সাক্ষাৎকার

রাষ্ট্রীয় শোক পালনের চেষ্টা একটি প্রহসন

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। পরবর্তী সময়ে এটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও ছড়িয়ে পড়ে। এ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এবং এখনকার করণীয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম

প্রথম আলো:

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনটি ছিল মূলত বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। তাদের সেই আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার মধ্য দিয়ে সহিংসতা শুরু হয়েছিল। এরপর হলে হলে সংঘর্ষ, ক্যাম্পাসে পুলিশ-বিজিবি মোতায়েন, ছাত্রদের হল ছাড়তে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাগুলোকে কীভাবে দেখছেন? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সামিনা লুৎফা: ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা শুরু থেকেই সুসংগঠিত ও শান্তিপূর্ণ ছিলেন। তাঁদের আন্দোলনের গতি বাড়ছিল জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকেই।

এর মধ্যে ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান একটি স্লোগানের মধ্য দিয়ে, যা কিছুক্ষণের মধ্যে বদলেও ফেলা হয়। সরকার আন্দোলনকে অপরাধীকরণের (ক্রিমিনালাইজেশন) চেষ্টা করছিল। এ ঘটনায় সে রকম একটা সুযোগ তৈরি হয়।

এরপর ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সাধারণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠি, রড ইত্যাদি নিয়ে হামলা চালায়। হামলায় অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো দখলে রাখা ছাত্রলীগের নেতাদের বিভিন্ন হল থেকে বের করে দেওয়া শুরু হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক অবৈধ ও এখতিয়ারবহির্ভূত নির্দেশ তাদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাস করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি দিয়ে টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড মেরে শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যার মধ্যে হলছাড়া করা হয়। বের হয়েই শিক্ষার্থীরা পড়েন অপেক্ষারত সন্ত্রাসীদের হাতে এবং পথে পথে নিপীড়নের শিকার হন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসকেরা (উপাচার্য, প্রক্টর, প্রভোস্ট) শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা না দিয়ে, তাদের নিরাপদে ক্যাম্পাস ছাড়ার সুযোগ সৃষ্টি না করে তাদের রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কক্ষ ভাঙচুর হয়েছে সে দায়ও প্রশাসনের। তারা যে বহু আগেই শিক্ষকদের হাতে থাকা উচিত এমন দায়িত্ব (যেমন হল চালানো) ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে দিয়ে বসেছিলেন, এসব তারই ফলমাত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসকদের লজ্জা থাকলে তাদের ১৭ জুলাই পদত্যাগ করা উচিত ছিল। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন সত্যিকারের শিক্ষকসুলভ আচরণ করেছেন। প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়াতে যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও সাধুবাদযোগ্য।

প্রথম আলো:

এই আন্দোলন-বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার খবর জানা গেছে। এ ছাড়া কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবি মোতায়েন করেও কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেনা মোতায়েন ও কারফিউ জারি করতে হয়েছে। পুরো পরিস্থিতিটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

সামিনা লুৎফা: সাধারণত অগণতান্ত্রিক সরকারগুলো যেকোনো আন্দোলনকে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ব্যবহার করে আন্দোলন একেবারে নস্যাৎ করতে চায়। কারণ, তাদের ভয় থাকে যেকোনো প্রতিবাদ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।

সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের চেষ্টা ছাড়া গত সাত দিন আমরা আর কিছুই দেখিনি। যেখানে নিহতের সংখ্যা গণনা শেষ হয়নি, হয়রানিমূলক মামলায় আন্দোলনকারীদেরই আটক করা হচ্ছে হাজার হাজার, আটকের ভয়ে হাসপাতাল ছাড়ছেন আহত শিক্ষার্থীরা, উঠিয়ে নিয়ে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে আন্দোলনের সমন্বয়কদের।

হেলিকপ্টার থেকে যেভাবে গুলি চালানো, আন্দোলনরত বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি ছোড়া, আহত মানুষকে কাছ থেকে গুলি করা, পথচলতি মানুষকে পেছন থেকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করা, নির্মাণাধীন ভবনে ঝুলে থাকা তরুণকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করতে করতে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করার মতো ঘটনার ভিডিও দেখে আমরা স্তম্ভিত, হতবাক, বিক্ষুব্ধ।

এটি তো কোনো যুদ্ধাবস্থা নয়, বেসামরিক নাগরিকেরা আন্দোলন করছিলেন। সেই আন্দোলন দমন করতে, এমন বল প্রয়োগের উদাহরণ ইতিহাসে নেই। এর মধ্যে জাতিসংঘ ক্ষোভ জানিয়েছে, সারা বিশ্বে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এবং বৈশ্বিক নাগরিকেরা এ হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানিয়েছেন।

প্রথম আলো:

শুধু চাকরিপ্রার্থীরা নয়, সমাজের অন্য শ্রেণির মানুষেরাও এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে এ আন্দোলনকে কীভাবে দেখছেন? আমাদের রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজে কি কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে?

সামিনা লুৎফা: ২০২৪–এর কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে ‘ব্যাকল্যাশ’ বিক্ষোভ যা পরবর্তীতে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে।

পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকা সরকার, ছাত্রলীগ, পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব দিয়ে অতিরিক্ত ও অবৈধ শক্তি প্রয়োগ করেছে। কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করেও এ আন্দোলনকে দমন করা যায়নি।

ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট, ব্লক রেইড, গণগ্রেপ্তার ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এর পরও জনগণের প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে আজ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে।

প্রথম আলো:

আন্দোলনে সহিংসতা, নাশকতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগ আনা হয়েছে, মামলা করা হয়েছে। গত কয়েক দিনে বেশ কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেককেই রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন। এগুলোর ফলাফল কী হবে বলে মনে করেন?

সামিনা লুৎফা: বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবমূর্তির যে চিরস্থায়ী ক্ষতি এ সরকারের অদূরদর্শিতা ও হঠকারিতার জন্য সাধিত হলো তার প্রভাব হবে গভীর ও সুদূরপ্রসারী। দেশের শত শত মানুষের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আজ সরকারের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের চেষ্টা এক ভয়ানক প্রহসন যা শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সরকারি বাহিনীর প্রতিটি মিথ্যাচার, প্রহসন, আর ‘পি আর ক্যাম্পেইন’–এর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী-জনতার যে ঐক্য দাঁড়াচ্ছে, তার শক্তি সাধারণ নাগরিকেরা টের পাচ্ছেন; কিন্তু সরকার কি সেটা পাচ্ছে? পেলে তাদের দমন-পীড়ন বন্ধ করে শান্তির পথে, মিথ্যাচার বন্ধ করে ক্ষমা চাওয়ার পথে আসতে হবে।

সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের পথে, মানবতার পথে আসতে হবে। নতুবা এ প্রজন্মের আস্থা তারা আর ফিরে পাবেন না। এখন আর এটা কোটা সংস্কার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই। এখন ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডের’ বিচারের দাবি উঠেছে।