ওবেসিটি বা স্থূলতা বা মেদাধিক্য বা ওজনাধিক্য একটি বহুমুখী বৈশ্বিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যা দিনকে দিন চিকিৎসাবিদদের জন্য একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান মতে, যদিও স্থূলতা বা মেদাধিক্য, মেদবহুলতা, ওজনাধিক্য শব্দগুলোর অর্থ বা বিশ্লেষণ এক নয়, তবে এই শব্দগুলো একে অপরের পরিপূরক বলা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রতি আটজনের একজন স্থূলতা বা মেদাধিক্য সমস্যায় ভুগছেন। এই পরিসংখ্যানের মতে, ২০২২ সালে স্থূলতার সংখ্যা ১৯৯০ সালের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি এবং কিশোর-কিশোরীদের স্থূলতার সংখ্যা বর্তমানে ১৯৯০ সালের চেয়ে চার গুণ বেড়েছে।
তা ছাড়া ২০২২ সালে ৩৯ কোটির বেশি শিশু-কিশোরের বিএমআই সূচক অনুসারে ওজন বেশি ছিল এবং তাদের মধ্যে ১৬ কোটি শিশু-কিশোরই স্থূলতা সমস্যায় ভুগছে, যা সত্যিকার অর্থেই আশঙ্কাজনক ও ভবিষ্যতের জন্য গভীর চিন্তার বিষয়।
স্থূলতা বর্তমানে এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে এ ধারায় বাড়তে থাকলে ২০৩০ সালে প্রায় ১০০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক লোক স্থূলতায় আক্রান্ত হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতি, সমাজনীতি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য অশনিসংকেত। অত্যধিকভাবে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, অত্যধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার এবং কায়িক পরিশ্রম, খেলাধুলার প্রতি অনীহা ইত্যাদি স্থূলতা বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করছে।
ওবেসিটি যে সমস্যা তৈরি করছে?
ওজনাধিক্য বা স্থূলতার পেছনে বংশপরম্পরায় জিনগত বৈশিষ্ট্য, হরমোনজনিত সমস্যা, মাত্রাতিরিক্ত জাঙ্ক ও ক্যালরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, কায়িক পরিশ্রম ও খেলাধুলার সুযোগের অভাব, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ নানা কারণ থাকতে পারে।
এই স্থূলতার কারণে নানান রোগ হতে পারে, যেমন ডায়াবেটিক, হৃদ্রোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ, স্নায়ুরোগ, নিদ্রাহীনতা, হজমজনিত রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, পিত্তথলির পাথর, কোলন ক্যানসার, মনোপজাল স্তন ক্যানসার, কোলন এবং এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যানসার, ফ্যাটি লিভার, আর্থ্রাইটিস, স্ট্রোক, হৃৎপিণ্ড ধমনি রোগ, কোলেস্টেরল, ইনফার্টিলিটি ইত্যাদি।
এদিকে স্থূলতা শিশু–কিশোরদের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ পর্যায়ে স্থূলতার আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব এবং উত্তরণে করণীয় নিয়ে সামান্য আলোকপাত করছি।
ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ওয়ার্ল্ড ওবেসিটি ফেডারেশন মেদবহুলতা, ওজনাধিক্য, স্থূলতাকে বহুমাত্রিক বৈশ্বিক স্বাস্থ্যগত মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এ সমস্যার কোনো একক, স্বল্পমেয়াদি বা সহজ সমাধান নেই। এ সমস্যার মোকাবিলা কেবল আন্তরাষ্ট্রীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমেই সম্ভব।
এককভাবে কোনো সংস্থা বা দেশের পক্ষে এই ক্রমবর্ধমান সমস্যার প্রতিরোধ প্রায় অসম্ভবই বটে। ওয়ার্ল্ড ওবেসিটি ফেডারেশনের মতে এর সমাধান শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়; বরং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই কেবল এই সমস্যার প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
প্রথমেই স্থূলতার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। স্থূলতার আর্থসামাজিক ও মনঃসামাজিক বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে। সাধারণ অর্থে স্থূলতা অনেক রোগের কারণ এবং এসব রোগে থেকে মুক্তি পেতে আমাদের চিকিৎসা খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে; যা শুধু ব্যক্তি বা পারিবারিক পর্যায়েই নয়, রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ খাতে বাজেটে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ রাখতে হয়।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের সম্পদ। আগামী দিনের তরুণ যারা, তারা একসময় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেবে, বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। স্থূলতার কারণে বিশ্বে সামগ্রিক কর্মক্ষমতা ও দক্ষতা কমে যাবে; যার ফলে সারা বিশ্বেই শ্রমিকের ঘাটতি সৃষ্টি হবে।
যদিও তথ্যপ্রযুক্তিবিদেরা বলতে পারেন যে রোবোটিকস প্রযুক্তি এই ঘাটতি অনেকাংশেই কমিয়ে দেবে। শ্রমনির্ভর কাজ বা নিরন্তর পরিশ্রম করার ক্ষমতা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সত্যিকার অর্থেই ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। একজন সুঠাম দেহী শ্রমিক রাত–দিন পরিশ্রম করে কোনো একটি বিশেষ কাজ নির্দিষ্ট সময়ে নিষ্পত্তি করতে পারেন, যা মেদবহুল বা স্থূলকায় ব্যক্তির পক্ষে নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত করা সম্ভব নয়।
তা ছাড়া স্থূলকায় ব্যক্তিদের পারিশ্রমিক ও বেতন অন্যদের চেয়েও কম হয়ে থাকে। এসব কারণে তাঁরা পারিশ্রমিক ও চাকরিপ্রাপ্তির সুযোগের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হতে পারে। এর ফলে সারা বিশ্বে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেকার সমস্যার বৃদ্ধি পাবে এবং দারিদ্র্য ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই বেকারত্বের কারণে অর্থনৈতিক সমস্যায় পতিত হবে।
সুতরাং বলাই যায়, স্থূলতার কারণে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা, শারীরিক অক্ষমতা, গড় আয়ু হ্রাস পাচ্ছে এবং পাশাপাশি প্রতিবন্ধিতা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক হারে খরচ বাড়ছে; যা দরিদ্র দেশের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে জাতীয় নিরাপত্তাসহ সামরিক খাতেও ওবেসিটির প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
অপর দিকে স্থূলকায় ব্যক্তিদের দৈনন্দিন খাবারের পেছনে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি ব্যয় করতে হয়। তাদের প্রত্যক্ষ চিকিৎসা ব্যয় অন্যদের চেয়ে চার গুণের বেশি। তা ছাড়া স্থূলকায় ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ চিকিৎসা ব্যয়ের চেয়ে পরোক্ষ চিকিৎসা ব্যয় অধিক। অন্যদিকে স্থূলকায় ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যবিমার কিস্তিও সুস্থ ব্যক্তিদের চেয়েও অনেক গুণ বেশি। তা ছাড়া স্থূলকায় ব্যক্তিদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরে বা বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং একই সঙ্গে বিষয়টি ব্যয়বহুলও বটে।
এদিকে মনস্তাত্ত্বিকভাবেও স্থূলকায় ব্যক্তিরা অসহায় বোধ করে, যা তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থূলকায় শিক্ষার্থীরা চরম হীনম্মন্যতায় ভোগে এবং সহজে বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে পারে না, অনেক সময় তারা বুলিংয়ের শিকারও হয়ে থাকে।
বন্ধুহীন হয়ে তারা চরম মানসিক অশান্তিতে পড়ে একমুখী হয়ে যায়। স্থূলকায় তরুণ-তরুণীদের নানা কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। কায়িক পরিশ্রম ও খেলাধুলা করতে না পারায় তাদের বন্ধুর সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে। হীনম্মন্যতায় পতিত হয়ে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
বিবাহ বা চাকরি বা সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা পরিবার ও সমাজের বোঝায় পরিণত হয়। এমতাবস্থায় অনেকেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
একসময় মারাত্মক হতাশায় আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে সে সব রকম যোগাযোগ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একাকী জীবন যাপন করতে থাকে এবং অনেক সময় এই একাকিত্বের কারণে আস্তে আস্তে নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, প্যারানোইয়া, সাইকোসিস, নানা ধরনের ওসিডি, বাইপোলার ডিজঅর্ডারসহ নানান মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
করণীয় কী
বিশ্বব্যাংক ওবেসিটিস্যাকে ‘যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে এমন টাইমবোমা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে স্থূলতা ও ওজনাধিক্যকে মোকাবিলার জন্য ২০২০ সালে একটি গবেষণাপত্র বের করেছে। এবার কীভাবে আমরা এই স্থূলতা সমস্যা মোকাবিলা করব, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।
আগেই বলেছি, স্থূলতা ও ওজনাধিক্য মোকাবিলায় বহুপক্ষীয় সংস্থার সমন্বয়ের প্রয়োজন। অনেক দেশ ইতিমধ্যে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের দেশেও এই ওজনাধিক্য ও স্থূলতা দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। প্রথমেই আমাদের জীবনাচরণ ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে।
ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে আমাদের খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেট ও চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণ কমিয়ে দিয়ে সুষম খাদ্য গ্রহণে তৎপর হতে হবে। চিনি, সোডা ও মিষ্টিজাতীয় খাবার ও কোমল পানীয় গ্রহণ প্রায় বাদই দিয়ে দিতে হবে। উচ্চমাত্রায় প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য ও বেভারেজ কোনোভাবেই শিশুদের দেওয়া যাবে না।
তা ছাড়া চিনিযুক্ত ও উচ্চমাত্রার প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার, চকলেট, কোমল পানীয়, জাঙ্ক ফুড ক্রয়ে নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করতে উচ্চ হারে করারোপ করতে হবে এবং কেউ যেন এসব খাদ্যপণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে না পারে, সেরূপ আইন প্রণয়ন ও তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মেদাধিক্য ও ওজনাধিক্য বৃদ্ধি করে—এমন সব রকমের খাবারের আমদানি কমিয়ে আনতে বেশি আমদানি শুল্ক ধার্য করতে হবে।
তা ছাড়া পুষ্টিকর ও প্রোটিন–সমৃদ্ধ কৃষিপণ্য, যেমন নানা প্রকার ফলমূল, মটরশুঁটি, শাকসবজি, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, চিয়াসিড ইত্যাদি উৎপাদনের ক্ষেত্রে গবেষণায় ভর্তুকি দিয়ে কৃষিবিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করতে হবে। একই সঙ্গে স্থূলতা বাড়ায়—এমন শস্য উৎপাদনে ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমাতে হবে।
এ ছাড়া স্কুল–কলেজ প্রাঙ্গণের কাছে সব ধরনের অতিপ্রক্রিয়াজাত বা জাঙ্ক ফুডের দোকান বন্ধ করে দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে বাইসাইকেল ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে। স্থূলতা প্রতিরোধে প্রতিটি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকমের খেলাধুলাসহ পিটি ও প্যারেড করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
প্রতিটি গ্রাম ও ওয়ার্ডে আধুনিক ব্যায়ামাগার, খেলার মাঠ, সাইকেল লেন, ওয়াকওয়ে, পার্ক স্থাপনসহ অত্যাধুনিক নগর-পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি খাবারের প্যাকেটে খাদ্যের উপকরণের নাম, পরিমাণ উল্লেখসহ লেবেল নিশ্চিত করতে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘ল্যানসেট কমিশন অন ওবেসিটি’ ২০১৯ সালে ভবিষ্যতে স্থূলতা ও ওজনাধিক্য কমাতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ব সংস্থাগুলোর আর্থিক, নিয়ন্ত্রণমূলক ও বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে।
‘টাইমবোমা’ বা ‘নীরব ঘাতক’ হিসেবে খ্যাত ওবেসিটি, ওজনাধিক্য, মেদবহুলতা, মেদাধিক্যের মতো জটিল রোগটি মহামারি আকার ধারণ করার আগেই এবং অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিতকল্পে উন্নত দেশের মতো আমাদের অতিসত্বর মন্ত্রণালয়ভিত্তিক একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
শেখ হাফিজুর রহমান উপসচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়