টাঙ্গাইল-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে দেখা করে নিজের প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘মাঠ নির্বাচন করার মতো সমতল নয়। মাঠ এমনই সমতল যে পুলিশের বুটের তলে পড়তে হয়। আর সন্ত্রাসীদের লাঠির আঘাত খেতে হয়। আমার অফিস ভেঙে দিয়েছে। আমার নিরীহ লোকদের প্রতিনিয়ত গ্রেপ্তার করছে। যারা সমর্থক, তাদের পুলিশ প্রতিনিয়ত টেলিফোন করে ভয় দেখাচ্ছে। এরপর ইলেকশন করা যায় নাকি?’
নির্বাচন প্রক্রিয়ার শেষ মুহূর্তে এ রকম প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নজির আগে থাকলেও সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পূর্বাপর পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার ঘটনা এই প্রথম। যখন একজন সাবেক মন্ত্রী ও ছয়বারের সাংসদ নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই বলে প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়ান, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সমস্যাটি কত গভীর। এর মাধ্যমে তিনি সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনাস্থাই প্রকাশ করেছেন। এটি একটি বা দুটি আসনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলে নাহয় ভাবা যেত পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের বেশির ভাগ আসনের বাস্তবতাই লতিফ সিদ্দিকীর কথায় উঠে এসেছে।
বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা দ্বিমুখী হামলার শিকার হচ্ছেন। একদিকে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা তাঁদের মাঠে নামতে দিচ্ছেন না, অন্যদিকে পুলিশ গায়েবি মামলা দিয়ে তাঁদের জেলে পুরছে। গায়েবি মামলার ঘটনা যে কী ভয়াবহ মাত্রায় ঘটেছে, তার কিছুটা প্রমাণ প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ‘এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে নাশকতার মামলার সংখ্যা তুলে ধরা হয়েছে। আর এই গায়েবি মামলা শুধু ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও গায়েবি মামলা এবং সেই মামলার সূত্রে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, হানাহানির খবর ও ছবি প্রকাশ পেলেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) রয়েছে নির্বিকার। তারা মুখস্থ বলে যাচ্ছে সবকিছু ঠিক আছে। নির্বাচন নাকি উৎসবমুখর পরিবেশেই হবে।
চূড়ান্ত বিচারে নির্বাচন পরিচালনা করার দায়িত্ব ও এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনেরই। সেই দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে তারা যে আন্তরিক ও সক্ষম, তার ন্যূনতম প্রমাণ এখনো দিতে পারেনি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। ফলে নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, জনমনে সংশয়-সন্দেহ বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন কালা, বধির ও অন্ধের ভূমিকা পালন করছে, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না।
অধিকাংশ নির্বাচনী আসনে দেখা যাচ্ছে সরকারদলীয় প্রার্থী ও সমর্থকেরাই শুধু প্রচারকাজ চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা মাঠে নামতেই পারছেন না। তাঁদের পোস্টার, ব্যানারও ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব কারা ঘটাচ্ছে, তা তদন্তের দাবি রাখে।
তফসিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনার দায় নির্বাচন কমিশন এড়িয়ে গেছে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন-প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার অজুহাতে। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর সেই সুযোগ আর নেই।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন যদি একটি মোটামুটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চায়, তাহলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু মুখে বললেই হবে না, কাজেও তাদের প্রমাণ করতে হবে যে নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু আছে। সব প্রার্থী ও সমর্থক প্রচার চালাতে পারছেন।