নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষার্থীদের রাজপথে নেমে আসার বার্ষিকীতে আমরা বিস্মিত ও ব্যথিত। বিস্ময়ের কারণ, ওই আন্দোলনে সড়কব্যবস্থাকে নিরাপদ রাখতে যত প্রতিশ্রুতি সরকার, গাড়িচালক, গাড়ির মালিক ও নাগরিকদের তরফে দেওয়া হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন না হওয়া। ২০১৮ সালের সড়ক আইনের আওতায় অগ্রাধিকার দিয়ে জরুরি পদক্ষেপগুলো নেয়নি সরকার। চালকেরা আগের মতোই বেপরোয়া যানবাহন চালাচ্ছেন। মালিক সমিতিগুলো যান চলাচল এবং তাদের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। সড়কে নিয়োজিত পুলিশের আচরণেও তেমন পরিবর্তন চোখে পড়ে না। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনা ক্রমবর্ধমান হলেও পথচারী ও যাত্রীসাধারণের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি আগের মতোই রয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে যে পথচারীরা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও যেখানে পদচারী-সেতু রয়েছে, সেই এলাকায়ও তারা সেতু এড়িয়ে যথেষ্ট অসতর্কতায় সড়ক পারাপারে ব্যাকুল থেকে গেছে। যার যা কাজ, তা তারা পালন না করার কারণে এক বছর আগের বাংলাদেশের সড়কব্যবস্থাকে আলাদাভাবে চিত্রিত করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
তবে সড়ক ব্যবস্থাপনায় যে ব্যর্থতা চলছে, তার দায় প্রধানত সরকারকে নিতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিতে হবে। গত এক বছরের ব্যর্থতা শুধুই প্রশাসনিকভাবে দেখা নয়, একে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি হিসেবেই দেখতে হবে। কারণ, পরিবহন খাতের সার্বিক বিশৃঙ্খলার জন্য একজন বিতর্কিত ‘পরিবহন মোগলকে’ নাগরিক সমাজ চিহ্নিত করেছে, তঁার প্রভাব বহুলাংশে অপরিবর্তিত থেকে গেছে। বিমানবন্দর সড়কে দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর তাঁরই হাসিমুখ বিক্ষোভ ছড়িয়ে দিয়েছিল। অথচ গত জানুয়ারিতে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার পর আমরা তাঁকেই সড়কের ‘নতুন অবতার’ হিসেবে আবির্ভূত হতে দেখেছি। কিন্তু সচেতন নাগরিক সমাজের আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়নি। ‘সড়কের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা’ বজায় রাখতে তঁারই নেতৃত্বে গত ফেব্রুয়ারিতে ১৫ সদস্যের কমিটি হয়। ফলে এই কমিটি সড়ক নিরাপদ করতে কোনো পদক্ষেপ নেবে, জনগণ তা বিশ্বাস করে না।
নীতিনির্ধারকদের মনে রাখা দরকার, শুধু অবকাঠামো খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলেই যে নিরাপদ সড়ক করা যাবে না, এর জ্বলন্ত প্রমাণ নিয়ন আলোয় ঝলমলে এবং সব থেকে বেশি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বিমানবন্দর সড়কের বেহাল ব্যবস্থাপনা। ঢাকায় সড়ক ও পরিবহন খাতে গত এক দশকে ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সমীক্ষা বলছে, ঢাকাতেই সব থেকে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে ঢাকায় সড়কে নিহত ২৭৬ জনের মধ্যে শুধু বিমানবন্দরে মারা গেছে ৪৬ জন। আবার গত এক বছরে ঢাকায় নিহত ২৯৭ জনের মধ্যে প্রায় ৩৮ শতাংশই পথচারী। চার বছরের হিসাবে প্রায় প্রতি সপ্তাহে গড়ে একজন নিহত হয় বিমানবন্দরে। এটাও চিহ্নিত যে ২৩টি স্থানেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই মৃত্যুর মিছিল থামাতে টেকসই কোনো পদক্ষেপ নেননি।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের বার্ষিকীতে আমরা মামলাগুলো প্রত্যাহার ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ছাত্র হয়রানি বন্ধ করার ওপরই গুরুত্ব দিতে চাই। ঢাকা মহানগরে ৬০ মামলায় তখন ৯৯ জনকে আটক করা হয়েছিল; যাঁদের মধ্যে ৫২ শিক্ষার্থীকে এখনো আদালতে দৌড়াতে হচ্ছে। অথচ তাঁদের ওপর আক্রমণকারী হেলমেটধারীদের গায়ে আঁচড়টুকু লাগেনি। আমরা স্মরণ করতে চাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও নীতিগত কারণে অভূতপূর্ব ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে কার্যত সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় গুরুতর মামলা প্রত্যাহারের বৃত্তান্ত জনগণের কাছে সুবিদিত। ছাত্রদের মামলাগুলো তুলে নিয়ে সরকারের উচিত হবে ক্ষমা ও উদারতার উদাহরণ তৈরি করা।