সাম্য ও মানবতার কান্ডারি দুখু মিয়া আজীবন সংগ্রাম করে জীবন পার করেছেন বলে নিপীড়িত মানুষের মর্মব্যথা তিনি বাঁধতেন সুনিপুণ কথামালায়। 'কুলি-মজুর' কবিতায় তিনি লিখেছেন,
‘যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
১.
উপমহাদেশে চা শিল্পের গোড়াপত্তনের ইতিহাস খুব একটা অজানা নয়। এই জনপদে ১৬৮ বছর আগে শুরু হওয়া এই শিল্পের শ্রমিকদের ভাগ্য বিড়ম্বনা বহুল চর্চিত অথচ অবহেলিত বিষয়াবলির একটি। শ্রীলঙ্কা ও ভারতের নানান প্রদেশ থেকে দিন বদলের প্রলোভনে আনা হতভাগ্য মানুষগুলোর প্রতি ব্রিটিশদের করা অবিচার একবিংশ শতাব্দীতেও দেদারসে চলছে। একশো কুড়ি থেকে তিনশো টাকায় মজুরি উন্নীত করতে এদের রাজপথে নামতে হয়েছে। 'নিরিখ' পূর্ণ করতে পারলে মেলে পূর্ণ মজুরি। অর্থাৎ, ২৩ কেজি পাতা তুললে মজুরি মেলে ১২০ টাকা। ১ কেজি বেশি তুললে অতিরিক্ত যোগ হয় ৪ টাকা ২৫ পয়সা আর ১ কেজি কমে কাটা যায় ৫ টাকা ২০ পয়সা। হিসাবের কী সূক্ষ্ম কারুকাজ!
দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত চা শ্রমিকদের পক্ষে ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না কোনো কালে। দেশের ন্যূনতম মজুরির এ পেশাজীবীরা জীবনধারণে খেয়ে থাকে 'পাতিছানা' নামে চা পাতার ভর্তা যা আমাদের রুচির নিরিখে অখাদ্য। শর্করা ব্যতীত আমিষ, স্নেহ বা ভিটামিন জাতীয় খাদ্যদ্রব্যের সাথে তাঁদের দেখা হয় কালে-ভদ্রে।
মালিকপক্ষের কাছ থেকে অনুগ্রহের দান হিসেবে মোটাদাগে তিনটি জিনিস পায় চা শ্রমিকেরা। মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে কয়েদখানার মতো জায়গায় একখানা ঝুপড়ি, গড়ে ৩ কেজির মতো রেশন (চাল অথবা গম), আর প্যারাসিট্যামলনির্ভর চিকিৎসা সেবা। কিছু এনজিওর বদান্যতায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চললেও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, সুযোগের সীমাবদ্ধতা, দারিদ্র্য ও যোগাযোগের বৈরী পরিবেশে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয় সেখানকার শিশুরা। দারিদ্র্যের থাবায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝরে পড়ার হারও বেশ প্রবল।
২.
নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য। সেই তাগিদে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির এ জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় যুক্ত করতে ভোটাধিকার দেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এখনো চা শ্রমিকেরা বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। পাশাপাশি, গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন দেশের অর্থনীতিতে। বিশ্বের মোট চায়ের ৩ শতাংশ উৎপাদনকারী এ শিল্পের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান প্রায় ১ শতাংশ। অথচ, রাষ্ট্র তাঁর পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর প্রতি সদয় আচরণে ব্যর্থ হয়েছে। চা রপ্তানির বৈদেশিক আয়ের ন্যূনতম অংশও শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করার নজির নেই। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারগুলো কতটা ভোগ করছে প্রান্তিক জনপদের চা শ্রমিকেরা? স্বাধীন ও আধুনিক যুগে দাসত্বের শিকলে কেন বন্দী চা শ্রমিকেরা? রাষ্ট্র যত দ্রুত উদ্ভূত বৈষম্য নির্ণয় করে সমাধানে মনোযোগী হবে ততই মঙ্গল।
ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধনীর ধন বৃদ্ধিই মুখ্য উদ্দেশ্য। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে লাখো মানুষের সম্পদ। ফলাও করে প্রচার করা মাথাপিছু আয়ের হিসাব কতটা ফাঁকা বুলি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় জীবন জিইয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সমাজ। সংসারের চৌকাঠ চরম দারিদ্র্যের অভিঘাত থেকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করা জনগোষ্ঠীর দুর্দশায় তামাশা দেখছে সমাজের এলিট ক্লাস। সাধারণ আয়ের মানুষের নাভিশ্বাসের কালে ১২০ টাকার বাগানিয়ার সংগ্রাম বুঝতে অন্তত অর্থনীতিবিদ হওয়া লাগে না। ঠকবাজ মালিক আর নীতিহীন রাজনীতিক না হলেই যথেষ্ট।
৩.
বাহারি বিজ্ঞাপন ভর করে চলছে দেশের চা শিল্পের জমজমাট ব্যবসা। দুষ্ট মিষ্টি মুহূর্ত উপভোগ কিংবা সতেজ প্রতিবাদে চায়ের কেরামতি আমরা দেখেছি। কাপ শেষের পরেও যে রেশ রয়ে যায় সেটাও অস্বীকার করার জো নেই। অর্থনীতির আকার বাড়ার সাথে সাথে দেশে নতুন করে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেড়েছে। দরিদ্র কিংবা নিম্নবিত্ত মানুষেরও চা পানে কার্পণ্য নেই। কাজেই, দেশে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু এ শিল্পের নেপথ্যের নায়কদের ভাগ্য কতটা সুপ্রসন্ন হয়েছে সেটাও দেখার সময় এসেছে। চা কোম্পানিগুলোর নাগরিক, ঝকঝকে বিজ্ঞাপন আমাদের চোখে পেছনের কারিগরদের শ্রমের মূল্যায়নে পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে। এ যেন জনক ভুলে সৃষ্টি নিয়ে মাতামাতি! চা শ্রমিকদের অক্লান্ত শ্রমের স্বীকৃতি না দিয়ে তাঁদের প্রতি করা অন্যায়কে প্রলম্বিত করতে পারি না। চা শ্রমিকদের চলমান দুর্দশার পেছনের এক কোণ জুড়ে আছে ভোক্তাদের দায়। কোম্পানির নির্ধারিত মূল্যে প্যাকেটজাত চা পাতা আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে কিনছি। কিন্তু এ শিল্পের শ্রমিকদের প্রতি মালিকপক্ষের করা অন্যায়ে আমরা তাঁদের জোরালো সমর্থন করছি না। ফলে, মুনাফালোভী মালিকদের জবাবদিহি নিশ্চিত হচ্ছে না। অথচ, ভোক্তাদের কঠিন ও সমন্বিত ভূমিকা চা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারত।
দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির সময়ে ১২০ টাকা মজুরি কতটা অমানবিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চা শ্রমিকদের প্রস্তাবিত ৩০০ টাকা মজুরিতে তাঁদের জীবনমানে উন্নতির ছোঁয়া লাগার কোনো উপসর্গ নেই। বেঁচে থাকার সংগ্রামে একটু হাফ ছেড়ে বাঁচতে চাওয়া এ জনগোষ্ঠীর দাবি যে কোনো বিশ্লেষণে যৌক্তিক। গ্রিন, ব্ল্যাক, লেমন, জিঞ্জার, তুলসী, মাসালা, আমলকী, ত্রিফলা, ক্যাফেইন—নন ক্যাফেইন স্বাদের চা অভিজাত রেস্তোরাঁ বা হোটেলগুলোতে ভোক্তারা চড়া দামে পান করছে যাঁর কাপ প্রতি মূল্য ক্ষেত্রবিশেষে একজন চা বাগানিয়ার এক সপ্তাহের বেতনেরও অধিক।
আধুনিক দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে থাকা প্রতিটি যোদ্ধার প্রতি উষ্ণ শুভেচ্ছা।
মাহমুদুল হাছান
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
[email protected]