বিশেষ সাক্ষাৎকার: মাহবুবউল্লাহ

৭ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন হলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে

নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। তফসিল অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হওয়ার কথা। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এই তফসিলকে স্বাগত জানালেও বিএনপি ও সমমনা দলগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবউল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

মাহবুবউল্লাহ
প্রশ্ন:

নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করল। সরকারি দল ও তাদের সঙ্গীরা তফসিলকে স্বাগত জানালেও বিএনপি ও সমমনা দলগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

মাহবুবউল্লাহ: আমাদের দেশে যখন বাজেট পেশ করা হয়, সরকারি ও বিরোধী দলকে ভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখি। সরকারি দল বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দমিছিল করে। আর বিরোধী দল একে গরিব মারার বাজেট বলে প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাচনী তফসিলের বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থান নিলে বুঝতে হবে, জাতির বিভক্তিটা কত গভীর।

প্রশ্ন:

বিএনপিসহ কয়েকটি দল তো নির্বাচন কমিশনকেই মানেনি। সরকারের পাশাপাশি তারা বর্তমান কমিশনেরও পদত্যাগ দাবি করছে।

মাহবুবউল্লাহ: নির্বাচন কমিশন তাদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল কয়েক দিন আগে বললেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। এরপরই তাঁকে বলতে শুনলাম, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আছে। যেকোনো মূল্যে নির্বাচন হবে। এসব কথাবার্তায় ইসির প্রতি জনগণও আস্থা রাখতে পারছে না। দুই দলের মধ্যে যে চরম অবিশ্বাস, এটা আরও ছড়াতে থাকলে দেশের অবস্থা ভয়াবহ হবে। এমনও দিন আসতে পারে, হয়তো নির্বাচন কমিশনেরই আর প্রয়োজন হবে না।

প্রশ্ন:

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও সমঝোতার কোনো উপায় আছে কি না? প্রধান নির্বাচন কমিশনারও জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় সমঝোতা ও সংলাপের ওপর জোর দিয়েছেন।

মাহবুবউল্লাহ: সমঝোতা তো সব সময়ই হতে পারে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। চার–পাঁচ মাস ধরে সরকারি দলের নেতারা বিরোধী দল সম্পর্কে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে সমঝোতার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। রাজনীতিতে যখন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ প্রকট হয়, তখন এর প্রতিকার কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রশ্ন:

তাহলে সমাধান কী?

মাহবুবউল্লাহ: এর সমাধান তো আমরা দিতে পারব না। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই সমাধান বের করতে হবে। তারা দেশকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

প্রশ্ন:

২৮ অক্টোবর যে অঘটন ঘটল, তা এড়ানোর সুযোগ ছিল কি না।

মাহবুবউল্লাহ: আমি মনে করি, এই অঘটন ঘটানোর কোনো দরকারই ছিল না। সেদিন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে উসকানি দেওয়া হয়েছে বলে সরকার যে অভিযোগ করে, তা সত্য নয়। ঘটনা যখন ঘটল, তখনো বিএনপির মহাসমাবেশে লোকজন আসছিল। কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ বক্তৃতাও দেননি। তখনই পুলিশের অভিযান শুরু হয়। কোনো রাজনৈতিক দলই চাইবে না, তাদের সমাবেশটি পণ্ড হয়ে যাক।

প্রশ্ন:

কিন্তু আমরা তো দেখলাম বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিক্ষোভের সময় প্রধান বিচারপতির বাড়ির সামনে ভাঙচুর হলো। একজন পুলিশ সদস্য মারা গেলেন।

মাহবুবউল্লাহ: এসব যে বিরোধী দলের নেতা–কর্মীরা করেছেন, তা প্রমাণিত নয়। কে কোথায় আক্রমণ শুরু করল, সেটা প্রমাণ করা কঠিন। অনেক সময় আন্দোলনকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে নাশকতার ঘটনা ঘটানো হয়। ২৮ অক্টোবর সেটাই হয়েছে। সেদিন বিএনপির সমাবেশে বিপুলসংখ্যক লোক এসেছে। তাহলে তারা কেন সমাবেশ পণ্ড করতে চাইবে?

প্রশ্ন:

২৮ অক্টোবরের পর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেপ্তার হলেও নেতা-কর্মীদের সেভাবে রাজপথে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।

মাহবুবউল্লাহ: একদিকে আমরা বলছি সহিংস রাজনীতি চাই না। আবার রাস্তায় কঠিন কর্মসূচি না থাকলে সমালোচনা করি। এর মাধ্যমে কি আমরা সহিংসতাকেই উসকে দিচ্ছি না? এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন:

তাহলে বাংলাদেশ কি ২০১৪ সালের মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন পেতে যাচ্ছে?

মাহবুবউল্লাহ: অনেকে তা-ই মনে করছেন। এমনকি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও বলছে বাংলাদেশে দ্বিতীয় বাকশাল হতে যাচ্ছে। এটাই যদি বাংলাদেশের গন্তব্য হয়, এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে। প্রথমবার বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। আমরা কি বারবার গণতন্ত্র হারাব আর পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম চালাতে থাকব? মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশের মানুষের কাছে গণতন্ত্র অত্যন্ত প্রিয়। এখানকার মানুষ গণতন্ত্রের জন্য অনেক সংগ্রাম করেছে। চুয়ান্নর নির্বাচনের সময় কোনো নির্বাচন কমিশন ছিল না। প্রশাসনই নির্বাচন পরিচালনা করেছিল। আজ ‘শক্তিশালী’ নির্বাচন কমিশন করেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা যাচ্ছে না। গণতান্ত্রিক চেতনাও মূল্যবোধের দিক থেকে আমরা দেউলিয়া হয়ে গেছি।

প্রশ্ন:

সরকারি দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে বিরোধী দল রাজপথে আছে। সে ক্ষেত্রে ৭ জানুয়ারি কী হবে?

মাহবুবউল্লাহ: যদি সরকারের বোধোদয় হয়, তাহলে তারা বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের ব্যাপারে একটা ঐকমত্যে আসবে। সরকার বিরোধী দলের কয়েকজন নেতাকে মুক্তি দিয়েও সদিচ্ছা দেখাতে পারে। সমঝোতার পথ তৈরি করতে পারে।

প্রশ্ন:

তারপরও কি বিএনপি এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসবে?

মাহবুবউল্লাহ: সেটা তো পরের প্রশ্ন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি কী কৌশল নেয়, সেটা আগে থেকে বলা যায় না।

প্রশ্ন:

কিন্তু বিএনপি তো আলোচনার জন্য শর্ত জুড়ে দিয়েছিল আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।

মাহবুবউল্লাহ: দলীয় সরকারের অধীনেও তো তারা নির্বাচন করেছে। সেখানে রাতের বেলা ভোটের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দিয়ে অনেকটা সফলও হয়েছিল। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার জন্য এই নির্বাচন করতে হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই আরেকটি নির্বাচন হবে। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর অনুরোধে বিএনপি আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত করে। এর পাশাপাশি আমরা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে পারি। সে সময় বিএনপি দ্রুততম সময়ে আরেকটি নির্বাচন দিয়েছিল।

প্রশ্ন:

আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলকে ছাড়াই ৭ জানুয়ারি নির্বাচন করে ফেলে, তখন বিএনপি কী করবে?

মাহবুবউল্লাহ: এ প্রশ্নের উত্তর বিএনপি নেতৃত্বই বলে দিতে পারেন। তবে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলব, বিএনপি চেষ্টা করবে প্রতিকূল অবস্থায়ও তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে। যদি ৭ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন হয়, সংকট আরও ঘনীভূত হবে। আমরা নতুন প্রজন্মের জন্য কেমন বাংলাদেশ রেখে যাচ্ছি, সেটা এখন চিন্তার বিষয়। তরুণ প্রজন্মের যাঁরাই সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। তাঁরা ভাবেন, সেখানে নিরাপদ থাকবেন। বাংলাদেশে সেই নিরাপদ পরিবেশ থাকলে তরুণেরা দলে দলে বিদেশে যেতেন না।

প্রশ্ন:

আপনাকে ধন্যবাদ।

মাহবুবউল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।