মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়িতে পদ্মায় স্পিডবোট ডুবে ২৬ জন মানুষ মারা যাওয়ার পর জানা গেল, লাইসেন্স ছাড়াই চলছিল এই স্পিডবোট। শুধু তা-ই নয়, বোটের চালকেরও লাইসেন্স নেই। এই ঘাটে কয়েক শ স্পিডবোট আছে, যেগুলোর বেশির ভাগের চালকের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ১৪-১৫ বছর বয়সী কিশোরকে দিয়েও স্পিডবোট চালানো হচ্ছে। কেবল কাঁঠালবাড়ি নয়, সব ঘাটেই স্পিডবোটগুলো চলছে লাইসেন্স ছাড়া। কয়েক দিন আগে শীতলক্ষ্যায় বালুভর্তি একটি বাল্কহেডের ধাক্কায় লঞ্চ ডুবে ৪৩ জন যাত্রী মারা যান। একজন সাংসদের মালিকানাধীন ওই বাল্কহেডও চলছিল লাইসেন্স ছাড়া।
লাইসেন্স দেওয়ার মালিক বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), আর লাইসেন্স নিয়েই মালিকদের বোট বা বাল্কহেড নামানোর কথা। যাঁরা স্পিডবোট চালাচ্ছেন, তাঁদেরও লাইসেন্স নিতে হবে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। পরীক্ষা না দিয়ে লাইসেন্স পাওয়ারও সুযোগ নেই। এর অর্থ ঘাটের ইজারাদার, স্পিডবোটের মালিক ও চালকদের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর গোপন আঁতাত আছে। এই আঁতাতের ভিত্তিতেই এসব অবৈধ বাহন অবাধে চলাচল করে। নৌপরিবহনের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে কোস্টগার্ড। তারাও নিজেদের ছাড়া কাউকে গার্ড দেয় বলে মনে হয় না।
সড়কপথের মতো নৌপথেও চলছে চরম নৈরাজ্য। কোথাও নিয়মনীতির বালাই নেই। একেকটি দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। এরপর আবার যে লাউ, সেই কদু। সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে, ঘটতে থাকে একের পর এক দুর্ঘটনা। বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা নিজেদের পকেট ভারী করতে যতটা উদ্গ্রীব, নৌযাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে ততটাই নিরুৎসাহী। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, শীতলক্ষ্যার দুর্ঘটনার পর বিআইডব্লিউটিএসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তৎপর হবেন। কিন্তু হুঁশ যে ফেরেনি, কাঁঠালবাড়িতে ২৬ জনের মৃত্যুই তার প্রমাণ। এসব মৃত্যুর জবাব কী? দুর্ঘটনায় মা-বাবা ও দুই বোন হারানো শিশু মীমকে কী সান্ত্বনা তাঁরা দেবেন?
মানলাম স্পিডবোটের মালিকেরা বেশি লাভ করার জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক নিয়োগ করেন। সরকারকে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য লাইসেন্স নেন না। কিন্তু এসব বেআইনি কাজের কি কোনো আইনি প্রতিকার নেই? বিআইডব্লিউটিএ কেন লাইসেন্স ছাড়া নৌপথে স্পিডবোট চালাতে দেবে? কেন সাংসদের লাইসেন্সবিহীন বাল্কহেড চলবে? সড়কের নিরাপত্তার জন্য যেমন হাইওয়ে পুলিশ আছে, তেমনি নৌপথের নিরাপত্তার দায়িত্ব কোস্টগার্ডের। তারা কী করছে?
বস্তুত দেখা যাচ্ছে, নৌপথের যান চলাচলে আইনভঙ্গের প্রবণতাই বেশি। এ প্রবণতা দৃশ্যমান হচ্ছে শুধু তখনই, যখন কোনো জলযান
দুর্ঘটনায় একসঙ্গে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটছে এবং সেই ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। দুর্ঘটনা না ঘটলে জানাই যেত না যে বেআইনিভাবে এসব চলছে। আইনের শাসন জারি আছে, এমন কোনো দেশে এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
বরাবরের মতো এবারও বিআইডব্লিউটিএ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু সেই কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে, সুপারিশ বাস্তবায়িত হবে, সেই নিশ্চয়তা নেই। কাঁঠালবাড়ি ঘাটে স্পিডবোট দুর্ঘটনার জন্য যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী, তাঁদের সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। জলপথে যানবাহন চলাচলে সব ধরনের বেআইনি চর্চা অবিলম্বে বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। আইন-বিধান প্রয়োগে গাফিলতি বা ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলেই কেবল নৌপথে কিছুটা হলেও নিয়মনীতি ফিরে আসবে। নৌযাত্রীদেরও জীবন হাতের মুঠোয় করে চলতে হবে না।