল সারা বাংলাদেশে ছাত্রশক্তিকে বিস্তৃত করা। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন হলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সুযোগ তৈরি হবে। কিছু নেতৃত্বও তুলে আনা যাবে। তবে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে সরকারের পতনের বিষয়টি তো ছিলই।
আমাদের ভাবনা ছিল ছাত্রশক্তি আগে শক্তিশালী হবে, তারপর আমরা রাজনৈতিকভাবে আবির্ভূত হব। সাংস্কৃতিক পরিসর, কলকারখানা, বিদ্যায়তন সবগুলো ক্ষেত্রেই আমরা সম্পৃক্ত হব।
আন্দোলনের ৫ জুন থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত সময়টা ছাত্রশক্তির সদস্যরা সমগ্র বাংলাদেশে আন্দোলনের সাংগঠনিক বিস্তার ঘটালেন। ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত আমরা সেই অর্থে কোনো রাজনৈতিক, এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থনও পাইনি৷
নানা রাজনৈতিক দল আর বুদ্ধিজীবীর কাছে আমরা গিয়েছি। কেউই উৎসাহী ছিল না। ভেবেছিল, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো আঁতাত আছে। কিন্তু অভিনব কর্মসূচির কারণে দিনে দিনে ক্যাম্পাসে আর নগরাঞ্চলে আন্দোলনের শক্তি বেড়ে যাচ্ছিল।
আমরা ভাবছিলাম, একে বড় একটা ছাত্র-নাগরিক আন্দোলনে পরিণত করে তোলা যায় কি না। আমাদের লক্ষ্য ছিল ২০২৬ সাল, কিন্তু সুযোগ তৈরি হলে এখনই কেন নয়!
কোন সময়ে মনে হলো যে সুযোগটা চলে এসেছে?
মাহফুজ আলম: ৬ জুলাই বাংলা ব্লকেড ঘোষণা করার পরে। বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিটা বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, এতে অনেক বেশি জনসম্পৃক্ততা ঘটে গেছে। আমরা সবাই মিলে ছাত্রশক্তির একটা ধারণাপত্র লিখেছিলাম। শুরুতে এ অভ্যুত্থানকে আমরা বলেছিলাম ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থান।
এর মূলে ছিল ছাত্রশক্তির ছাত্র-নাগরিক সংহতির ধারণা। সেই সংহতির পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি সাজানো হয়েছিল। কর্মসূচিটা বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ছাত্ররা চলে গেল। নাগরিকেরা এসে যোগ দিল। গত ১৬ বছরে কিন্তু এটা সম্ভবপর হয়নি।
সাধারণ মানুষ যে আপনাদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করছে, সেটা আপনারা কখন উপলব্ধি করলেন?
মাহফুজ আলম: বাংলা ব্লকেডের পরের সপ্তাহজুড়ে আমরা এটি বুঝতে পারি৷ আমাদের পরিকল্পনা ছিল জনগণকে পক্ষে নিয়ে আসার। গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর জনমুখী সংযোগ আমরা ঘটাতে পারিনি।
বাংলা ব্লকেডের মাধ্যমে ঢাকা শহরের জনসমর্থন আদায় করতে সমর্থ হলাম। এত দিন যারা প্রতিবাদ করতে পারেনি, তারা প্রতিবাদ জানাতে শুরু করল। সরকার তখনো ছাত্রদের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। আমরা সেই সুযোগটা গ্রহণ করেছি।
আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের সংহতি তত দিনে বাড়তে শুরু করেছে। ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে এসে সমন্বয়ক ও কর্মী হিসেবে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করলেন। আমরাও চেয়েছি সবাই থাকুক, গণ–আন্দোলন হোক।
আমাদের আশঙ্কা ছিল, এ আন্দোলন ব্যর্থ হলে ছাত্রশক্তিই বা কীভাবে টিকে থাকবে! ফলে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমরা স্লোগানগুলো বানাচ্ছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল স্লোগানগুলোকে জাতীয় স্তরে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। না হলে পরবর্তী সময়ে আমরা রাজনীতি করে টিকে থাকতে পারব না।
ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নানা স্তরের মানুষ যুক্ত হয়েছিল—ছাত্র, শ্রমিক, পাহাড়ি, নারী—বিচিত্র ধরনের। একজন অংশগ্রহণকারী ও নাগরিক হিসেবে সেখান থেকে আপনি কী পাঠ করলেন?
মাহফুজ আলম: এই গণ–অভ্যুত্থানকে আমি অনেক কিছুর মীমাংসা আকারে দেখি। সাংস্কৃতিক প্রশ্নে মীমাংসা, আদর্শিক প্রশ্নে মীমাংসা। বড় একটা স্ফুরণ ঘটিয়ে মীমাংসাগুলো হয়তো নানা দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছে। তবে অভ্যুত্থান নিজেই একটা বড়সড় মীমাংসা বা বন্দোবস্ত ছিল।
প্রশ্নটা অন্যভাবে করি। যেকোনো অভ্যুত্থানে দুইটা দিক থাকে—একটা পতন, আরেকটা পত্তন। প্রথমটা অর্জিত হয়েছে। পত্তনের অর্থে এই আন্দোলনে তো নাগরিকদের নানা আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। যদি জিজ্ঞেস করি, সব মিলিয়ে এই আন্দোলনের অলিখিত ইশতেহারটা কী, আপনি কী বলবেন?
মাহফুজ আলম: আকাঙ্ক্ষা যে সব সময় সোচ্চার ছিল, তা নয়। বহু আকাঙ্ক্ষা সুপ্তও ছিল। নতুন বাংলাদেশে অনেকেই অনেক কিছু দেখতে চায়। তরুণেরা প্রাথমিকভাবে চায় প্রতিনিধিত্ব। শুধু নির্বাচনে নয়, সবখানেই যেন তারা প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। তারা বাক্স্বাধীনতা চায়।
গণতান্ত্রিক শিল্পী-সাহিত্যিকেরা কথা বলতে চায়। দিনমজুর চায় তার প্রতিদিনের প্রাপ্য মজুরি। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরও নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা আছে। শুরুর দিকে না নামলেও পরের দিকে আলেমরা নেমে পড়ল। গোষ্ঠী আকারে গত ১৫ বছরে তারা নিপীড়িত হয়েছে।
আন্দোলনে যখন কমপ্লিট শাটডাউন চলছে, তখন শ্রমিকদের একটা বড় অংশকে আমরা দেখলাম। ১৫ বছর ধরে শ্রেণি আকারে তারা নিপীড়িত হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে চারজন শ্রমিককে মেরে ফেলা হয়। তাজরীন ফ্যাশন বা রানা প্লাজার ঘটনায় তারা বিক্ষুব্ধ ছিল। সবাই একটা চূড়ান্ত বদ্ধ দশা থেকে মুক্তি চাইছিল। নইলে কি কেউ মরার জন্য বুলেটের সামনে বুক পেতে দেয়?
এই আন্দোলনে মেয়েদের সম্পৃক্ততা ছিল বিরাট। এখন অনেকে ভুলে গেলেও এ কথাটা সত্য যে মেয়েরা না থাকলে এই আন্দোলন কোনোভাবেই সফল হতো না। ১০ শতাংশ কোটা থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা এসে বলল, আমরা কোটা চাই না। কেন? কারণ তাদের আত্মমর্যাদায় লাগছিল। আত্মমর্যাদা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শেখ হাসিনা দেশের আপামর মানুষের আত্মমর্যাদা ভেঙে ফেলেছিল।
এই লড়াইটা আত্মমর্যাদাবোধেরও ছিল। আন্দোলনকারীরা যে নিজেদের ‘রাজাকার’ হিসেবে স্লোগান দিল, সেটা কিন্তু ‘রাজাকার’ বলে তাদের আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত দেওয়া হয়েছে বলেই। সুতরাং এ আন্দোলনকে আপনি মর্যাদাবোধের পুনরুদ্ধার প্রকল্প আর নানা শ্রেণি–আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিনিধিত্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও দেখতে পারেন।
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা শোনা যাচ্ছে। অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে নাগরিকেরা কোন ধরনের রাষ্ট্র দেখতে চাইছে?
মাহফুজ আলম: রাষ্ট্রের একটা থাকে ওপরের দিক, আরেকটা অন্তস্তলের দিক। অন্তস্তলই ওপরের দিকটা ঠিক করে দেয়। তাই সেটা ঠিক না করে উপরিতল ঠিক করার অর্থ হলো পুরোনো ময়লার ওপর নতুন চাদর বিছিয়ে দেওয়া। মানুষ এটা চায় বলে মনে করি না। আমিও নই।
মানুষ বড় ধরনের পরিবর্তন চাইছে; কেবল ক্ষমতার পালাবদলের নয়, বরং ক্ষমতা–কাঠামোর পালাবদলের বন্দোবস্ত। তারা চায় আত্মসম্মান আর বৈষম্যহীনতা বা সমতা। সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত জায়গায় বিভাজনের রাজনীতির একটা মীমাংসা তারা চায়। এমন এক পরিসর চায় যেখানে সবাই সবার কথা বলতে পারবে, প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে। কোনো রকমের যদি আর কিন্তু ছাড়াই মৌলিক মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকার তারা ভোগ করবে।
এগুলোই নাগরিকদের প্রত্যাশা। ভাবাদর্শিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক—মোটা দাগে আগের সরকারের এই চারটি বন্দোবস্তকে পরিপূর্ণভাবে ফেলে দিয়ে নতুন বন্দোবস্তের দিকে যেতে হবে।
আপনারা বলছেন পুরোনো ব্যবস্থা বহাল রেখে নির্বাচনে গেলে অন্য দল এলেও তারা অগণতান্ত্রিক রূপ ধারণ করবে। এ অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানকে আপনি কী চোখে দেখছেন?
মাহফুজ আলম: বিএনপি ও জামায়াত গত ১৫ বছরে অনেক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তারা এখন ক্ষমতার হিস্যা নিতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার যারা বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষায় গণ–অভ্যুত্থান করেছে, তারাও যে আন্তদলীয় সংস্কার চাইবে, এটাও তো স্বাভাবিক।
প্রশ্ন হলো, আন্দোলনের বিন্যাসটা কী? কেউ কেউ এসে দাবি করছে, এই আন্দোলনে একমাত্র তারাই ছিল। কিন্তু একমাত্র বলে তো কেউই ছিল না। আন্দোলনটা ছিল প্রবহমান নদীর মতো। নানা স্রোত এসে তাতে মিশেছে। এখন যমুনা আর মেঘনার স্রোতোধারার সব আলাদা আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এর মধ্যেও তো একটা ঐক্য আছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পুরোনো অভ্যাস ও সংস্কৃতি বজায় রাখতে চাইবে। অথচ আমাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তন করতে হবে, দলগুলোতে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে।
তরুণেরা বাংলাদেশে প্রচলিত ক্লাব রাজনীতি চাইছে না। তাদের চাওয়া দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কীভাবে রাজনৈতিক পরিসরে একত্রিত করা যায়, তারা সে কথা ভাবছে। আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহযোদ্ধারা যদি রাজনৈতিক দল গঠন করে, তাহলে তারাসহ প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে আমরা আহ্বান জানাতে পারি, নিছক ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ছেড়ে তারা যেন রাষ্ট্র গঠনের দৃষ্টিভঙ্গিটা নিয়ে আসে।
আগে প্রতিযোগিতা ছিল কে কার আগে ক্ষমতায় বসতে পারে, লুটপাট করতে পারে। এখন প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত দেশকে কে কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশকে সামনে রেখেই রাজনীতি গোছানো উচিত।
কেবল রাষ্ট্র সংস্কার করলেই তো হবে না। দলগুলোর ভেতরেও সংস্কার দরকার। রাজনৈতিক নেতৃত্ব কীভাবে নির্বাচিত হবে, তার প্রক্রিয়া সংস্কার করা উচিত। তাদের অর্থনৈতিক সংস্কারেরও প্রয়োজন। দলগুলোর বিশুদ্ধিকরণের জন্য সামাজিক চাপ তৈরি করতে হবে। পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর বদভ্যাস জিইয়ে রাখার জন্য তো এত মানুষ জীবন দেয়নি।