ঈদুল আজহার ছুটিতে এ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫৭ জন নিহত এবং শতাধিক লোক আহত হয়েছে। তবে ঈদযাত্রীদের ফেরা পর্ব এখনো শেষ হয়নি। বৃহস্পতিবার ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে পিকনিকের একটি বাস ‘নিয়ন্ত্রণ হারানোয়’ সাতজনের মৃত্যু হলো। সুতরাং সড়ক ব্যবস্থাপনার প্রতি শিথিল মনোভাব দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। এটা স্বাভাবিকভাবে বোধগম্য যে আগামী সপ্তাহজুড়ে রাজধানীসহ বড় বড় শহরমুখী যানবাহনগুলোতে ভিড় থাকবে।
অবশ্য পরিহাসমূলক শোনালেও এটা এখন অপ্রিয় বাস্তবতা যে সড়কগুলোতে যানবাহন বেশি থাকলে গতি মন্থর হতে বাধ্য। যত বেশি যানজট, তত বেশি মানুষের দুর্ভোগ, কিন্তু সময়ের চেয়ে যদি জীবনের মূল্য বেশি হয়, তাহলে এই ভূখণ্ডে ভোগান্তিকেই বেছে নিতে হবে। কেননা সময়ের চেয়ে জীবনের দাম সত্যিই বেশি।
সময় আর জীবন—একত্রে দুটি নয়। এর একটিকে বেছে নিতে হবে। দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিরাট ফিরিস্তি শোনানো হচ্ছে প্রতিদিন, কিন্তু সড়কে যাত্রীসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না কিছুতেই। সড়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এবারের ঈদুল আজহার ছুটিতে সড়কে প্রাণ খোয়ানো ব্যক্তির সংখ্যা গত ঈদুল ফিতরের চেয়ে কম, কিন্তু এর মূলে রয়েছে যানজট। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে। কোনো কোনো সড়কে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার যাত্রায় ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগেছে। এ জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশও করেছেন। সুতরাং সড়কে যেখানে কচ্ছপগতিতে যানবাহন চলেছে, সেখানে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা কম হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
ঈদের আগে সড়ক, রেল ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা দফায় দফায় বৈঠক করেছিলেন। এখন যদি তাঁরা স্বস্তি পেতে চান এই ভেবে যে তাঁদের দক্ষতা ও নজরদারি বাড়ানোর কারণেই লাশের সংখ্যা কমানো গেছে, তাহলে সেটা জনগণের চোখে ধুলা দেওয়া হবে। এর চেয়ে তাঁরা স্বীকার করুন যে তাঁদের প্রচেষ্টার ফলাফল আগের মতোই ন্যূনতম থেকেছে। দেশের গোটা পরিবহনব্যবস্থাকে সারা বছর আমরা বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলতে দেব, কোনো আইনকানুনের ধার ধারব না, সংস্কারের সুপারিশগুলো অকার্যকর থাকবে, আর নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন সড়ক আশা করব, সেটি আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র।
সরকার নিরাপদ সড়ক চাইলে ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের জরুরি বিধানগুলো অচল করে রাখতে পারত না এবং পরিবহনশ্রমিক ও মালিকদের অন্যায় আবদারের কাছে নতিস্বীকার করতে পারত না। আইন অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণের তহবিল গঠন করতে হবে এবং তা ভুক্তভোগীদের পরিবারগুলোর মধ্যে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিতরণ করার কাজ এখনই শুরু করা প্রয়োজন। ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে কেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে বারবার আদালতের কাছে ধরনা দিতে হবে?
আমরা লক্ষ করছি যে পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না, এমনকি সড়ক চলাচল নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী যেসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা–ও মানেন না। যাত্রীসাধারণ তাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। মানুষ বেশি ভাড়া গুনতেও রাজি আছে, কিন্তু তারা চায় যাত্রাটি যেন নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হয়। সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রভাবশালী মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর যে অশুভ আঁতাত আছে, তা ভেঙে দিতে না পারলে সড়কে অব্যবস্থা চলতেই থাকবে। আর উৎসব পর্বে আনন্দের যাত্রা বিষাদে পরিণত হবে।
মন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে সরকারের দায়িত্ব শেষ করার কোনো সুযোগ নেই। সড়কে যান চলাচল ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমিয়ে আনার কার্যকর পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে। যে কর্তৃপক্ষের যা দায়িত্ব তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে, অন্যথায় জবাবদিহির মুখে দাঁড় করাতে হবে।