সিলেটের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা কত নাজুক ও ঝুঁকিপূর্ণ, তা সর্বশেষ ট্রেন দুর্ঘটনায় আবার উন্মোচিত হয়েছে। রেল ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার দুর্দশা অত্যন্ত গভীর। শুধু কুলাউড়া ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে পুরো চিত্র পাওয়া যাবে না। রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম বলেছেন, দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ‘ব্রিজ ভেঙে নয়, দুর্বল লাইন ও নাটবল্টুর কারণে।’ আরও এক বিস্ময়কর মন্তব্য তিনি করেছেন: যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে ওঠার কারণেই দুর্ঘটনা, তাই রেল মন্ত্রণালয়ের দায় নেই। রেললাইন দুর্বল, নাটবল্টু ঢিলে—এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা আসলে ব্যাপক। কুলাউড়ার মতো দুর্ঘটনা আরও অনেক স্থানেই যেকোনো সময় ঘটতে পারে। মহাসড়কের অবস্থাও ভালো নয়।
এই মুহূর্তে দরকার সিলেটের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে একাধিক সমমানসম্পন্ন বিকল্প যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করা। রেল ও মহাসড়কের প্রতিটি ইঞ্চিকে ত্রুটিমুক্ত ও ঝুঁকিমুক্ত করা প্রয়োজন। অস্থায়ী ভিত্তিতে জোড়াতালি দিয়ে যা চলছে, তা মানুষের চলাচলে ও পণ্য পরিবহনে সার্বক্ষণিক ঝুঁকি তৈরি করে রেখেছে। শাহবাজপুরের সেতুসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেতু-কালভার্টের অবস্থা খারাপ। সিলেটবাসী ভ্রমণের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগতভাবে ট্রেনের ওপরই বেশি ভরসা করেন, কিন্তু সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তার গুরুত্বের ছাপ লক্ষ করা যায় না। কুলাউড়ায় কালভার্টে
নাটবল্টু আলগা থাকাও কোনো বিরাট ব্যতিক্রম নয়। এ রকম দুরবস্থা আরও বহু স্থানে আছে। শাহবাজপুরে সেতুতে ভাঙনও ছিল স্বাভাবিক পরিণতি। ট্রেনে যাত্রীর চাপ বাড়ার সঙ্গেও দুর্নীতি রোধ না করতে পারার ব্যর্থতা ছিল। শাহবাজপুরের সেতু সংস্কারে দরপত্র আহ্বান করার পরও কী করে বছরের পর বছর কেটে গেল, কারা অভিযুক্ত, তাদের শাস্তি দেওয়া ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থার নৈরাজ্য রোধ করা যাবে না।
বাংলাদেশের আঞ্চলিক উন্নয়নে, বিশেষ করে রেমিট্যান্স এবং বিদেশের সঙ্গে যত বড় বড় অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সম্ভাবনা, তার সিংহভাগের সঙ্গেই কমবেশি সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার একটা যোগসূত্র থাকে। সুতরাং জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সিলেট-ঢাকা, সিলেট-চট্টগ্রামের যাতায়াতব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও নিরাপদ করা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের সঙ্গে মোকাবিলা করার দাবি রাখে।
সত্য বটে, আমরা রেল খাতের বিরাট উন্নয়ন ও বিরাট কর্মসূচির পরিকল্পনা সময়ে সময়ে জেনে আসছি। যেমন দেশের বিদ্যমান ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথ সম্প্রসারণ করে ৪ হাজার ৭০০ কিলোমিটারে উন্নীত করার পরিকল্পনার অগ্রগতি কী, তা জানা যায় না। আমরা অবশ্যই সরকারের সুদূরপ্রসারী যোগাযোগ উন্নয়ন কৌশলকে স্বাগত জানাই।
কিন্তু সেই কারণে বিদ্যমান মহাসড়ক ও রেলপথের যে দুর্দশা ও নৈরাজ্যিক অবস্থা চলছে, তা থেকে আমরা মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারি না। এগুলোর চলমান ঝুঁকিপূর্ণ দুর্দশা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে দূর করতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
কুলাউড়া ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ অলৌকিক নয়, তার তদন্তে কোনো জটিলতা থাকারও কথা নয়। নাজুক অবস্থা বিদ্যমান ছিল এবং সংশ্লিষ্ট কারও কাছেই তা গোপন ছিল না। সুতরাং ঝুঁকি দূর করায় গাফিলতির জন্য জবাবদিহি চাওয়া উচিত। শাহবাজপুরের সেতু ভাঙনের পর যে বিকল্প সড়ক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি ভারী যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী; এটিরও বিভিন্ন স্থান খানাখন্দময় ও সংকীর্ণ হওয়ায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হচ্ছে। ৫ ঘণ্টার জায়গা পেরোতে ১৫ ঘণ্টার বেশি লাগছে।
সিলেটের সঙ্গে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ত্রুটিমুক্ত করতে সব রকম ব্যবস্থা নিতে হবে।