নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেক সংগঠন আছে। তারপরও আপনারা ‘গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি’ নামে নতুন সংগঠন করলেন কেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: কারণ, অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে এবং ছাত্র ও জনতার মধ্যে গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রত্যাশা জেগে উঠেছে। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এ সময়ে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা আবশ্যক। গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে আমরা বুঝি—১. অধিকার ও সুযোগের সাম্য; ২. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং ৩. রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে প্রকৃত ও জবাবদিহিমূলক জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। এটি সম্ভব একটি সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করতে চাই।
এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে যে গণ–অভ্যুত্থান ঘটল এবং আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হলো, তার সঙ্গে আগের গণ–আন্দোলনগুলোর পার্থক্য কী ছিল?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: প্রথম পার্থক্য স্বতঃস্ফূর্ততা ও ব্যাপক অংশগ্রহণ। এ অভ্যুত্থান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ঘটেনি, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে বটে, কিন্তু ‘অভ্যুত্থানটি ঘটেছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। দ্বিতীয়ত, আন্দোলন দমনে এমন নৃশংসতা আগে কখনো দেখা যায়নি। তৃতীয়ত, মানুষের প্রতিরোধও ছিল অসামান্যরূপে ঐক্যবদ্ধ ও দুঃসাহসী। চতুর্থত, অধিকার ও সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধিতা ছিল অভ্যুত্থানের মূল চালিকা শক্তি।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: প্রথম প্রত্যাশা, মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা ও আবহাওয়া তৈরি হয়েছে, তাকে মর্যাদা দেওয়া ও স্থায়ী করা। এরপর অনেকগুলো প্রত্যাশা আছে, যেমন অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দান; যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ও মানুষকে আহত করেছে, সেই অপরাধীদের আইনি ব্যবস্থার অধীন আনা; পুলিশ ও র্যাবের হাতে যে অপরিমেয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, তার লাগাম টেনে ধরা; সম্পদ পাচার, লুণ্ঠন ও দুর্নীতি বন্ধ করা; কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা; দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চতকরণ, সব ধরনের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া; পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারা পরিহার করে উন্নয়নকে সামাজিক মালিকানার অভিমুখী করার নীতি গ্রহণ।
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছে। কতটা সংস্কার করতে পারবে বলে মনে করেন? এ বিষয়ে আপনাদের কোনো পরামর্শ বা প্রস্তাব আছে কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: কতটা সংস্কার সম্ভব, সেটা নির্ভর করবে জনগণের আন্দোলনের ওপর। সরকারের প্রতি আমাদের পরামর্শ দ্রত পদক্ষেপ নেওয়ার এবং আমাদের নিজেদের মূল কর্তব্য হবে জনগণকে সচেতন করে তোলা। মৌলিক পরিবর্তন এই সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়; তবে সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তরের যে অঙ্গীকার সরকার নিয়েছে, তার বাস্তবায়ন তো অবশ্যই করতে হবে।
২০০৭ সালে সেনা–সমর্থিত সরকারও রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা প্রকৃতপক্ষে কোনো সংস্কার করতে পারেনি। এবারও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: নিশ্চয়তা একটাই। সেটা হচ্ছে জনমত। জনমতকে সুসংগঠিত ও সুশিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব গণতন্ত্রকামী সব সংগঠনের এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের।
আপনারা দখলদারমুক্ত গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তো পদপদবি নিয়ে দখলবাজি শুরু হয়েছে। আবার কেউ কেউ অন্যায়ভাবে নিগৃহীতও হয়েছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সব দল ও মতের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদের নিয়মিত নির্বাচন একেবারেই অপরিহার্য। নির্বাচন না হওয়াটাই প্রধান কারণ ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে না ওঠার। পরিণামে সরকারি দলের আধিপত্য ও অত্যাচার প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অন্যায়ভাবে শিক্ষকদের ওপর নিগ্রহের ঘটনা সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য।
মামলার ক্ষেত্রে আগের সরকার যেভাবে নিবর্তনমূলক আইন ব্যবহার করত, বর্তমান সরকারও সেটি করছে। তাহলে পরিবর্তন কী হলো?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: পরিবর্তনটা হচ্ছে একটি ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন এবং শাসকদের জন্য এই শিক্ষা যে মানুষকে পীড়ন ও অপমান করে ক্ষমতায় থাকা যায় না, বরং পতনকেই এগিয়ে আনা হয়। পরিবর্তনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটা অনস্বীকার্য। মানুষের ভয় ভেঙে গেছে এবং ঐক্যের শক্তি উপলব্ধিতে এসেছে। অব্যাহত ও ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তনকে সম্ভব করে তুলতে হবে।
আপনারা কৃষক–শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেটা কতটা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, আপনারা কী ধরনের সংস্কার চাইছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, সম্ভব নয়। আমরা যে সংস্কার চাইছি, সেটা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন; সংস্কার নয়। এ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে একটি সামাজিক বিপ্লবের। জনগণের প্রত্যাশা সেটাই। উনসত্তরের অভ্যুত্থানে আসাদ যখন শহীদ হন, তখন আওয়াজ উঠেছিল, ‘আসাদের মন্ত্র, জনগণতন্ত্র’। জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেটির প্রতিষ্ঠা না ঘটলে মানুষের মুক্তি ঘটবে না; মেহনতি মানুষের ওপর শাসন–শোষণ আরও বৃদ্ধি পাবে।
সাবেক সরকারের মন্ত্রী-কর্মকর্তা ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে যেভাবে গণহারে হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে, তাতে ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? আওয়ামী লীগ আমলে একই কায়দায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতের মানুষের বিরুদ্ধে হত্যা ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে জেলে আটকে রাখত।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এভাবে মামলা দেওয়া মোটেই সংগত নয়। চিহ্নিত অপরাধীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্ত করা দরকার। ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা চাই।
গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে নির্বাচন হতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কি সংস্কারের জন্য প্রস্তুত?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, মোটেই প্রস্তুত নয়। দেশে রাজনৈতিক দল অনেক, কিন্তু ধারা হলো দুটি—বুর্জোয়া ধারা ও গণতান্ত্রিক ধারা। গণতান্ত্রিক ধারার কাছেই আমাদের প্রত্যাশা। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো যদি একটি গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলে, তাহলে মানুষ বিপুলভাবে সাড়া দেবে এবং বুর্জোয়া ধারার (অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি) একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারাকে দৃশ্যমান দেখে আশায় ও ভরসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হবে। বিদ্যমান রাজনীতিবিমুখতা কেটে যাবে। গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেবে; তাদের দাবি থাকবে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদে প্রতিনিধিত্বের। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে, তার কর্তব্যের মধ্যে একটি হবে অগণতান্ত্রিক উপাদানগুলোকে বিলুপ্ত করে সংবিধানকে গণতান্ত্রিক করে তোলা। গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট কাজ করবে সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগই উপাচার্যশূন্য। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পুরো প্রশাসনই পদত্যাগ করেছে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুত চালু করতে হলে কী করণীয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: প্রথম করণীয় হচ্ছে শিক্ষাকে গুরুত্বদান। দ্বিতীয় কর্তব্য উপযুক্ত উপাচার্য নিয়োগ করা। এই উপাচার্যরা হবেন একাধারে শিক্ষকতা ও গবেষণার জন্য খ্যাতিমান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকের দায়িত্ব পালনের জন্য দক্ষতাসম্পন্ন। তাঁরা অন্য শিক্ষকদের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে একই সঙ্গে শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র—এ সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য উপাচার্যদের দায়িত্ব হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।