দেশের ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচনসংক্রান্ত গুরুতর অসদাচরণ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ও অপর চার কমিশনারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার যে অনুরোধ জানিয়েছেন, রাজনৈতিক মহলে তা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হইতে পারেন, সেইরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত অন্য কোনো কারণে নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হইবেন না।’ গুরুতর অসদাচরণের কারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের বিধান আছে। ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক সেই আইনি প্রতিকার চেয়েছেন। আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া কিংবা রাস্তায় নেমে বিশৃঙ্খলা করার কথা বলেননি।
বিশিষ্ট নাগরিকদের এই নিরীহ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে, তা ভিন্নমতকে দমন করার চেষ্টা বললে অত্যুক্তি হবে না। ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা, যাঁরা মন্ত্রিসভারও সদস্য, ৪২ নাগরিকের উদ্যোগকে দলীয় রং লাগানোর চেষ্টা করছেন। একজন মন্ত্রী বলেছেন, ‘এই চিঠির খসড়া বিএনপির অফিসে তৈরি হয়েছে।’ কিন্তু তাঁদের জানা থাকার কথা যে এই বিশিষ্ট নাগরিকদের অনেকেই বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালেও গণতন্ত্র, নির্বাচন, সুশাসন ইত্যাদি সম্পর্কে একই ধরনের কথা বলেছেন। এখন যাঁরা ক্ষমতাসীন, তখন তাঁরা বিরোধী দলে ছিলেন এবং অকুণ্ঠ চিত্তে বিশিষ্ট নাগরিকদের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।
প্রকৃত প্রশ্ন হলো বিশিষ্ট নাগরিকেরা নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছেন, তা যথার্থ কি না। এসব অভিযোগ সত্য না হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সহজেই দায়মুক্ত হবেন। আর যদি অভিযোগগুলোর সারবত্তা থাকে, তাহলে ধমক দিয়ে ভিন্নমত দমন বা উপেক্ষা করার কোনো যুক্তি নেই। কিছু মানুষকে কিছুদিনের জন্য বিভ্রান্ত করা গেলেও সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বিভ্রান্ত করা যায় না।
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের প্রধান দায়িত্ব জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা তথা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। কিন্তু কে এম নূরুল হুদা কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সেটি করতে যারপরনাই ব্যর্থ হয়েছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারাই দেশ শাসিত হওয়া অপরিহার্য (এই যুক্তি দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে)। কিন্তু সেই জনপ্রতিনিধি বাছাই মানে যেনতেন কিংবা প্রহসনমূলক নির্বাচন নয়। নির্বাচন এমন হতে হবে, যাতে প্রতিটি নাগরিক নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করেছে এ রকম প্রমাণ নেই; সেটি হোক ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন কিংবা এর আগে ও পরের স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন।
তাই ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ এনেছেন, তার সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে বিষয়টিকে অযথা কোনো রাজনৈতিক রং দেওয়ার চেষ্টা না করা। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই।