বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার রায়ে ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার মাধ্যমে বিচারের প্রাথমিক পর্ব শেষ হয়েছে। গত বুধবার বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামি হলেন নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা, রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী, আল কাইউম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম ওরফে সিফাত, রেজওয়ান আলী খান ওরফে টিকটক হৃদয় ও মো. হাসান। অপর চার আসামি খালাস পেয়েছেন।
কিন্তু এই মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড বিচারের আগেই পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় বন্দুকযুদ্ধে আসামির নিহত হওয়ার পেছনে যে প্রকৃত সত্য আড়াল করার চেষ্টা থাকে, সেটি কারও অজানা নয়। প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের কাহিনি প্রায় অভিন্ন। পুলিশ আসামিকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার কিংবা আসামির সহযোগীদের ধরতে গেলে সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। এরপর পুলিশ ‘আত্মরক্ষার্থে’ পাল্টা গুলি চালালে আসামি নিহত হন।
২০১৯ সালের ২৬ জুন রিফাত শরীফকে কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। ২৭ জুন রিফাতের বাবা ১০ জনকে আসামি করে মামলা করেন এবং রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাকে সাক্ষী করা হয়েছিল। পরে আসামিদের জবানবন্দিতে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আয়শার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁকেও আসামি করা হয়। রিফাত হত্যার পেছনে পারিবারিক বিরোধের পাশাপাশি মাদক ব্যবসার যোগসূত্র ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। মামলার রায়ে বাদীপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যতম আসামি আয়শার বাবা রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
এক বছর তিন মাসের মধ্যে চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যা মামলার রায় নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। এর আগে ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলার রায়ও দ্রুততম সময়ে হয়েছে। আবার অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার বিচার বছরের পর বছর ঝুলে থাকতেও দেখা গেছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, কুমিল্লার কলেজশিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু হত্যার তদন্তকাজই শেষ হয়নি। অপরাধের বিচার না হলে অপরাধীরা আশকারা পেয়ে যায় এবং নতুন করে অপরাধমূলক কাজে নেমে পড়ে।
রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ডের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নয়ন বন্ড ছিলেন বরগুনার মাদক সাম্রাজ্যের অন্যতম হোতা। প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ ছিল। গ্রেপ্তার হওয়ার পর বন্দুকযুদ্ধে তাঁর নিহত হওয়ার ঘটনা মহলবিশেষকে রক্ষা করার প্রয়াস ছিল কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা উচিত।
রিফাত হত্যা মামলার বিচারে জনমনে স্বস্তি এসেছে, যদিও আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছেন। অপর দিকে উদ্বেগজনক ঘটনা হলো, নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পরও বরগুনায় মাদক ব্যবসা বন্ধ হয়নি। বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সেখানে মাদকের রমরমা ব্যবসা চলছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, আগে ইয়াবা ব্যবসা শহরে সীমিত ছিল, এখন সেটি গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করছে?
আমরা রিফাত হত্যা মামলার বিচারকে স্বাগত জানাই। আশা করি, দ্রুততম সময়ে আপিল নিষ্পত্তি করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। সেই সঙ্গে এ কথাও বলা প্রয়োজন, ব্যক্তিবিশেষ শাস্তি পেলেই মাদক ব্যবসার মতো ভয়াবহ ব্যাধি দূর হবে না, এর সঙ্গে জড়িত নেপথ্যের গডফাদারদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় নতুন নতুন নয়ন বন্ড তৈরি হবে, যা কোনো সভ্য ও সুস্থ সমাজে চলতে পারে না।