রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় যে বড় দুর্নীতি হয়েছে, তা গণপূর্ত অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনেই প্রমাণিত। গত মে মাসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ভবনের কেনাকাটায় ‘বালিশ কেলেঙ্কারির’ বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আচরণ দেখে মনে হয় না, তাঁরা দুর্নীতির বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।
রূপপুর প্রকল্পের ভবনে প্রতিটি বালিশ কিনতে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা খরচ এবং প্রতিটি বালিশ আবাসিক ভবনের খাটে তোলার জন্য ৭৬০ টাকা মজুরি দেখানো হয়েছে, যা অবিশ্বাস্য। অন্যদিকে কভারসহ প্রতিটি কমফোর্টের (লেপ বা কম্বলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত) দাম ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা; যদিও এটা বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এভাবে ফ্রিজ, ইলেকট্রিক কেটলি, ওয়াশিং মেশিন, ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন আসবাব ও পণ্য ক্রয়ে অস্বাভাবিক মূল্য দেখানো হয়েছে।
গত সোমবার রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার দপ্তরে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটার প্রতিটি পর্যায়ে দুর্নীতি হয়েছে। আইন অনুযায়ী ৩০ কোটি টাকার কেনাকাটা হলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এ কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটা ছয় ভাগ করেছেন, যাতে প্রতিটি ৩০ কোটি টাকার কম দেখানো হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পাবনা ও রাজশাহীর পূর্ত বিভাগের ৩৪ জন প্রকৌশলী এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের মধ্যে একজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে, একজন অবসরে গেছেন এবং দুই কর্মকর্তা অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল)। কিন্তু বাকি ৩০ কর্মকর্তা স্বপদে বহাল আছেন। গণপূর্ত অধিদপ্তর বলেছে, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে করণীয় ঠিক করা হবে। যেখানে অপরাধীরা হাতেনাতে ধরা পড়েছেন, সেখানে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে কেন?
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক ভবনের কেনাকাটার বিল পরিশোধ নিয়েও একধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। ১৯ মে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, গত অক্টোবরে ২৯ কোটি ১৫ লাখ টাকার একটি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি পাঁচটি বিল পরিশোধ না করার জন্য মন্ত্রণালয় গণপূর্ত অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে। অথচ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটার মধ্যে চারটি ভবনের ১১৩ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গুরুত্ব অনুসারে বিভাগীয় ব্যবস্থা এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি যেসব ভবনে এখনো কেনাকাটা হয়নি, সেসব ভবনের কেনাকাটা প্রকৃত সরবরাহকারীদের কাছ থেকে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা বেশি নিয়েছে, তা–ও সরকারি কোষাগারে ফেরত আনার কথাও বলেছে তদন্ত কমিটি। এখানে দুর্নীতি হয়েছে গণপূর্ত দপ্তরের প্রকৌশলী ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগসাজশে। কেনাকাটার নামে যাঁরা সরকারি কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে অসাধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য করতে হবে।
মেগা প্রকল্প মানেই মেগা দুর্নীতি বলে একটি কথা চালু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি ডিসিদের সম্মেলনে দুর্নীতিকে উন্নয়নের প্রধান বাধা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কেনাকাটার দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও কীভাবে অভিযুক্তরা স্বপদে বহাল থাকেন, কেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, এ প্রশ্নের উত্তর গণপূর্ত অধিদপ্তরকেই দিতে হবে।