রাখাইনের সর্বশেষ পরিস্থিতি মিয়ানমারের কোনো একটি কৌশলগত অভিযানের অংশ হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন নাকচ করা যাবে না। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সীমান্ত নিরাপদ রাখতে অব্যাহতভাবে মিয়ানমার সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়েছে। বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিভিন্ন উগ্র সংগঠনের সদস্যদের ধরে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার দীর্ঘ বিরতির পরে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সুর বদল করেছে। গত সোমবার মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের অফিসের মুখপাত্র জাউ হতাই একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মি এবং আরসা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়ে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।’ বাংলাদেশি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা তাদের অভিযোগের ধরন দেখে সন্দিগ্ধ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ নাকচ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হঠাৎ এমন অভিযোগ তোলার উদ্দেশ্য কী?
আরাকান আর্মি বৌদ্ধদের আর আরসা রোহিঙ্গা–সংশ্লিষ্ট সংগঠন। এত দিন তারা সন্ত্রাসের জন্য কেবল রোহিঙ্গাদের দায়ী করে আসছিল। এর আগে কথিতমতে পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার পরে তারা রোহিঙ্গাদের ওপর নারকীয় হামলা চালিয়েছিল। সীমান্তে ব্যাপক মাত্রায় সেনাসমাবেশ ঘটিয়েছিল। মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাতের কোনো কমতি নেই। এখন ওই হামলার দুই বছর পরে বাংলাদেশে নতুন একটি সাধারণ নির্বাচন হতে না হতেই আবারও কথিতমতে চারটি পুলিশ চৌকিতে ‘বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা’ হামলা চালাল। আর তাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সাত সদস্যের নিহত হওয়ার খবর বেরিয়েছে। রাখাইনের ঘটনাবলির বিবরণী অবশ্যই মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য হতে বাধ্য। কারণ, রাখাইনে এখনো বিদেশি কোনো সাংবাদিক বা সংস্থার প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছে।
মিয়ানমারের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ এবং রাখাইনের মগরা ধর্মবিশ্বাসে বৌদ্ধ হলেও দেশটির শাসক ‘বামারদের’ সঙ্গে আরাকানি বৌদ্ধদের জাতিগত বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব বহুকালের পুরোনো। আরাকানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে বামাররা কখনো মগদের সুনজরে দেখেনি। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, বামাররা রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতিতে সুচতুরভাবে ধর্মের বিষ ঢেলে রোহিঙ্গাবিরোধী নির্মূলযজ্ঞে মগদের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিল।
এবার তাদের উদ্দেশ্য কি বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তে আরও সেনাসমাবেশ বৃদ্ধি ঘটানো এবং সামরিক উপস্থিতি অব্যাহত রাখা? বিষয়টি অনেকেই উড়িয়ে দিতে চান না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখন এটাই সবচেয়ে বেশি বিবেচনায় নিতে হবে যে এই মগ ও বামারদের ঐতিহ্যগত দ্বন্দ্বের পরিণতিতে রোহিঙ্গাদের জনজীবনে বিরূপ প্রভাব আরও কতটা গভীরতা লাভ করে। কারণ, কথিত বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে তারা নিশ্চয় পাইকারি হারে মগদের বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশে ঠেলে দেবে না। অথচ এই সংঘাতের ঘটনায় দুর্গত রোহিঙ্গা পরিবারগুলো নো ম্যানস ল্যান্ডে আটকা পড়েছে। রাখাইন নতুন করে অশান্ত হওয়ার পরিণাম সেখানে আরও সামরিক উপস্থিতির যৌক্তিকতা দেওয়া এবং রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়া। বাংলাদেশকে তাই দেশটির কৌশল সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে।
রাঙামাটিতে অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ ‘আরাকান আর্মির’ দুই সদস্যের গ্রেপ্তারের খবরটি মিয়ানমারের অভিযোগের পরপরই বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হলো। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, এ রকম অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ এই সদস্যরা এত দিন লুকিয়ে থেকে অভিযোগ তোলার পরপরই কীভাবে ধরা দিল বা ধরা পড়ল? অবশ্য এতে এটা প্রমাণিত হলো, বিদেশি উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকার তার সংকল্পে বিশ্বস্ত।
বিশ্ব সম্প্রদায়কে যেটা বিবেচনায় নিতে হবে, তা হলো মিয়ানমার যদি কেন্দ্রীয়ভাবে জাতিগত সংঘাতের প্রশ্নগুলো সুরাহা না করে, তাহলে রাখাইনের পরিস্থিতি আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য ডামাডোলপূর্ণ থেকে যাবে। এর অর্থ হবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের প্রশ্ন ঝুলে থাকা। বাংলাদেশের ওপর আরও চাপ বৃদ্ধি পাওয়া।