বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির উচ্চ হার একটি গুরুতর জাতীয় সমস্যা। সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে জনমত প্রবল। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নামের একটি আন্দোলন চলছে অনেক বছর ধরে। গত বছর জুলাইয়ের শেষে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে এক বেপরোয়া বাসের চাপায় কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের যে প্রবল ও ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা গেছে, তাতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সমাজের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।
সেই আন্দোলনের চাপে সেপ্টেম্বর মাসে ‘সড়ক পরিবহন আইন’ সংশোধন করে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির মাত্রা বাড়ানোসহ নতুন কিছু ধারা যুক্ত করা হয়েছিল। এ ছাড়া সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও নিরাপত্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে নানা রকমের আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির প্রাত্যহিক চিত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সড়কে মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিনই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
কেন? কারণ অনেক, তবে সবকিছুর আগে বলতে হয় সড়ক পরিবহন আইনের কথা, যেটি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সংশোধিত আকারে গৃহীত হয়েছে। তারপর পুরো এক বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু আইনটি কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হলো যে আইন কার্যকর করা হবে না, তা গ্রহণ করার কী প্রয়োজন বা উদ্দেশ্য ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর কি এই যে সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে স্কুল–কলেজের বিক্ষোভ–আন্দোলনটি প্রশমন করার কৌশলের অংশ হিসেবে আইন সংশোধন করে শাস্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিধান করা হয়েছিল?
অবশ্য এমন কথাও জানা গেছে যে আইনটি কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিকদের চাপে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ–আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল তাদের দাবির যৌক্তিকতা। সড়ক নিরাপদ করতে হবে—এ দাবির সঙ্গে পুরো জাতি তর্কাতীতভাবে একমত। এই যুক্তিসংগত দাবিতে শিক্ষার্থীরা প্রবল বিক্ষোভ–আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল এই কারণে যে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাত্যহিক প্রাণহানির মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো আমলেই নিচ্ছে না। শুধু তা–ই নয়, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির বিষয়টি সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বের তরফে যে সংবেদনশীলতা দাবি করে, কখনো কখনো তার উল্টো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। এক বেপরোয়া বাসচালকের উন্মাদনায় ফুটপাতে অপেক্ষমাণ দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় যখন সবাই শোকার্ত, সেই মুহূর্তে তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের হাসি ছিল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠার ইন্ধন।
আর যখন জানা যাচ্ছে, পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিকদের অন্যায় চাপের কারণে সংশোধিত পরিবহন আইন কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এবং তাঁদের চাপেই আইনটি আবারও সংশোধিত হতে পারে বলে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে জানা যাচ্ছে, তখন অনেকেরই শাজাহান খানের সেই হাসির কথা মনে পড়ে যেতে পারে এবং মনে হতে পারে যে সড়কে মৃত্যুর বিষয়টির প্রতি সরকারি নীতিনির্ধারক মহলে সংবেদনশীলতা ও উপলব্ধির বিরাট ঘাটতি রয়ে গেছে। সরকারের প্রতি আমাদের জিজ্ঞাসা, পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিকদের যে স্বার্থ, তা কি পুরো জাতির স্বার্থের চেয়ে বড়? কেন একটি গোষ্ঠীর স্বার্থকে জাতির স্বার্থের ওপরে স্থান দেওয়া হচ্ছে?
এতকাল যে আইন বলবৎ ছিল, তার যথাযথ প্রয়োগ ও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও মালিক–শ্রমিকদের অন্যায্য চাপ ক্রিয়াশীল ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই চাপ আরও বাড়ছে এবং সরকার সেই চাপে জনস্বার্থের বিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা সরকারি নীতিনির্ধারকদের এ অবস্থান থেকে সরে আসার আহ্বান জানাই। পরিবহন আইন আবার সংশোধন করে শাস্তি কমানোর দুরভিসন্ধি গ্রহণযোগ্য নয়।