২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বিশেষ সাক্ষাৎকার: আলী আহমেদ খান 

ভবনমালিকেরা আইন না মানলে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে

বেইলি রোডের একটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জন মারা গেছেন। এই দুর্ঘটনা কি এড়ানো যেত? কোনো কারণে আগুন লাগলেও এত মানুষের মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল? নগরবাসীর নিরাপত্তায় আমাদের করণীয় কী। এসব প্রশ্ন নিয়ে প্রথম আলো মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খানের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রথম আলো:

বেইলি রোডের একটি ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জন মানুষ মারা গেলেন। এই দুর্ঘটনার দায় কার?

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান: ঢাকা শহরে অনেক ভবন গড়ে উঠেছে আইনকানুন না মেনে। বেইলি রোডের দুর্ঘটনাকবলিত ভবনে যদি বহির্গমনের সুযোগ থাকত, এতগুলো মানুষ মারা যেতেন না। নিচের তলায় আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ওপরের তলার মানুষগুলো বেরিয়ে যেতে পারতেন। মার্কেট বা রেস্তোরাঁয় ঝুঁকি বেশি থাকে। ফলে ছোট্ট একটি ভুলে বড় ক্ষতি হয়ে গেল। এটা অবহেলাজনিত মৃত্যু। একধরনের হত্যাকাণ্ড।

প্রথম আলো:

এত দুর্ঘটনার জন্য কাকে দায়ী করবেন?

আলী আহমেদ খান: অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। একটি আধুনিক শহরে হাইড্রেন্ট সিস্টেম থাকে, যেখান থেকে দ্রুত পানি টেনে নেভানোর কাজে লাগানো যায়। ঢাকায় পানির উৎস অত্যন্ত সীমিত। হাইড্রেন্ট থাকাটা নগর-পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত। আধুনিক শহরে বহুতল ভবনে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ বাহিনীও থাকে, যা আমাদের নেই।

প্রথম আলো:

ভবনটিতে অনেকগুলো রেস্তোরাঁ থাকলেও অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ছিল না। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস থেকে তিনবার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। রাজউকও আপত্তি করেছিল।

আলী আহমেদ খান: দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের এখানে নিরাপত্তা-সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। মালিকেরা যেকোনোভাবে একটি ভবন বানিয়ে ভাড়া দেন। সেখানে সুরক্ষাব্যবস্থা আছে কি না, দেখেন না। এসব ভবনে বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে কি না, সেটা দেখার জন্য একাধিক রেগুলেটরি বডি আছে। আমি মনে করি, নোটিশ দেওয়া বা সতর্ক করাই যথেষ্ট নয়। কেউ আইন ভাঙলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রথম আলো:

এ ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস কি তাদের দায়িত্ব পালন করেছে? 

আলী আহমেদ খান: সমস্যা হলো, ভবন পরিদর্শন ও তদারক করার জন্য যে লোকবল থাকার কথা, তা ফায়ার সার্ভিসের নেই। তাদের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট নেই। মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হতে হয়। অনেক সময় লোকবল চেয়েও পাওয়া যায় না। 

প্রথম আলো:

বাধাটি কি প্রশাসনিক, না অন্য কিছু?

আলী আহমেদ খান: আইনি ও প্রশাসনিক দুই বাধাই আছে। ভবন সুরক্ষার সঙ্গে অনেকগুলো সংস্থা কাজ করে। যেমন রাজউক, সিটি করপোরেশন, অগ্নিনির্বাপণ বিভাগ। কিন্তু এদের আইন যেমন ভিন্ন, তেমনি কাজেও সমন্বয়হীনতা আছে। নিরাপত্তার বিষয়টি ফায়ার সার্ভিস দেখে। ট্রেড লাইসেন্স দেয় সিটি করপোরেশন। রাজউকের দায়িত্ব বিল্ডিং কোড মেনে করা হয়েছে কি না, সেটি দেখা। ভবনের মালিকেরা একেক সংস্থাকে একেকভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিরাপত্তার দিকটি উপেক্ষিত থেকে যায়। দেশে হাজারো ভবন তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে অগ্নিনির্বাপণ বিভাগকে না জানিয়ে। 

প্রথম আলো:

তাহলে এভাবেই আগুনে পুড়ে মানুষ মরতে থাকবে? 

আলী আহমেদ খান: না, তা হবে কেন? প্রতিটি দুর্ঘটনা দুঃখজনক। আবার তা অভিজ্ঞতা অর্জনেরও সুযোগ এনে দেয়। তাজরীন ও রানা প্লাজার পর ক্রেতাদের চাপে বিরাট পরিবর্তন এসেছে তৈরি পোশাক খাতে। সেখানে দুর্ঘটনা হলেও মানুষ মারা যাওয়ার সংখ্যা কমেছে। একই অভিজ্ঞতা অন্য ক্ষেত্রেও আমরা কাজে লাগাতে পারি।

প্রথম আলো:

ফায়ার সার্ভিস আধুনিকায়নের কথা বলা হচ্ছে অনেক দিন আগে থেকে। কতটা আধুনিক হলো? 

আলী আহমেদ খান: ফায়ার সার্ভিস দুই ধরনের কাজ করে। প্রথমত, দুর্ঘটনা হলে উদ্ধার অভিযান চালানো। সেখানে অগ্রগতি আছে। অগ্নিনির্বাপণ দল এ কাজে মোটামুটি সক্ষমতা দেখাতে পেরেছে। যদিও লোকবল কম। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল সবল হলেও প্রতিরোধ বা প্রিভেন্টিভ উইং দুর্বল। ফায়ার সার্ভিস সংস্কারের যে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সেটা হবেও না। এ ছাড়া এই খাতে বাজেট ও লোকবলও কম। উন্নত দেশগুলোতে প্রতি এক হাজার জনের জন্য একজন অগ্নিনির্বাপণকর্মী থাকে। আমাদের তা নেই। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি একাডেমি করার কথা ছিল, সেটাও হয়নি। 

প্রথম আলো:

তদারকি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করার উপায় কী? 

আলী আহমেদ খান: ভবন সুরক্ষার জন্য যেসব সংস্থা কাজ করে, তাদের সমন্বিত কোনো কমিটি নেই। সংস্থাগুলো নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কাছে দায়বদ্ধ। এসব মন্ত্রণালয়ের যাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তাঁরা আজ আছেন, কাল নেই। অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে যান। ফলে অনেক সিদ্ধান্তই ঝুলে থাকে। বিদেশে ফায়ার সার্ভিসকে তো খুবই শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবা হয়। সেভাবে বাজেট ও লোকবল দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আগুনের দুর্ঘটনা কমাতে হলে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা ও জবাবদিহি—দুটোই বাড়াতে হবে। মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যে পলিসি গাইডলাইন থাকার কথা, সেটা নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ডিজিটাল মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান করে সমন্বয়হীনতা দূর করা সম্ভব। প্রতিটি সংস্থা অন্য সংস্থার হালনাগাদ তথ্য পাবে। এর মাধ্যমে তারা জানতে পারবে কোন ভবনে কী সমস্যা আছে। সমস্যা জানলেই সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে।

প্রথম আলো:

প্রতিটি দুর্ঘটনার পর একাধিক তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু সেই কমিটির প্রতিবেদন জনগণ দেখতে পায় না বলে অভিযোগ আছে। কমিটির সুপারিশগুলো আদৌ বাস্তবায়িত হয় কি?

আলী আহমেদ খান: সবটা না হলেও বেশ কিছু কমিটির প্রতিবেদন তো প্রকাশ করা হয়। কিছু কিছু সুপারিশও বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। কমিটিগুলো নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কাছে দায়বদ্ধ এবং তাদের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়ে থাকে। সুপারিশগুলোর ফলোআপ করা হয় না। সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই দুর্ঘটনা রোধ বা কমানো সম্ভব।

প্রথম আলো:

চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনার পর পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কার্যকর হলো না কেন? 

আলী আহমেদ খান: চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনার সময় আমি মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলাম। সে সময় অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর সঙ্গে যেসব মন্ত্রণালয় জড়িত—শিল্প, স্থানীয় সরকার, বাণিজ্য ইত্যাদির মধ্যে যে সমন্বয়ের কথা ছিল, সেটি কতটা হয়েছে, সন্দেহ আছে। ব্যবসায়ীরা যেতে চান না, সেটা যুক্তি হতে পারে না। যাঁরা আইন মানছেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি হেলাফেলাভাবে দেখা উচিত নয়। মামলা হলে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো শাস্তিও হয়। কিন্তু আইন লঙ্ঘন করে ভবনমালিকেরা বছরের পর বছর ব্যবসা চালিয়ে যাবেন এবং মানুষকে নিরাপত্তাঝুঁকিতে ফেলবেন, এটা চলতে পারে না। প্রয়োজনে টাস্কফোর্স গঠন করে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তঁাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।  

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আলী আহমেদ খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।