চলতি মাসের শুরুতে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নমুখী’ শীর্ষক প্রতিবেদন রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেকোনো ব্যক্তিকে বিচলিত করবে। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, একমাত্র প্রবাসী আয় বাদে দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই এখন নিম্নমুখী। দেখা যাচ্ছে, রপ্তানি আয়ে কোনো প্রবৃদ্ধিই নেই, আমদানিতেও একই অবস্থা। রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি। দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে নতুন আইন করার পরও ভ্যাট আদায় মোটেই বাড়েনি। আয় কম থাকায় সরকারের ঋণ করার প্রবণতা বাড়ছে। বেসরকারি বিনিয়োগও স্থবির।
অর্থনৈতিক সূচকের বাইরে দুর্নীতি, সুশাসনসহ অন্যান্য পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। কিন্তু এত দুঃসংবাদের মধ্যে একটি সুসংবাদ দিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)। তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, গত ১৪ বছরে বৈশ্বিক লিঙ্গসমতার সূচকে ৪১ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে ১৫৩টি দেশের মধ্যে লিঙ্গসমতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। এ ছাড়া গত কয়েক বছরের মতো এবারও এদিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে ১৫৩টি দেশের লিঙ্গসমতা পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যাচ্ছে, গত ৫০ বছরে সবচেয়ে বেশি নারী রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের শাসনাধীনে থাকা শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ রয়েছে তিনটি। এর মধ্যে বাংলাদেশ এ তালিকায় বৈশ্বিক এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দুই দিক থেকেই শীর্ষ স্থানে রয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে পুরুষ সরকারপ্রধানের চেয়ে নারী সরকারপ্রধানের শাসনাধীনে বেশি সময় ধরে রয়েছে। বাংলাদেশে পুরুষ রাষ্ট্রপ্রধানেরা শাসন করেছেন ২৪ দশমিক ৪ বছর। অন্যদিকে নারী রাষ্ট্রপ্রধানেরা শাসন করেছেন ২৫ দশমিক ৬ বছর।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লিঙ্গসমতা সূচকের শীর্ষ ১০০ দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশের একমাত্র বাংলাদেশই নিজের অবস্থান করে নিতে পেরেছে। বাংলাদেশের সামগ্রিক স্কোর শূন্য দশমিক ৭২৬। ২০০৬ সালে শূন্য দশমিক ৬২৭ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের র্যাংক ছিল ৯১।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের সূচক তৈরিতে যে চারটি স্তম্ভ বিবেচনায় নিয়েছে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই স্তম্ভগুলো হলো অর্থনৈতিক বিষয়ে নারীর অংশগ্রহণ ও অংশ নেওয়ার সুযোগ, শিক্ষাদীক্ষায় তাদের অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুযোগ ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। যেকোনো মানুষ যদি এই চার ক্ষেত্রে এগিয়ে যায়, তাহলে তাকে দাবিয়ে রাখা অসম্ভব। খুব আশার কথা, এই চার বিষয়েই দেশের নারীরা অনেকখানি এগিয়েছে। মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ আগের চেয়ে অনেক বেশি তৈরি হয়েছে।
তবে এই অগ্রগতিতে অতি আত্মতুষ্টির প্রবণতা যাতে সরকারকে আচ্ছন্ন না করে, সেদিকে সরকারেরই খেয়াল রাখা দরকার। আগের মতো ততটা প্রকটভাবে না হলেও এখনো সমাজের একটি বড় অংশ মেয়েদের নিষ্ক্রিয়, ভিতু, কম সক্ষম কিংবা অক্ষম এবং পরিবারের ওপর নির্ভরশীল ভেবে থাকে। পক্ষান্তরে ছেলেদের উপার্জনক্ষম, সাহসী, সক্ষম, সব কাজে পারদর্শী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রচলিত ধারণার পাথর ভাঙতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বহু পদক্ষেপ অবদান রেখেছে। পদক্ষেপগুলো শুধু জারি রাখা নয়, আরও বেগবান করা এখন সময়ের দাবি।