বিশেষ সাক্ষাৎকার: হোসেন জিল্লুর রহমান

সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ছেদ বিশৃঙ্খলা উসকে দিতে পারে

২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান তিনি। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম ও দক্ষতা-যোগ্যতা মূল্যায়ন, তাদের করণীয়, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার বিতর্কসহ অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়াইফতেখার মাহমুদ। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ পড়ুন শেষ পর্ব

প্রথম আলো:

সরকারের দুই মাসের কার্যক্রম বিবেচনায় নিয়ে অনেকে বলছেন, সরকারের আকার বাড়ানো দরকার। নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া দরকার। কিছু খাত রয়েছে, যেখানে সেই বিষয়ের দক্ষ কোনো উপদেষ্টা নেই। আপনি কী মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে; কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে এই সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার স্টাইলে। সবার আগে সরকারের নিজেকেই নিজে একটা বড় ঝাঁকুনি দিতে হবে। এই যে আমলাতান্ত্রিকতা বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, কিছুটা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন করা হচ্ছে, জনগণের কাছে যাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না—এগুলো দূর করা জরুরি। তাই সরকারের আকার নয়, কার্যকারিতার মানদণ্ডে বিচার করা ও সংশোধন করাই বেশি জরুরি।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আগের সরকারের সঙ্গে যুক্ততা ছিল। তারা লুটপাটেরও অংশীদার ছিল; কিন্তু অনেক সেবা ও পণ্য সরবরাহে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা আছে। আবার তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি। এমন একটি পরিস্থিতি মোকাবিলার পথ কী?

হোসেন জিল্লুর: এটা সাধারণ মানুষের বড় উদ্বেগ। কোটা সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান; কিন্তু কর্মসংস্থানের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করলে আমরা কী উত্তর পাব। এ ব্যাপারে মনোযোগ কোথায়, উদ্যোগ কোথায়? বর্তমান পরিস্থিতিতে যা করতে হবে তা হচ্ছে অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণে এনে তাদের সেবা ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। এ জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের আস্থায় আনতে হবে। তাঁদের দিয়ে কাজ করাতে হবে। সচিবদের কথায় বা তাঁদের মাধ্যমে করতে গেলে তা কাজে দেবে না। সরকারকে অনেক দ্রুততার সঙ্গে কাজটি করতে হবে। বন্যার পর সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আমলাতান্ত্রিকভাবে এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে গেলে দুই বছর বসে থাকতে হবে; কিন্তু আমাদের এখনই কৃষকদের বীজ, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ দিয়ে দিতে হবে। দেরি করার সময় নেই।

সরকারের সঙ্গে সংলাপে বড় ব্যবসায়ীরা গেছেন। সেখানে তো সেই পুরোনোদেরই দেখলাম। এর মধ্যে অনেক ভালো ব্যবসায়ীও আছেন। কিছুদিন আগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের একটি গ্রুপকে নিয়ে আমি বসেছিলাম। তারা দুঃখ করে বলছিল, আমাদের দিকে কে তাকায়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, প্রশাসনিক পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। দুর্নীতি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এবং একে অবশ্যই ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে; কিন্তু পুরো পরিস্থিতিকে শুধু দুর্নীতির লেন্স দিয়ে দেখলে হবে না। গুরুতর দুর্নীতির কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করে বাকি অর্থনৈতিক কাজগুলোকে কীভাবে আরও সচল করা যায়, সেদিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির রিপোর্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি; কিন্তু অনেক ছোটখাটো দুর্নীতির বিষয় নিয়ে সরকারকে ব্যস্ত থাকতে দেখছি।

প্রথম আলো:

সরকার তো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। মামলা হচ্ছে।

হোসেন জিল্লুর: দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও বিচার সঠিকভাবে করলে ভালো; কিন্তু তা অনিয়ন্ত্রিতভাবে হতে দেখছি। নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার, দুর্নীতি সীমাহীন পর্যায়ে গিয়েছিল। এর প্রতিকার জরুরি। কিছুদিন আগে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সঙ্গে কথা হয়েছিল। সে ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। সে আমাকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিল। সে বলেছে, ‘আমরা সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতির কারণে আমরা ব্যাপক সাহসী হতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু পটপরিবর্তনের পর কেউ তো আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল না। আমাদের ইমোশনাল হিলিং জরুরি।’ দ্বিতীয়ত, সে বলেছিল, ‘আমরা পড়ালেখায় ফিরতে চাই। পুরো জাতির একটি ইমোশনাল হিলিং দরকার ছিল। সেটা হয়নি।’ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে ফেরানোর কাজে গুরুত্ব না দিয়ে কে দোষী, কে দোষী নয়—এ নিয়ে এক অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। আমি মনে করি, বিচার সঠিকভাবে হলে যারা অপরাধী, তাদের কাছেও তো এই বার্তা চলে যাবে যে সঠিক বিচার হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।

প্রথম আলো:

নানা রাজনৈতিক আদর্শের দল এবং মত ও পথের লোকজন এক হয়ে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজ নিজ চাওয়া রয়েছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর দলগুলো নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে তৎপর রয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার কতটা সফল বলে মনে করেন? আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?

হোসেন জিল্লুর: হাসিনা সরকারের পতন প্রচেষ্টায় একটি সর্বদলীয় দিক থাকলেও এটা সত্য যে রাজনৈতিক দলগুলো এবং এই মুহূর্তে তৎপর ও মাঠে থাকা নানা গোষ্ঠী নিজ নিজ ধারণা ও চাওয়া প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় নিয়োজিত আছে। এটা স্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত নয়। প্রতিটি দল ও গোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও চাহিদা থাকতেই পারে; কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী প্রত্যক্ষ ও নীরব সমর্থনদানকারী সব গোষ্ঠী ও ব্যক্তির সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষাকে ধ্রুবতারার মতো সামনে রাখা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। তিনটি আকাঙ্ক্ষা এখানে সর্বজনীন। প্রথমত, দৈনন্দিন সমস্যার সহনীয় সমাধান ও সমাধানের দৃশ্যমান ও কার্যকর চেষ্টা, দ্বিতীয়ত স্থিতিশীল পরিবেশ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অন বোর্ড রাখতে কার্যকর বয়ান নির্মাণ। এটি শুধু সদিচ্ছা প্রকাশ করার ব্যাপার নয়। এক অর্থে এটি একটি সক্ষম ও বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক হ্যান্ডলিংয়ের ব্যাপার। তৃতীয়ত, টেকসই ও নৈতিকতার ছাপ আছে এমন রাজনৈতিক উত্তরণের রোডম্যাপ তৈরি। অন্তর্বর্তী সরকার আলাদা আলাদা অনেক উদ্যোগ নিচ্ছে; কিন্তু এসব উদ্যোগ সামগ্রিক কোনো আস্থার পরিবেশ তৈরি করছে বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের স্টাইল দৃশ্যত আমলা, বিশেষজ্ঞ ও ছাত্রদের ওপর অতি নির্ভরশীলতার ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে।

তিনটি পরামর্শ এখানে দিতে পারি—ব্যবসার পরিবেশ সামনে রেখে সর্বস্তরের ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে একটি সুনির্দিষ্ট ও সুবিবেচনাপ্রসূত মতবিনিময়ের স্থানীয় থেকে জাতীয় উদ্যোগ, যা গতানুগতিক প্রশাসন পরিচালিত মতবিনিময় নয়; দ্বিতীয়ত, সব অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে দ্রুত একটি জাতীয় শিক্ষা ডায়ালগ; তৃতীয়ত, জাতীয় নির্বাচনের সময়কালেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া।

প্রথম আলো:

রাষ্ট্রপতির থাকা না-থাকা, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা—এসব নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পথ কী?

হোসেন জিল্লুর: এখানে কিছু জরুরি বিষয় আলাদাভাবে বিবেচ্য। একটি কথা আপনি বলেছেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা। এই বিষয়ের মুখ্য দিক হচ্ছে, স্থিতিশীলতার ন্যূনতম পরিবেশ নিশ্চিত করা, যাতে জনগণের এ মুহূর্তের চাহিদা মেটানোর কাজ ও মধ্যম মেয়াদে সংস্কারের লক্ষ্য পূরণের কাজ সমান্তরাল ও কার্যকরভাবে এগোতে পারে। যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা এই মুহূর্তে আছি, সেখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ছেদ তৈরি প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেবে, যা অপ্রয়োজনীয় বিশৃঙ্খলাকেই উসকে দিতে পারে। রাষ্ট্রপতি পদে এখন যিনি আসীন আছেন, তাঁর যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিষয়টিও একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। এর উত্তরও পরিষ্কার। যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা—দুই মাপকাঠিতে যোগ্য নন। যৌক্তিক সময়ে তাঁর বিদায় অবধারিত এবং এ ব্যাপারে দ্বিমতের কোনো সুযোগ নেই; কিন্তু রাজনৈতিক উত্তরণের টেকসই ও কার্যকারিতার বিবেচনায় এ মুহূর্তে পদে আসীন ব্যক্তির যোগ্যতার চেয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বহু গুণ বেশি বিবেচ্য বিষয়। তবে পদে আসীন ব্যক্তির কোনো হঠকারী প্রচেষ্টার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখাও জরুরি। একটি বিষয় এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে যে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি একটি লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার ভারসাম্য। যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি পদটির দায়িত্ব ও ক্ষমতার একটি কার্যকর পর্যালোচনা ও সঠিক করণীয় নির্ধারণ। এটি নিয়ে জনপরিসরে জাতীয় আলোচনা বেগবান করা জরুরি।

প্রথম আলো:

দেশে নানা ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বেশ কিছু কমিশন গঠিত হয়েছে। এসবের মধ্যে সংবিধান সংস্কারের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে আপনার কোনো ভাবনা আছে কি?

হোসেন জিল্লুর: এটি গভীর মনোযোগের দাবি রাখে। সংবিধান সংস্কার নিয়ে একটি কেতাবি আলোচনা বেশ বেগবান হয়েছে। শূন্য থেকে শুরু করা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। সাংবিধানিক শূন্যতা রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য মারাত্মক হুমকি। আমার দৃষ্টিতে সংবিধান-সংক্রান্ত আলোচনার লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত তিনটি দিক বা বিষয়ে। প্রথমটি হলো মানুষের মৌলিক অধিকারের নতুন ও সম্প্রসারিত সংজ্ঞা নিশ্চিত করা। এই সম্প্রসারিত সংজ্ঞার অন্যতম বিবেচ্য মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করা। পুলিশের গালিগালাজ ও চড়থাপ্পড় থেকে শুরু করে সর্বস্তরের রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের অসৌজন্যমূলক আচরণ মানুষের মর্যাদাকে বিনষ্ট করে। এসব বন্ধ করতে হলে মানুষের মর্যাদার অধিকারগুলো সংজ্ঞায়িত ও যুক্ত করে সংবিধানের ধারাগুলো সাজাতে হবে। ৫ আগস্টের পর যে শব্দটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে ইনসাফ বা জাস্টিস। এটি একটি বহুমাত্রিক শব্দ। এটি নিশ্চিত করতে হবে। ধারাবাহিকতা ও মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে সমন্বয় করে আমাদের এ কাজ করতে হবে। আরেকটি অন্যতম বিবেচনার বিষয় ক্ষমতার ভারসাম্য। এ লক্ষ্যে নানামুখী আলোচনা চলছে। কার্যকরভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, জনপরিসর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আনুপাতিক হারে ভোটের কথা আলোচনায় এসেছে। এখানেও চটজলদি কোনো সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না।

প্রথম আলো:

ড. ইউনূস সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো প্রশ্ন নেই; বরং বিশেষ সমর্থন ও আর্থিক সহায়তার আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে। এই সমর্থন ও সহায়তা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে কতটা সহায়ক হবে বলে মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর: আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি থেকে সহায়তা পাওয়া অবশ্যই স্বস্তির জায়গা, বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রকট দুর্বলতাগুলো কাটাতে; কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য ফেরানো একটি জরুরি কাজ হলেও বৃহত্তর কাজ হচ্ছে অর্থনীতির চাকাকে আরও চাঙা অবস্থায় ফেরানো; যাতে কর্মসংস্থান ত্বরান্বিত হতে পারে, বিনিয়োগ বাড়তে পারে, দ্রব্যমূল্য সহনীয় করার জন্য বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি হতে পারে। আইএমএফের কয়েক বিলিয়ন ডলারের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ শত শত বিলিয়নের সম্ভাবনার দিকেই নজর দিতে হবে এবং তা দিতে হবে কার্যকরভাবে, শুধু ঘোষণা ও আমলাতান্ত্রিক আশ্বাসের মধ্য দিয়ে নয়।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ভারত মেনে নেয়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের এই অবস্থানকে কীভাবে দেখছেন?

হোসেন জিল্লুর: ভারত যে বাংলাদেশের পরিবর্তন ভালোভাবে নেয়নি, এটা তো পরিষ্কার। তাদের বৈদেশিক নীতি দৃষ্টিকটুভাবে ও অতিমাত্রায় একনেত্রীকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিল। তাদেরও এখন বোঝাপড়া করতে হবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে কীভাবে সংশোধন করবে, বাংলাদেশকে নিজের জন্য একটি মানসিক রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে তিনটি নীতি দৃষ্টিভঙ্গির ওপর দাঁড়িয়ে। এই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম বার্তা হচ্ছে—বাংলাদেশ যেকোনো ধরনের আধিপত্যবাদী চাপ বরদাশত করবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক আর আধিপত্যবাদী চাপকে রুখে দাঁড়ানো—এ দুটি আলাদা বিষয়। মানে আমরা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অবশ্যই সুসম্পর্ক রক্ষা করব এবং একই সঙ্গে কোনো আধিপত্যবাদী মনোভাবকে মেনে নেব না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে ধরা এবং এ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। আমাদের ঠিক করতে হবে বাংলাদেশকে আমরা কোথায় নিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতীকে পরিণত হওয়া কোনো অলীক কল্পনা নয়। তৃতীয়ত, আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সংকীর্ণ মাইন্ডসেটআপে আবদ্ধ রয়েছি। এই মানসিক পরিসর বাড়ানো জরুরি। বাংলাদেশের মানসিক শক্তির যে বিকাশ ঘটেছে, এখন থেকে আমাদের বৈশ্বিক দক্ষিণকেও আমাদের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং ধাপে ধাপে বৈশ্বিক দক্ষিণের অন্যতম জাতি রাষ্ট্রে উন্নীত করতে হবে।

প্রথম আলো:

ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশে পরিবর্তনের এটাই শেষ সুযোগ। আপনার মন্তব্য কী?

হোসেন জিল্লুর: আসলে শেষ সুযোগ বলে কিছু নেই। সুযোগ সব সময় থেকেই যায়। কোনো কারণে কোনো কিছু বাধাগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশের মানুষের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা রয়ে যাবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের মনে অনেক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে সুযোগও তৈরি হয়েছে। সরকার যাতে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালোমতো সেই কাজগুলো করতে পারে, সে জন্য আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। তবে এটাই শেষ সুযোগ—এমন ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। বাংলাদেশের মানুষ সব সময় তার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করে গেছে, ভবিষ্যতেও তারা তা-ই করবে।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

হোসেন জিল্লুর রহমান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

{শেষ}