সাধারণভাবে আমরা জানি যে নির্বাচন মানে প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ফলাফল যেহেতু জনগণের ভোটের ওপর নির্ভর করে, তাই এ নিয়ে অনিশ্চয়তাও থাকে। কিন্তু যে নির্বাচনের ফলাফল জানা, তাকে আমরা কেমন নির্বাচন বলব? বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন হলো তাকে কি কোনো বিশেষ বা নতুন কোনো নামে আখ্যায়িত করা যায়?
রওনক জাহান: স্বীকৃত গণতান্ত্রিক দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের যে প্রতিযোগিতা, তা দিয়ে ৭ জানুয়ারির সংসদীয় নির্বাচনকে বিবেচনা করা যায় না। যেহেতু আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ দল বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, তাই এই নির্বাচনে কোনো দলভিত্তিক প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সমান সুযোগ পায়নি। তাদের বহু নেতা-কর্মী ছিলেন জেলে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ছিল অসংখ্য মামলা।
অবশ্য বিরোধী দলের ওপর এর আগের বিভিন্ন শাসনামলেও আমাদের দেশে অনেক দমন–পীড়ন হয়েছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটির নতুনত্ব হচ্ছে এই নির্বাচনটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখানোর জন্য সরকারি দল নানা অভূতপূর্ব কলাকৌশল নিয়েছিল, যা আমরা আগে দেখিনি। আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী যাঁরা দলের মনোনয়ন পাননি, তঁাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া হলো। জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল সরকারি দল সমর্থিত হিসেবে।
এর আগে ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে সামরিক শাসকদের আমলে আমরা অনেক ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং দেখেছি যেখানে কে জিতবে, কে হারবে, কে বিরোধী দল হবে, তা সামরিক শাসকেরাই ঠিক করে দিত; গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দল গঠন ও ভাঙনে সক্রিয় ছিল। কিন্তু তখন এই সব ইঞ্জিনিয়ারিং এত প্রকাশ্যে হয়নি।
এবার সব দর-কষাকষি, সব ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কলাকৌশল বেশ প্রকাশ্যেই হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল, বিশেষ করে কোন দল ক্ষমতায় যাবে, তা নিয়ে কোনো সংশয়ই ছিল না। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেসব প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তঁারা সবাই নিজেদের আওয়ামী লীগ অনুসারী বা সমর্থিত বলে প্রচার করেছেন। নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটাই ছিল সাজানো।
এই নির্বাচনের কোনো বিশেষ নাম আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নির্বাচনপ্রক্রিয়াটি যে গণতান্ত্রিক ছিল না, তা স্পষ্ট বলে দিয়েছে। দেশের আপামর জনসাধারণও যে নির্বাচনটিকে গণতান্ত্রিক মনে করেছে, তেমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংসদ গঠিত হয়েছে, তা কার্যত একদলীয়। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া প্রশ্নবিদ্ধ ভোটের হার বিবেচনায় নিলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই নির্বাচনে ভোট দেয়নি। ওয়েস্টমিনস্টার বা সংসদীয় গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, তা কতটুকু টিকে থাকল?
রওনক জাহান: যদি সর্বগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দল বারবার নির্বাচিত প্রধান দল হয়ে সরকার গঠন করে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। ভারতে কংগ্রেস দল ১৯৪৭ সালের পর একটানা ২০ বছর পরপর নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করেছিল। আজ পর্যন্ত কংগ্রেস ১০ বার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে।
ভারতে এসব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। আমাদের দেশের একটি প্রধান সমস্যা হলো পরপর তিনটি নির্বাচন—২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সর্বজন গ্রহণযোগ্য হয়নি।
এই নির্বাচনগুলোর প্রক্রিয়া ও ফলাফল নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের দেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে সবার আগে আমাদের নির্বাচনব্যবস্থার ওপর সব দলের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ সব দেশেই নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে। বিভিন্ন দলের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে, তিক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে, কটূক্তিও হচ্ছে। কিন্তু সবাই নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখছে। নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিচ্ছে।
আমরাই একমাত্র দেশ, যারা স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলাম না।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফলে সব দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছিল। পরপর তিনটি নির্বাচনে সবাই অংশগ্রহণ করেছিল। যে দল হেরেছিল, তারা নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও শেষ পর্যন্ত ফলাফল মেনে নিয়েছিল। প্রত্যেক বার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছিল।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ২০১১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দেওয়ার পর আর কোনো সর্বদল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা আমরা উদ্ভাবন করতে পারিনি। এর পরের সব নির্বাচনই ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া দখলে ছিল।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় এবং নির্বাচনের ফল আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের জনসাধারণ ক্রমাগত ভোট দিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।
এবারের ভোটের হার এখনো প্রশ্নবিদ্ধ; তবে সরকারি হিসাব মেনে নিলেও দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়নি। যত দিন পর্যন্ত আমরা একটি সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচন না করতে পারব, তত দিন পর্যন্ত আমরা গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত পূরণ করতে পারব না; আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাব না।
ফলাফল জানা থাকলেও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার ও মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। এই সরকারের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সামনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ কী? অথবা আদৌ কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কি?
রওনক জাহান: পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার পর সরকার নিশ্চয়ই ভাবতে পারে যে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার, দলীয় শক্তি প্রয়োগ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কলাকৌশল দিয়ে তারা প্রতিপক্ষের সব চ্যালেঞ্জ ভবিষ্যতেও মোকাবিলা করতে পারবে। কিন্তু বহুদিন ধরে আমাদের কয়েকটি রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, যার সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনের শাসন ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে। সমাজ ও রাজনীতিতে বিভাজন বেড়ে চলেছে। মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সরকারের নীতিনির্ধারণ ও প্রয়োগ প্রক্রিয়ার ওপর অশুভ প্রভাব বিস্তার করছে। এসব সমস্যার সমাধান সরকারের সামনে বিরাট রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
এই নির্বাচন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বয়ান এবং জনসাধারণের বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনো মিল নেই। সরকার বলছে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে; গণতন্ত্র সুদৃঢ় হয়েছে। কিন্তু এই বয়ান কি জনসাধারণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে? বরং সরকারি বয়ান এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে তফাতটা দেশে এখন একটা বড় আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে, যা সরকারের সঙ্গে জনসাধারণের দূরত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি করে চলেছে।
সরকারের সামনে প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাদের গণতন্ত্রের অঙ্গীকারের প্রতি জনসাধারণের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনা। আর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই নির্বাচন নিয়ে সব বিতর্কিত বিষয়ের মীমাংসা করতে হবে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সর্বদল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হবে।
গত ১৫ বছরে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কোনো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। দেশের জনগণ একটি সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। নির্বাচনগুলো বিতর্কিত হওয়ায় বৈশ্বিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে যত দিন বিতর্ক চলবে, তত দিন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না।
এই সরকারের সামনে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কী উপায়ে নিজেদের কাজের দুর্বলতা বা ঘাটতি ভবিষ্যতে তারা চিহ্নিত করবে?
একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত সংসদের বিরোধী দল, মিডিয়া কিংবা নাগরিক সমাজ সরকারের ভুলভ্রান্তি নিয়ে সমালোচনা করে; ভিন্ন নীতি কিংবা পন্থা নিয়ে আলোচনা করে। প্রচার করে। কিন্তু বহু বছর ধরে আমাদের সংসদে বিরোধী দল কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি।
এবারের সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই। সবাই সরকারের অনুসারী কিংবা সমর্থক। সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের অবর্তমানে আমাদের সংবাদমাধ্যম, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজ এত দিন সরকারের কাজের পর্যালোচনা, সমালোচনা করে এসেছে। সরকারের জবাবদিহি আদায়ের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ক্রমেই আমাদের সংবাদমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজও সরকারের বিভিন্ন আইন ও নানাবিধ চাপের মুখে পড়ে শঙ্কিত।
তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বা মিডিয়াতে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে সরকার এসব প্রতিবেদনের চিহ্নিত সমস্যাগুলোর সমাধান না করে বরং প্রতিবেদন বা সংবাদগুলোকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিতে অভ্যস্ত। যদি নির্ভয়ে সরকারের কাজ নিয়ে কোনো আলোচনা, সমালোচনা করার স্থান বা পরিবেশ না থাকে, তাহলে সরকারের পক্ষে তো কোনো ভিন্নমত শোনার সুযোগ থাকবে না।
শুধু শ্রুতিবাক্য বা একপক্ষীয় সংবাদ ও আলোচনার ওপর নির্ভর করে নীতি প্রণয়ন বা প্রয়োগ করলে শেষ পর্যন্ত তা সরকারের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। তাই সরকারের আরও একটি কাজ হবে বাক্স্বাধীনতা পরিপন্থী বিভিন্ন আইন বাতিল করে মুক্ত আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা।
সরকারের সামনে তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো আমাদের রাজনৈতিক বিভাজন একটি সহনীয় পর্যায়ে রাখা, যাতে সহিংসতার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বিভাজনের দুদিকে থাকা ব্যক্তিরা থাকতে পারেন। আলোচনার মাধ্যমে বিতর্কিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করতে পারেন।
রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। আমাদের রাজনীতিবিদেরা প্রায়ই বলে থাকেন, রাজনীতি এখন আর তাঁদের হাতে নেই। রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ী এবং আমলাতন্ত্রের হাতে। রাজনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আবার হাতে নিতে হবে রাজনীতিবিদদের।
সরকার নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক দেখাতে গিয়ে যে কৌশলে নির্বাচন করল, মানে দলের লোকজনকেই দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দিল, এটা কি দলের ঐক্য ও সংহতির জন্য ভালো হলো? এই নির্বাচন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপর কী প্রভাব ফেলল বলে মনে করেন?
রওনক জাহান: আমরা অনেক দিন ধরেই লক্ষ করছিলাম উপদলীয় কোন্দল ও সহিংসতা আওয়ামী লীগের একটি প্রধান সমস্যা। এই সমস্যাটা বিএনপির মধ্যেও আছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে দলের ভেতর নেতাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। সাধারণত দলের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে ঠিক হয় কারা নেতা হবেন বা দলের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হবেন। আমাদের দেশে এই প্রথা প্রচলিত নেই। দলের ওপরমহল থেকে ঠিক করে দেওয়া হয় কারা দলের বিভিন্ন পদে থাকবেন।
এবার ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় নিজ দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলের অন্য নেতাদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু এখনো দেখছি যাঁরা ভোটে হেরেছেন, তাঁরা ভোটের ফল মানছেন না; বলছেন বিভিন্ন কারচুপি বা শক্তি প্রদর্শন করে তাঁদের হারানো হয়েছে। আসলে আওয়ামী লীগের ঐক্য ও সংহতি বহু বছর ধরেই নির্ভর করছে দলের প্রধানের ওপর। সব নেতা-কর্মী একমাত্র তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নেন। অন্য কারও সিদ্ধান্ত বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই, যার মাধ্যমে উপদলীয় কোন্দল মেটানো যায়।
দলের মনোনীত এবং দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগটি যদিও ভোটের অংশ বাড়ানোর বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ সৃষ্টি করার কৌশল হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে কিন্তু এটি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কিছু দুর্বলতাকেও প্রকাশ করছে।
প্রথমত, ৫৯ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী দলের মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে এটা প্রমাণ করেছেন যে দলটির নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা তৃণমূলে দলটির কোন নেতা বা নেত্রী বেশি জনপ্রিয়, তা প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ আসনে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সহিংসতাকে যে দলীয় শৃঙ্খলার মধ্যে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে, তা এই নির্বাচন আবার দৃশ্যমান করল। আমি জানি না আওয়ামী লীগ দলের প্রধান এরপর দলের ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সব পদের জন্য এভাবে উন্মুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা চালু করবেন কি না। দলের ভেতরে নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হবে। যদি তিনি তা করেন, তাহলে নিশ্চয়ই বিপুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
দলপ্রধানের মূল চ্যালেঞ্জ হবে এমন একটি নিয়ম বা ব্যবস্থার প্রচলন করা, যার মাধ্যমে অন্তর্দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হতে পারে। এখন পর্যন্ত সব সিদ্ধান্ত বা মীমাংসাই থাকছে ব্যক্তিনির্ভর।
নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতি এক পরিস্থিতির মধ্যে ছিল। নির্বাচনের পর এখন ভিন্ন পরিস্থিতি। এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক বা ব্যবধান কতটুকু এবং তা কী কী?
রওনক জাহান: নির্বাচনের আগে যখন বিএনপি বিভিন্ন জনসমাবেশ করছিল, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিল, ভিসা নীতি, শ্রমনীতি নিয়ে কথা বলছিল, তখন মনে হচ্ছিল সরকারের ওপর এই নির্বাচন নিয়ে কিছু চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, হয়তোবা সরকার সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য একটি উদ্যোগ নেবে।
কিন্তু সরকার সব চাপ উপেক্ষা করে তাদের ইচ্ছানুযায়ী একটি নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে। মন্ত্রিসভা গঠন করেছে। আপাতত দুই পক্ষের এই দ্বন্দ্বে সরকার বিজয়ী হয়েছে।
তবে নির্বাচনটি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধরে রাখলেও নির্বাচন নিয়ে দেশে–বিদেশে বিতর্ক শেষ হয়নি। সরকারের সামনে সর্বদল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থার উদ্ভাবন করার চ্যালেঞ্জটা এখনো রয়ে গেছে।
দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি সামনে কী করতে পারে? তারা কি আরও শক্তিহীন হয়ে পড়তে পারে? বিএনপি দাবি করছে তাদের নির্বাচন বর্জনের ডাকে জনগণ সাড়া দিয়েছে। দলটি এখন কী করতে পারে?
রওনক জাহান: হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে জেলে নেওয়ার পর এবং একটি গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়ায় আপাতদৃষ্টে বিএনপিকে শক্তিহীন মনে হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে প্রায় ১৮ বছর থাকার পরও বিএনপি যে এখনো অনেক নেতা-কর্মী, সমর্থক ধরে রাখতে পেরেছে, তাতে তাদের দুর্বল ভাবার কোনো কারণ নেই।
নির্বাচনের আগে যখন বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছিল, তখন তারা প্রচুর জনসমাগম করতে পারছিল। অবশ্য মিটিং–মিছিলের জনসমাগম দিয়ে দেশে কত জনসমর্থন আছে, তা বোঝা যায় না। সব দলকে সমান সুযোগ দিয়ে নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন করতে পারলেই আমরা বুঝতে পারব আসলে দেশে কোন দলের কত সমর্থক আছে। জনসমর্থনও এক নির্বাচন থেকে অন্য নির্বাচনে পরিবর্তিত হতে পারে।
বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ডাকে যে জনগণ বিপুল সাড়া দিয়েছে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। যেহেতু নির্বাচনের ফল আগেই জানা ছিল, তাই বহু লোকই ভোট দিতে যেতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল। বিএনপির সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। ক্ষমতার বাইরে থেকে এবং সরকারের অনেক দমন-পীড়নের শিকার হয়ে নেতা-কর্মীদের মনোবল উজ্জীবিত রাখা, আন্দোলন–সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া বিএনপির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বিএনপিকে সরকার ২০১৪ সালের পর থেকেই একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছিল। গত বছর বেশ কয়েক মাস ধরে বিএনপি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও অন্যান্য প্রতিবাদের কর্মসূচি পালন করার মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিল যে তারা আসলে একটি সন্ত্রাসী দল নয়। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের সহিংসতা এবং তার পরবর্তী সময়ের বাস, ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকার আবার প্রচার করছে যে বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। বিএনপি অবশ্য এর প্রতিবাদ করে বলেছে যে দলটি এসব সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়।
এখন বিএনপির প্রথম কাজ হবে তথ্য–উপাত্ত দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা, যা ব্যবহার করে তারা জনসমক্ষে প্রচার করতে পারবে যে ২৮ অক্টোবর এবং তার পরবর্তী সব সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ নেই।
বিএনপির অন্য একটি কাজ হবে তারা ক্ষমতায় গেলে যে গণতান্ত্রিক ব্যবহার করবে এবং গণতন্ত্রের মান উন্নয়ন করবে, সে ব্যাপারে জনসাধারণের আস্থা অর্জন করা।
বিএনপি এত দিন একটি ইস্যু—নির্বাচন ইস্যু নিয়েই গণসংযোগ করছিল। তারা ক্ষমতাসীন দলকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে বলছিল বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু ১৯৯০–এর পর দুবার বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তখন তারা গণতান্ত্রিক আচরণ করেনি। তারাও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দমন–পীড়ন করেছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার ঘটনা বিএনপি শাসনামলেই ঘটেছে, যেখানে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিহত ও আহত হয়েছেন। বিএনপিও নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়েছে। তারাও সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করেছে।
এখন যদি বিএনপি জনসাধারণকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে উজ্জীবিত করতে চায়, তাহলে দলটিকে প্রথমে জনসাধারণের আস্থা অর্জন করতে হবে যে তারা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে গণতান্ত্রিক আচরণ করবে।
শুধু সরকার পতনের নেতিবাচক অ্যাজেন্ডা নিয়ে আন্দোলন করলেই হবে না। গণতন্ত্র, সুশাসন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এসব বিষয়ে কিছু ইতিবাচক অ্যাজেন্ডা নিয়ে বিএনপিকে জনসাধারণের কাছে যেতে হবে। সবার ওপর নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, সমন্বয়হীনতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতাকে কাটিয়ে দলটিকে আরও সুসংহত করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে আকর্ষণ করতে হবে।
সরকার বিএনপির ওপর নতুন করে কোনো দমনমূলক পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করেন? বিএনপি নিষিদ্ধ করা হতে পারে, এমন কথা আলোচনায় আছে। আপনি কি মনে করেন সরকার সেই পথ ধরবে? দেশের রাজনীতিতে এর ফল কী হতে পারে।
রওনক জাহান: সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যা দিলেও তাদের হয়তো নিষিদ্ধ করবে না।
বিএনপিকে সরকার দুর্বল করে রাখতে চাইবে। তাদের নিষিদ্ধ করলে দেশ-বিদেশে এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হবে, তাতে তো সরকারের কোনো লাভ হবে না। সরকার তো জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করেনি। তাদের কিছুটা নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে।
বিএনপি ছাড়াও যে রাজনৈতিক দলগুলো সংসদের বাইরের আছে এবং নির্বাচন বর্জন করেছে, সেই দলগুলোর ভবিষ্যৎ কী?
রওনক জাহান: আমাদের দেশের ছোট দলগুলো যারা নির্বাচন বর্জন করেছে, তারা তেমন কোনো জনসমর্থন অর্জন করতে পারছে না। ১৯৯০–এর পর জনসাধারণ নির্বাচনী রাজনীতিতে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। তারা জানে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে হলে প্রচুর টাকাপয়সা, কর্মী বাহিনী ও পেশিশক্তির প্রয়োজন।
ছোট দলগুলো যাদের টাকাপয়সা, কর্মীবাহিনী বা পেশিশক্তি নেই, তারা নির্বাচনী রাজনীতি বা গণ-আন্দোলনের রাজনীতিতে জনসমর্থন আদায় করতে পারছে না। এখানে অবশ্য ইসলামি আদর্শভিত্তিক দলগুলোর কতটা জনসমর্থন আছে, তা আমি বলতে পারব না। বিভিন্ন ইস্যুতে তারা প্রচুর জনসমাগম করতে পারে।
অনেকেই মনে করেন যে গণতন্ত্র সংকুচিত হলে এবং নির্বাচনী রাজনীতি সবার জন্য উন্মুক্ত না হলে শেষ পর্যন্ত ইসলামি আদর্শভিত্তিক দলগুলোর প্রসার বৃদ্ধি পাবে।
পরিস্থিতি উত্তরণে একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আসার আহ্বান বিভিন্নজনের মুখ থেকে শোনা গেছে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কার্যত একটি একদলীয় সরকার গঠনের পর সরকার কি এ ধরনের কোনো বন্দোবস্তের উদ্যোগ নিতে আগ্রহী হবে? রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আশা কতটা বাস্তবসম্মত?
রওনক জাহান: সরকার হয়তো ভাবছে যে আপাতত তারা রাজনৈতিক খেলায় আবার জিতেছে। বিএনপির তেমন শক্তি নেই যে তারা একটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটাবে। দেশের বিভিন্ন শক্তিশালী গ্রুপ বা জনসাধারণও তেমন তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করছে না। তবে নিজেদের উদ্যোগে সরকার যদি বিএনপি বা বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের দেশের সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেয়, তাহলে তারা রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
রওনক জাহান: আপনাকেও ধন্যবাদ।