ইসরায়েলি হামলায় বৈরুতে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ও তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ইরান ১ অক্টোবর ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইরানের এই হামলার পর থেকে তেল আবিব কী জবাব দিতে পারে, তা নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা হয়েছে।
কিছু পর্যবেক্ষক মনে করছেন, ইসরায়েল ইরানের তেল স্থাপনায় আঘাত হানতে পারে; আবার কেউ কেউ বলছেন, তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন এই দুটি আইডিয়ারই বিরোধিতা করছে বলে মনে হচ্ছে। তবে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে একটি টার্মিনাল হাই অলটিচ্যুড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেওয়ার এবং ইসরায়েলে মার্কিন সেনা মোতায়েনের অনুমোদন দিয়েছে। সম্ভবত ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র এসবের অনুমোদন দিয়েছে।
এদিকে বাইডেনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলকে ‘প্রথমেই পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করতে’ উসকানি দিয়েছেন। ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারও এই পরামর্শ দিয়েছেন।
ট্রাম্প, কুশনার ও অন্য যে কট্টর ইসরায়েল সমর্থকেরা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলি হামলাকে উৎসাহিত করছেন, তাঁরা সম্ভবত ১৯৮১ সালে ইরাকের একটি পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েলের চালানো আরেকটি হামলা থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব কমই জানেন।
ইসরায়েল ১৯৮১ সালে ফ্রান্স নির্মিত ইরাকি ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিটি ধ্বংস করেছিল। ওই হামলা মূলত গোপনে ইরাককে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি চালানোর বিষয়ে প্রেরণা জুগিয়েছিল এবং ইরাকের তৎকালীন নেতা সাদ্দাম হোসেনকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে উৎসাহিত করেছিল।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে যদি হামলা চালানো হয়, তাহলে সেটিও সম্ভবত একই ধরনের প্রভাব ফেলবে।
ইরাকের পারমাণবিক কর্মসূচি ১৯৬০-এর দশকে শুরু হয়েছিল। এতে সহায়তা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা ইরাকে একটি ছোট পারমাণবিক গবেষণা চুল্লি তৈরি করেছিল এবং ইরাকিদের কিছু প্রযুক্তিগত জ্ঞান সরবরাহ করেছিল। ১৯৭০-এর দশকে ইরাক ফ্রান্স থেকে ওসিরাক নামের একটি বড় চুল্লি কেনে। এরপর ফ্রান্স ও ইতালির উল্লেখযোগ্য সহায়তায় ইরাক বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে।
ফরাসি সরকার চুল্লিটির দ্বৈত ব্যবহারের সম্ভাবনা প্রতিরোধে কারিগরি ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিল এবং এ বিষয়ে তারা ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তথ্য আদান–প্রদান করেছিল।
ইরাক পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে সই করেছিল এবং তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো নিয়মিত আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের আওতায় ছিল। ইসরায়েল অসত্যভাবে দাবি করেছিল, ইরাক ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে’। আসলে ইরাকের পরমাণু কর্মসূচি মোটেও সে অবস্থায় ছিল না।
ইসরায়েলের সরকার ওই সময় অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের মুখোমুখি ছিল এবং আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে সম্ভাব্য পরাজয়ের মুখে ছিল। অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও সম্ভাব্য পরাজয় এড়াতে সে সময়ের ইসরায়েলি সরকার ‘আগাম হামলা’ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৮১ সালের ৭ জুন ইসরায়েল ওসিরাক চুল্লিতে হামলা চালায়। হামলায় চুল্লিটি ধ্বংস হয়। এতে তিনজন ইরাকি বেসামরিক নাগরিক এবং একজন ফরাসি প্রকৌশলী নিহত হন।
এই আক্রমণ ইসরায়েলিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা তৈরি করেছিল, যা কিনা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনকে তিন সপ্তাহ পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে জয় ছিনিয়ে নিতে সহায়তা করেছিল।
২০২১ সালে প্রকাশিত একটি মার্কিন নথি থেকে জানা যায়, ইসরায়েলের ওই হামলা ইরাকের কর্মসূচিকে ধ্বংস করতে পারেনি; বরং সাদ্দামকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের জন্য আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করেছিল।
এই হামলা আরও অনেক ইরাকি বিজ্ঞানীকে তাঁদের দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিতে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। ইরাকি পরমাণুবিজ্ঞানী জাফর দিয়া জাফর তাঁর স্মৃতিচারণামূলক বইয়ে লিখেছেন, ‘তামুজে (ওসিরাক) ইসরায়েলি বোমা হামলা অনেককে ক্রুদ্ধ করেছিল এবং তারা মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি রাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রের একচেটিয়া অধিকার শেষ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।’
পরবর্তী বছরগুলোয় সাদ্দামের সরকার গোপনে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি চালাতে শুরু করে এবং পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কাজ করতে থাকে। এ সময় সাদ্দাম ধ্বংসপ্রাপ্ত চুল্লি পুনর্নির্মাণেরও চেষ্টা করেন।
ইরাকের এই প্রচেষ্টা ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের কারণে ধীর হয়ে যায়। এই যুদ্ধ ইরাকের অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয় এবং পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ইরাকের অর্থনীতিকে নিঃশেষ করে দেয়।
ইরানে হামলার পরিণতি
গত কয়েক বছরে ইরানের বেশ কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের নভেম্বরে মোহসেন ফখরিজাদেহ নামের একজন পারমাণবিক পদার্থবিদ এবং পারমাণবিক কর্মসূচির উচ্চপদস্থ সদস্য তেহরানের কাছে একটি হামলায় নিহত হন।
ইরান এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। অতীতে অন্য বিজ্ঞানীদের হত্যাকাণ্ডের জন্যও তারা ইসরায়েলকে দায়ী করেছে।
যদিও হামলা করে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের হত্যা করা হয়েছে; কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ড ইরানে পরমাণুবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে। এর মাধ্যমে ইরানে ‘পারমাণবিক জাতীয়তাবাদ’ নামের নতুন একটি উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর ধারাবাহিক আঘাত হানার ফলে এই চেতনা আরও শক্তিশালী হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পরের ঘটনাগুলো এই অনুভূতিকে আরও উদ্দীপ্ত করেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে পরিচালিত একটি জরিপ দেখাচ্ছে, ইরানের একটি শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থন খুবই বেশি। এর বাইরে এখন জনমনে একটি বৃহত্তর ঐকমত্য রয়েছে যে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র থাকা উচিত। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৬৯ শতাংশ বলেছেন, তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরির উদ্যোগ সমর্থন করবেন।
এটি স্পষ্ট, ইসরায়েলের এখন পর্যন্ত যেসব কাজকারবার করে এসেছে, তা শুধু ইরানকে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করেছে। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় কোনো ধরনের হামলা হলে তা ইরানের সেই সংকল্পকে আরও দৃঢ় করবে।
আজ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেকে তাঁর পূর্বসূরি বেগিনের জায়গায় দাঁড় করাচ্ছেন। তিনি যে সরকার পরিচালনা করছেন, সেটি বিভিন্ন ব্যর্থতার জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। এ কারণে তিনি বেগিনের মতো ইসরায়েলি জনগণের কাছে ‘বিজয়’ প্রদর্শন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
কিন্তু নেতানিয়াহু গাজা ও লেবাননে যা করছেন এবং ইরানে যা করতে যাচ্ছেন, তা ইসরায়েলকে বিজয় এনে দেবে না। তাঁর কৌশল এই দেশগুলোয় এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। এই ক্ষোভ ইরান ও তার মিত্রদের আরও দ্রুত পুনর্গঠনে সাহায্য করবে। এটি ইসরায়েলের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে।
ইব্রাহিম আল-মারাশি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি সান মার্কোসের মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ