নতুন কোটাপদ্ধতি: জনসংখ্যার সঠিক প্রতিনিধিত্ব কি নিশ্চিত হয়েছে

সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর কোটা নিয়ে প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এখন থেকে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে সরাসরি মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে ৯৩ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ নিয়োগ হবে কোটার ভিত্তিতে। তবে কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করা হবে। নতুন কোটাপদ্ধতিতে জনসংখ্যার সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়েছে কি না, তা নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম

কোটা নিয়ে আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হলেও পরে তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে যায়। ফাইল ছবি: প্রথম আলো

২২ জুলাই ২০২৪ তারিখে সরকারের বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি সংশোধন বিষয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপনের দিকে দৃষ্টি ছিল দেশের অনেক মানুষের। এ প্রজ্ঞাপনে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে নতুন করে কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নতুন কোটাপদ্ধতিতে মেধাভিত্তিক রয়েছে ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের জন্য রয়েছে ৫ শতাংশ,  ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ। একই সঙ্গে এটিও লক্ষণীয় যে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদ সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে।

কোটা সংস্কার নিয়ে বর্তমান বা চলমান সমস্যা সমাধানে নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা সাধুবাদ পেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, কোটাপদ্ধতি সংশোধনের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে কি না।

 প্রথমত, আগের নারী কোটা একেবারেই বাদ দেওয়া সঠিক হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, দেশে প্রথমবারের মতো নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি লক্ষ করা গেছে (নারী ৫০.৪৯ শতাংশ, পুরুষ-৪৯.৫১ শতাংশ)।

■ বর্তমানে নারীর সংখ্যা বেশি হলেও নারীরা এখনো শ্রমবাজারে পিছিয়ে রয়েছেন। আগের নারী কোটা একেবারেই বাদ দেওয়া সঠিক হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

■ দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাতে এটা কি যথার্থ হয়েছে?

■ প্রজ্ঞাপনে ‘শারীরিক’ শব্দটি যুক্ত হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির অবকাশ রয়েছে। অন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হতে পারেন—এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বর্তমানে নারীর সংখ্যা বেশি হলেও নারীরা এখনো শ্রমবাজারে পিছিয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ অনুযায়ী, শিক্ষা, কর্ম বা প্রশিক্ষণে নেই এমন তরুণ-যুবার হার ৩৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এর ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশই নারী। 

আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের শ্রম জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মোট চাকরির ১৫ দশমিক ১ শতাংশ হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক। এর মধ্যে নারীরা রয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। পক্ষান্তরে পুরুষেরা রয়েছে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ।

স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষা রয়েছে, এমন নারীরা আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে কাজ করছেন মাত্র ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে পুরুষেরা রয়েছেন ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এ জরিপ প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য থেকে লক্ষ করা গেছে, শিক্ষার স্তর অনুযায়ী নারীদের ক্ষেত্রে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার (১৮.৮৮ শতাংশ) পুরুষের দ্বিগুণ। আর ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, ১৫ বছর ও এর বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী যাঁরা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে নারীরা পুরুষের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছেন।

বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতায় এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের বিষয়টি এখনো নারীদের অনুকূলে নেই। ফলে নারী কোটা উঠিয়ে দেওয়াটা কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যখন টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৫-এ লিঙ্গসমতা অর্জন এবং সব নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে, তখন এ প্রশ্ন ওঠাটা খুবই প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক।

দ্বিতীয়ত, দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো জনসংখ্যার অনুপাতে এটা যথার্থ হয়েছে কি না?

২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, সমন্বিত মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। তবে শুমারিকালে গণনাকৃত জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। এর মধ্যে ৮ হাজার ১২৪ জন ছিলেন হিজড়া। জনশুমারি-পরবর্তী যাচাই শেষে সমন্বিত জনসংখ্যায় ৪৬ লাখ ৭০ হাজার ২৯৫ জন মানুষ মোট জনসংখ্যায় যোগ হলেও হিজড়াদের সংখ্যা একই থেকে যায়। এর ফলে হিজড়া জনসংখ্যার নির্ভুল তথ্য শুমারিতে উঠে এসেছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

লক্ষণীয় হলো কোটাপদ্ধতি সংশোধন বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে তৃতীয় লিঙ্গের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শুমারিতে ব্যবহৃত হয়েছে ‘হিজড়া’ শব্দটি। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যাখ্যা থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।  

২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, দেশে প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। কিন্তু সরকারেরই প্রতিষ্ঠান পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটা শুমারির তথ্যের দ্বিগুণের বেশি। 

যে বিষয়টা উল্লেখ না করলেই নয়, শুমারিতে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধী এবং মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা সঠিকভাবে উঠে আসেনি। এ ক্ষেত্রে গুণগত উপাত্তের ঘাটতি লক্ষণীয়। জরিপের হারকে শুমারির সমন্বয়কৃত মোট জনসংখ্যার বিচারে হিসাব করলে দেশে ২০২২ সালে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৭ লাখ ৫৫ হাজারের মতো।

এ রকম অবস্থায় প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে প্রদত্ত কোটা আরও বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা যেত। অধিকন্তু প্রজ্ঞাপনে ‘শারীরিক’ শব্দটি যুক্ত হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির অবকাশ রয়েছে। এর ফলে অন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হতে পারেন—এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী বলতে একজন ব্যক্তির দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, বিকাশগত বা সংবেদনশীলতার ক্ষেত্রে বৈকল্য এবং উপলব্ধিগত ও পরিবেশগত বাধার সংমিশ্রণকে বোঝায়, যা তাঁকে অন্যদের সঙ্গে সমানভাবে সমাজে অংশগ্রহণে পরিপূর্ণভাবে বা আংশিক এবং কার্যকরভাবে বাধা দেয়। এ আইনে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধীর কথা বলা হয়েছে। কাজেই প্রজ্ঞাপন থেকে  ‘শারীরিক’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ শব্দটি রাখা উচিত ছিল।  

তৃতীয়ত, কোটাপদ্ধতি সংশোধনের প্রজ্ঞাপনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ কোটা রয়েছে। ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী দেখা যায়, দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ (১৬ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৮ জন)। ২০১১ সালের শুমারিতে ছিল ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১। অর্থাৎ ১১ বছরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বেড়েছে ৬৪ হাজার। অথচ ২০১১ সালেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের ওপরে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতা ও গবেষকেরা মনে করেন এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা। 

লক্ষণীয়, ২০১১ সালের আদমশুমারিতে শুধু ২৪টি ভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। অন্যদিকে ২০২২ সালে ৫০টি জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করা উচিত এবং কোটা নির্ধারণে সেটাকে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।  

চতুর্থত, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের জন্য আগের ৩০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ কোটায় কমিয়ে আনার বিষয়টি কোন মানদণ্ডে বা পরিমাণগত জনসংখ্যার ভিত্তিতে করা হয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সূত্রে মোট গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৭। তবে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৫৮ জনের নামে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা (মাসিক সম্মানী) দেওয়া হয়েছে। তবে ২০২১ সালের মার্চে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে অসম্পূর্ণ তালিকায় এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭।

সংখ্যাগত এই তারতম্যের কারণে মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্ভুলভাবে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের তালিকা করা উচিত ছিল। এরপর সংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বশীল কোটা বণ্টন হতে পারত। সে ক্ষেত্রে বর্তমান ৫ শতাংশের চেয়ে সেটা আরও কমানো যেতে পারত।

এ রকম অবস্থায় উপরিউক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতে আমাদের দেশে একটি ‘কোটা কর্ম কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশন নির্দিষ্ট সময় অন্তর শ্রমবাজারের হালনাগাদ চিত্র বিশ্লেষণ করে কোটাপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে সুপারিশ করতে পারবে।

এই সুপারিশ অবশ্যই হতে হবে সংবিধানের আলোকে, কোটা-সম্পর্কিত বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা এবং জনসংখ্যার সঠিক ও প্রতিনিধিত্বশীল গুণগত উপাত্তের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। এ কমিশনের মূল লক্ষ্য থাকবে চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে জনগণের অধিকার ও পছন্দকে নিশ্চিত করা। এভাবে উন্নয়নকে টেকসই বা বজায়যোগ্য করতে হবে।

  ●ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়