কোটা সংস্কারের মতো নিরীহ দাবির একটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সহিংসতায় এ পর্যন্ত দুই শ মানুষের মৃত্যুর খবর জানা যাচ্ছে। ইন্টারনেট বন্ধ করে, কারফিউ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে হলো সরকারকে। এ রকম একটা অভাবনীয় পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো? দায়টা আসলে কার?
মাহবুব উল্লাহ: প্রথম কথা হচ্ছে, দীর্ঘদিন মানুষ তার ভেতরের যে আকাঙ্ক্ষা, তার যে কষ্ট—এগুলো প্রকাশ করতে পারেনি। এ কারণে একটা চাপা ক্ষোভ দিনের পর দিন পুঞ্জীভূত হয়েছে। অনেক কারণেই সেটা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি, গরিবে-ধনীতে বৈষম্য, জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যাওয়া থেকে শুরু করে ভোট দিতে না পারা ও ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে না পারা—এসব ক্ষোভ একত্র হয়ে এ আন্দোলনে প্রকাশিত হয়েছে।
এটা একটা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা। বাংলাদেশকে আমরা যারা চিনি ও জানি, তারা এটুকু বুঝতে পারি, এ দেশের জনগণ দীর্ঘদিন অন্যায় ব্যবস্থা মেনে নেয় না। তারা একসময় প্রতিবাদ করে। বাষট্টি, উনসত্তর, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের অভ্যুত্থানে আমরা সেটা লক্ষ করেছি। আমরা দেখেছি, মানুষ দীর্ঘদিন সহ্য করে, অপেক্ষা করে, কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে তখন একটা বিস্ফোরণ ঘটে।
যাঁরা দেশ চালান, দেশের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা যদি মানুষের এই মনোভাব বুঝতে না পারেন, তাহলে বিপত্তি ঘটে। এবারে সে রকমই একটা কিছু ঘটেছে।
প্রশ্ন হলো, কোটা সংস্কারের মতো নির্দোষ আন্দোলন, যার মধ্যে কোনো রাজনীতি নেই, শুধু একটা নির্দিষ্ট দাবি ছিল, সেই দাবিকে কেন্দ্র করে এত বড় একটা ঘটনা কেন ঘটল? এর পেছনে তাৎক্ষণিক কারণ ছিল, এই দাবিকে কেন্দ্র করে সরকার প্রথম দিকে যে অবস্থান নিয়েছিল, সেটা মোটেই শুভকর ছিল না।
দেখা গেল, আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকারের অনুগত ছাত্রসংগঠন, যুবসংগঠনকে ব্যবহার করা হয়েছে। ছাত্রদের নিয়ে নানা রকম উপহাস করা হয়েছে। তাদের রাজাকারতুল্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কারণে ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভের একটা বিস্ফোরণ ঘটে।
প্রথম থেকে ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছে, কোনো রকম সহিংসতায় জড়ায়নি। ছাত্রদের ওপর যখন বাইরে থেকে আক্রমণ এল, তখন তাদের প্রতিবাদ কিছুটা হলেও মারমুখী হয়ে উঠল। ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়ার মতো অবস্থানে তারা চলে গেল।
ছাত্রলীগের প্রতি ছাত্রদের এই ক্ষোভের পেছনেও দীর্ঘদিনের বেদনা লুকিয়ে আছে। গেস্টরুমের অত্যাচার, সিট বণ্টনের নৈরাজ্য, ছাত্রলীগের মিছিলে-মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য চাপ, না গেলে নানা ধরনের অত্যাচার—এসব ক্ষোভ ছাত্রদের মধ্যে ছিল।
দেশের এখনকার যে পরিস্থিতি, সেখানে দেশটাকে আনার মূল দায়দায়িত্ব নিঃসন্দেহে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের ওপরেই গড়ায়। অবশিষ্ট দায়িত্ব যেটা, সেটা অন্যদের ঘাড়েও আসে। এ রকম একটা পরিস্থিতি দেশের মানুষ চাননি।
গত কয়েক দশকের ইতিহাসে মাত্র অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে এত মানুষের মৃত্যু তো কখনো ঘটেনি। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনেও এতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়নি। কিন্তু সেই আন্দোলন তো তিন মাস ধরে চলেছিল। তিন মাসের সঙ্গে অল্প কয়েক দিনের ঘটনার তুলনা করলে এটা সত্যিই ভয়াবহ একটা ব্যাপার। এর তুল্য ঘটনা আমাদের দেশে কখনো ঘটেনি।
এবারের আন্দোলনে বাড়াবাড়ি রকম বলপ্রয়োগ করতে দেখা গেল। আন্দোলন থামাতে এ রকম বলপ্রয়োগের কি বিকল্প ছিল না?
মাহবুব উল্লাহ: অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রথম আলোয় বলেছেন, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ কখনোই মঙ্গল ডেকে আনে না। অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়টি শুধু আমাদের দেশের নিজস্ব বিষয় নয়। আন্তর্জাতিকভাবে আনুপাতিক হারে শক্তিপ্রয়োগের কথা বলা হয়। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ যতটা শক্তি প্রয়োগ করছে, সরকারের বাহিনীগুলোকে সেই অনুপাতে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। সেটা অতিক্রম করে গেলে বিষয়টা একধরনের নির্মম অত্যাচারে পরিণত হয়। এই দিকটা আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোয় যাঁরা আছেন, তাঁদের খেয়াল রাখতে হবে। এবারের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁদের অনেক কিছু শেখার ও বোঝার আছে।
প্রথম দিকে ছাত্রদের আন্দোলন হলেও পরের দিকটাতে সাধারণ মানুষকেও বিক্ষোভ করতে দেখা গেল। এর কারণ কী?
মাহবুব উল্লাহ: সাধারণ মানুষ কেন এত অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ হয়ে গেল, সেটা কিন্তু সরকারকে বুঝতে হবে। মানুষের মনের কথা যদি বোঝার চেষ্টা না করা হয়, তাহলে কিন্তু এ ধরনের দুর্যোগ ভবিষ্যতে আমাদের আরও ভোগ করতে হবে।
সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন করেছে, অন্যদিকে মামলায় হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হচ্ছে, গ্রেপ্তার চলছে। বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?
মাহবুব উল্লাহ: একটা খবরে দেখলাম, একটি প্রতিবন্ধী শিশুকে আটক করা হয়েছে। এটা যদিও একটা উদাহরণ, কিন্তু এর ভেতর থেকে বোঝা যায়, এখন নির্বিচার গণগ্রেপ্তারের একটা ব্যাপার চলছে। সরকার মনে করছে, এটা একটা আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা, তাই এটাকে আইনশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি করার যে ব্যবস্থা, তার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা যতটা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আস্থা-বিশ্বাসের সমস্যা। আমাদের সমাজে কোন রোগটা বাসা বেঁধেছে, সেটা যদি আমরা বোঝার চেষ্টা না করি, তাহলে আমরা সমস্যার সমাধান করতে পারব না।
এখন যে পরিস্থিতি, তাতে শিগগিরই সংকট কেটে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে বলে মনে করছেন? এখন করণীয়টা কী?
মাহবুব উল্লাহ: আমার মত হচ্ছে, সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, সব ধরনের অবিশ্বাস ও সন্দেহ দূর করে, সব পথ ও মতের লোকদের নিয়ে বসে আলোচনা করা দরকার। কীভাবে এ সংকট থেকে উত্তরণ হবে, কীভাবে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস-আস্থা ফিরে আসবে, কীভাবে দেশ সুন্দরভাবে চলবে, কীভাবে দেশে গণতান্ত্রিক ও সহনশীল ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়—এসব বিষয়ে আলোচনা করা দরকার।
এ মুহূর্তে আমরা হয়তো সব অসাম্য ও বৈষম্য দূর করতে পারব না। কিন্তু আন্তরিকতা থাকলে একটা সুন্দর নির্বাচন করতে পারব, সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারব।
আওয়ামী লীগ বড়, পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। তারা কেন এত বড় কালিমা নিয়ে থাকবে? যা কিছু ভুলত্রুটি হয়ে গেছে, সেগুলো এক পাশে ঠেলে রেখে একটু উদারচিত্তে সবকিছুকে দেখা এবং গণগ্রেপ্তার ও দমন–পীড়নের পথ থেকে আওয়ামী লীগকে একটু সরে আসা খুবই দরকার।
কিছু মিডিয়ায় কেবল ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের নিন্দা করা হচ্ছে। কিন্তু দুই শ মানুষের প্রাণ ঝরে গেল, তার মূল্য তো অপরিসীম। কোনো ক্ষতিপূরণ দিয়ে সেটা তো পূরণ করা যাবে না। এ বিষয়ও মিডিয়ার বোঝা উচিত। একতরফা প্রচার মঙ্গলজনক নয়।
মিডিয়ায় সমস্যার সবদিক যাতে আসে, যাঁরা কথা বলতে চান, তাঁরা যাতে খোলামনে কথা বলতে পারেন, সেই সুযোগ যদি দেওয়া হয়, তাহলে মানুষের ভেতরের যে চাপা ক্ষোভ, সেটা কিছুটা হলেও বেরিয়ে আসবে। তা না হলে একটা গুমোট ভাব থেকেই যাবে। সেটা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য, দেশের অগ্রগতির জন্য মঙ্গলজনক নয়।
আপিল বিভাগের রায়ের পর সরকার কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে পরিপত্র দিয়েছে। আন্দোলনকারীরা সরকারের কাছে কয়েকটি দাবিনামা পেশ করেছেন। তাঁদের কয়েকজন সমন্বয়ক নিখোঁজ। তাঁদের প্রতি আপনার বার্তা কী?
মাহবুব উল্লাহ: শিক্ষার্থীদের মূল একটা দাবি পূরণ হয়েছে, এখন তাদের দেশের কথা ভাবতে হবে, নিজেদের পড়াশোনার কথা ভাবতে হবে। একই সঙ্গে অন্য যেসব দাবি নিয়ে তারা আন্দোলন করছে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেগুলো তুলে ধরতে হবে। যারা আন্দোলন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো নির্যাতন হবে না বলে সরকার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু আশ্বাসের বাস্তবায়ন হওয়াটাই বড় কথা। এখনো যদি কেউ নিখোঁজ থাকে, তাদের ব্যাপারে স্পষ্ট একটা চিত্র জনসমক্ষে হাজির করা প্রয়োজন। তারা দেশের নাগরিক, তারা কোথায় আছে—এটুকু জানার অধিকার জনসাধারণের আছে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুব উল্লাহ: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।