ভয়ংকর মাদকদ্রব্য ইয়াবা কারখানা না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জল, স্থল ও অন্তরিক্ষে যে মাদকের রমরমা কারবার চলছে, তা দেখতে কোনো অণুবীক্ষণযন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এত দিন জানিয়েছিল, মিয়ানমার থেকে এ ভয়ংকর মাদকদ্রব্য বা ইয়াবা পাচার হয়ে আসে। সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর কথিত সাঁড়াশি অভিযান সত্ত্বেও মাদক আসা, বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না।
এসব উদ্বেগজনক খবরের মধ্যে যে তথ্যটি আমাদের উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দেয়, তা হলো বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় ভূখণ্ডে বিভিন্ন ইয়াবা কারখানা স্থাপন। গত ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিনটি ইয়াবা কারখানার তথ্য দেওয়া হয়; যার দুটি পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও একটি উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত। এ ছাড়া মেঘালয়ে একাধিক ইয়াবা কারখানা আছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার কাঁচামাল ‘এমফিটামিন’ এনে এসব কারখানায় ইয়াবা তৈরি হয়।
বৈঠকে উপস্থাপিত নথি অনুযায়ী, কোচবিহারের একটি কারখানা বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে মাত্র ৫০ মিটার দূরে। আরেকটি কারখানা একই সীমান্তের ৪০০ মিটারের মধ্যে। তৃতীয় কারখানাটি সাতক্ষীরা সীমান্তের ওপারে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনায়। কারখানাটি সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোকে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব তথ্য জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
একসময় বাংলাদেশে ফেনসিডিলের জমজমাট ব্যবসা ছিল; যার সবটাই আসত ভারত থেকে। ভারতের একশ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অসংখ্য কারখানা স্থাপন করেছিলেন; যাতে সহজে বাংলাদেশে ফেনসিডিল পাচার করা যায়। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বহু বৈঠক হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারত সরকার অনেক কারখানা বন্ধ করে দেয়; যদিও পুরোপুরি ফেনসিডিল আসা বন্ধ হয়েছে বলা যাবে না। এর আগে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালানোর পাশাপাশি শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সরকারের সেই অভিযান যে অনেকটা অকার্যকর ছিল, সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যার ঘটনাই তার প্রমাণ। কক্সবাজার অঞ্চলে মাদকবিরোধী অভিযানের নেতৃত্বদানকারী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই এসব অপকর্মে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
ইয়াবা ফেনসিডিলের চেয়ে কয়েক শ গুণ বেশি ক্ষতিকর মাদক। কোনো মানুষ একবার এ মাদকের খপ্পরে পড়লে তা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। কেবল দুই দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মধ্যকার আলোচনায় সুফল মিলবে না। এসব ইয়াবা কারখানা বন্ধ করতে হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও মেঘালয় সরকারেরও সক্রিয় সহায়তা প্রয়োজন।
আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সরকার বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে আরও উচ্চপর্যায়ে বৈঠক করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। ভারত সরকার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দোহাই দিয়ে তিস্তার পানিবণ্টন বিলম্বিত করলেও ইয়াবা কারখানা বন্ধের বিষয়ে একই নীতি অনুসরণ করবে না। তাদের মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় বা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে ইয়াবা কারখানা থাকলে কেবল বাংলাদেশেই ইয়াবা পাচার হয়ে আসবে না; দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারেও ছড়িয়ে পড়বে।
বহু বছর ধরে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার হয়ে এলেও সরকার মোকাবিলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এখন যদি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতেও ইয়াবার কারখানা থাকে, তার বিপদ যে কত ভয়ংকর, তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। অতএব, যা করার এখনই করতে হবে। সময়ক্ষেপণের সময় নেই।