আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখছেন কি?
ড. হারুন–অর–রশিদ: না, কোনো শঙ্কা দেখছি না। জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশ এই নির্বাচনে অংশ নেবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও বিএনপি ছাড়া সব বড় দল নির্বাচন করছে। আশা করি, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে।
কিন্তু বিএনপি তো জনগণের প্রতি নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে। ২৮ অক্টোবর থেকে রাজপথ উত্তপ্ত। একদিকে বিরোধী দলের হরতাল–অবরোধ; অন্যদিকে পুলিশের গণগ্রেপ্তার, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে তল্লাশি। বিভিন্ন স্থানে তাঁদের ওপর গুপ্তহামলার ঘটনাও ঘটছে। এ অবস্থায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আশা করা যায় কি?
হারুন–অর–রশিদ: নির্বাচন নিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনা সব দেশেই ঘটে। ভারতেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শত শত লোক মারা যায়। তবে বিএনপি যেহেতু নির্বাচনে আসছে না, সেহেতু নির্বাচনটা সুষ্ঠু ও অবাধ করা সরকারের চ্যালেঞ্জ। অতীতের মতো তারা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে আশা করি। নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু না হয়, অনেকেই চেষ্টা করবে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফল হবে না।
নির্বাচনে কার সঙ্গে কার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে? আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আবার জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিকেরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন–সমঝোতা করতে চাইছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।
হারুন–অর–রশিদ: আওয়ামী লীগ জোটবদ্ধ নির্বাচন অতীতেও করেছে। এবার করলেও দোষের কিছু নেই। আপনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সমঝোতার কথা বলছেন। কিন্তু এর বাইরেও অনেক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে; যেমন তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ইত্যাদি। আমি মনে করি, নির্বাচনটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। এ ছাড়া নির্বাচনের বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। ২৯ জানুয়ারির আগে নির্বাচন হতে হবে।
বিএনপির মহাসচিবসহ অনেক নেতাকে জেলে পাঠানো হয়েছে নাশকতার মামলায়। বলা হয়েছে তাঁরা হুকুমের আসামি। একই মামলার আসামি ছিলেন বিএনপির নেতা শাহজাহান ওমর। কিন্তু তিনি জামিন পাওয়ার পরদিনই নৌকা প্রতীক পেয়ে গেলেন। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে অন্য নেতারাও কি মুক্তি পেতেন?
হারুন–অর–রশিদ: এটা আইনগত প্রশ্ন। আসলে বিএনপিকে এই পথে নিয়ে গিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি নিজে নির্বাচন করতে পারবেন না বলে অন্যদেরও নির্বাচন করতে দেননি। বিএনপির মহাসচিব ও অন্য নেতারা তো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সিদ্ধান্ত আসে লন্ডন থেকে। বিএনপি যদি নির্বাচন বর্জন করতে থাকে, তাহলে আরও অনেকে দল ছাড়বেন।
নির্বাচন বর্জন শুধু বিএনপিই করেনি; ১৯৯৬ সালে (১৫ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে আওয়ামী লীগও নির্বাচন বর্জন করেছিল। এ জন্য আওয়ামী লীগ যদি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে থাকে, বিএনপি কেন হবে?
হারুন–অর–রশিদ: ১৯৯৫-৯৬ সালের আন্দোলনের সঙ্গে এখনকার আন্দোলন মেলালে হবে না। সে সময় জাতীয় সংসদ থেকে ১৪৭ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। সে সময় বিরোধী দল সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল। বিএনপি এখন কি সে অবস্থা তৈরি করতে পেরেছে? তাদের আন্দোলনে জনগণের সমর্থন নেই।
এ সপ্তাহে বিএনপি তো হরতাল-অবরোধ দেয়নি। মানববন্ধন কর্মসূচি নিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার কি গণগ্রেপ্তার থেকে সরে আসবে?
হারুন–অর–রশিদ: ভবিষ্যতে তারা কী কর্মসূচি নেয়, সেটা দেখতে হবে। বিএনপি যদি সহিংস কর্মসূচি থেকে সরে আসে, তাহলে বলব, তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। বিএনপির এক দফার আন্দোলন তথা নির্বাচনে না যাওয়া চরম আত্মঘাতী। এ জন্য তাদের খেসারত দিতে হবে।
৭ জানুয়ারি নির্বাচন হয়ে গেলেই কি দেশে যে রাজনৈতিক সংকট আছে, তা কেটে যাবে?
হারুন–অর–রশিদ: শিগগির কাটবে না। অনেক সময় লাগবে। দেখতে হবে সংকটের শুরুটা কোত্থেকে। এখানে দুটি আদর্শের দ্বন্দ্ব। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব সেটা ধারণ করে না। এ কারণেই তারা নিজামী–মুজাহিদকে মন্ত্রী বানায়। নির্বাচনের পর সরকারের দায়িত্ব হবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা এবং নিত্যপণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা। এই দুটি দলের মধ্যে আরেকটি পার্থক্য হলো আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়। তিন বছর পরপর এর সম্মেলন হয়। বিএনপির সম্মেলন কবে হয়েছে, সেটা পঞ্জিকা দেখে বলতে হবে। যে দলের প্রতিষ্ঠা অগণতান্ত্রিকভাবে, সেই দল গণতান্ত্রিক ধারায় চলতে পারে না।
সিভিকাস নামের একটি সংগঠনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার আক্রমণের মুখে।
হারুন–অর–রশিদ: এসব সংস্থা কাদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত নেয়, সেটাও দেখতে হবে। সরকারবিরোধী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে তথ্য নিলে এক রকম সিদ্ধান্ত আসবে; সরকারের পক্ষের সংগঠনের তথ্যের ভিত্তিতে করলে অন্য রকম। আর বাক্স্বাধীনতার কথা বলছেন। এই সরকারের আমলে অনেক বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে বিএনপি নেতারা এসে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন, কেউ বাধা দেয় না। আর বিএনপি ক্ষমতায় এসে ইটিভি বন্ধ করে দিয়েছিল।
৭ জানুয়ারি ভোট। কিন্তু কোথাও ভোটের আমেজ দেখা যাচ্ছে না। এর অর্থ কি এ–ই, নির্বাচন নিয়ে জনগণের তেমন আগ্রহ নেই?
হারুন–অর–রশিদ: এটা ঠিক নয়। ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। ১৮ তারিখ থেকেই প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় যাবেন। সর্বত্র উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যাবে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে যাবে। নির্বাচনের পরও কোনো রাজনৈতিক সংকট দেখছি না। বহু আসনে জোর প্রতিযোগিতা হবে। সরকারের দায়িত্ব হবে, মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে এবং কোনো পক্ষ যাতে নির্বাচন প্রভাবিত করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা। এটা সরকারের বড় পরীক্ষাও। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।
বিএনপিসহ ১৫টি নিবন্ধিত দল যেখানে অংশ নিচ্ছে না, সেখানে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কীভাবে? ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জিতেছিলেন।
হারুন–অর–রশিদ: আমার মনে হয়, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমস্যা হবে না। পশ্চিমা দেশগুলোয় কত শতাংশ মানুষ ভোট দেয়? তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এই নির্বাচনে ভোট দেবে। আর কতসংখ্যক মানুষ ভোট দিল, তা দিয়ে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণ করা হয় না। মানুষ বিনা বাধায় ভোটকেন্দ্রে যেতে পারলেই হলো।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
হারুন–অর–রশিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।