অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর কর্মময় জীবনের আকস্মিক অবসানে আমরা মর্মাহত। িতনি ছিলেন সদা হাস্য, প্রাণোচ্ছল, সজ্জন। তাঁর জীবন ছিল বহুমুখী কর্মচাঞ্চল্যে উজ্জ্বল। নশ্বর মানবজীবনের অর্থময়তার দৃষ্টান্ত ছিল তাঁর কর্মমুখরতা। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি; তাঁর শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা জানাই।
১৯৪২ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণকারী জামিলুর রেজা চৌধুরীর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ হয় ময়মনসিংহ ও ঢাকা শহরে। তারপরের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিল প্রকৌশলবিদ্যায়: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পুরকৌশল বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং সেই বছরই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। প্রকৌশলবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্তরাজ্যের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জনকারী তিনিই প্রথম বাংলাদেশি।
ডক্টর জামিলুর রেজা চৌধুরীর কৃতী একাডেমিক বিদ্যার্জনে কৃতিত্ব ও শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ব্যক্তিগত ভাগ্যোন্নয়ন, পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্মান বৃদ্ধির লক্ষ্য পেরিয়ে; ভালো ছাত্রদের তথাকথিত ক্যারিয়ার গড়ার প্রথাগত প্রবণতা অতিক্রম করে তিনি নিজেকে যুক্ত করেছিলেন দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা কর্মে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে তাঁর কাজ শেষ হয়নি, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার কাজেও নিজেকে যুক্ত করেছেন। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বুয়েটের চাকরি ছেড়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে অবদান রেখেছেন। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক নামের আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বস্তুত, এ দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের উদ্যোগগুলোর সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিশেষজ্ঞ ডক্টর জামিলুর রেজা চৌধুরী স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের অনেক বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু, নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা রকমের বিতর্ক দেখা দিয়েছে; সেসব ক্ষেত্রে তিনি সব সময়ই কথা বলেছেন এবং সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে। ছিলেন স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বের অধিকারী, ফলে বিতর্কিত কোনো বিষয়ে নিজের মত ব্যক্ত করা এবং সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো মহলের সম্ভাব্য বিরূপতার কথা ভেবে পিছপা হননি। প্রসারিত দৃষ্টির অধিকারী জামিলুর রেজা চৌধুরীর স্বদেশ নিয়ে স্বপ্ন ছিল; ফলে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার কাজেও অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি অঙ্গনের মানুষটি শুধু পুরকৌশলের মধ্যেই নিজের আগ্রহ ও কাজ সীমাবদ্ধ রাখেননি, এ দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের কাজেও অবদান রেখেছেন। তা ছাড়া তিনি নানা ধরনের সামাজিক ও নাগরিক উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড চালু হয়েছে তাঁরই সভাপতিত্বে। প্রকৌশলীদের সংগঠনসহ অজস্র সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন।
নিরন্তর কাজ করে যাওয়াই যদি হয় ব্যক্তিজীবনের সার্থকতা, তাহলে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এক সার্থক জীবন যাপন করে গেছেন। আমাদের নবীন প্রজন্ম তাঁর উত্তরাধিকার বহন করে কর্মচাঞ্চল্যে ভরিয়ে তুলুক জাতীয় জীবন।