দেশের বিচারব্যবস্থায় ‘স্বীকারোক্তি’ তার সব রকমের শুদ্ধতা হারাচ্ছে। একসময় পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিরও বিরাট মূল্য ছিল। সেসব এখন বিস্মৃত অতীতের গল্প। দেশের বিচারব্যবস্থায় এখন অলিখিতভাবে মেনে নেওয়া হয় যে ১৬১ ধারায় দেওয়া জবানবন্দির কোনো মূল্য নেই। যত মূল্য তা সব ১৬৪ ধারায়। কারণ, এই জবানবন্দি ধারণ করেন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা। আর ১৬১ ধারায় করে পুলিশ। আইন বিচারককে সুযোগ দিয়েছে পুলিশ বা অন্য কেউ ভীতি প্রদর্শন বা প্রলুব্ধ করে আনলেও তা খতিয়ে দেখেই তবে জবানবন্দি রেকর্ড করার। বিচারক তাঁর বিবেক অনুযায়ী সাক্ষ্য রেকর্ড করবেন। কিন্তু সমাজে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যাতে উল্লিখিত চিন্তাভাবনা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা কোথায় যাচ্ছে?
নারায়ণগঞ্জ শহরের কিছুটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ১৫ বছরের এক কিশোরী কথিতমতে অপহৃত হলো। পুলিশ প্রশংসনীয়ভাবে সন্দেহভাজন তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিল এবং এই তিনজনই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ‘স্বীকার’ করলেন যে তাঁরা কিশোরীটিকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। সেই ‘মৃত’ কিশোরী ৫১ দিনের ব্যবধানে ফিরে এসেছে।
পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দি যে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, তা প্রতিরোধে পুলিশের তরফে কোনো উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না। এটা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে কিছু পুলিশ অর্থ হাতিয়ে নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। উচ্ছৃঙ্খল হলেও শাস্তি অনিবার্য নয়, দায়মুক্তির এ রকম অলিখিত ভরসা নিয়ে চলতে পারে পুলিশ প্রশাসনের কতিপয় লোক। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় অনুমেয় যে পুলিশের প্ররোচনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কিশোরীকে ‘বুড়িগঙ্গায়’ ভাসাতে বাধ্য হয়েছিল। চরম স্বেচ্ছাচারী অথচ নিশ্চিত দায়মুক্তির ভরসার মধ্যে না থাকলে এ ধরনের প্লট সাজানো হতো না। কারণ, অহেতুক বিপদের ঝুঁকি তৈরি করে তো কোনো লাভ নেই। বরং তাতে ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কাই তৈরি হয়।
কিশোরী অপহরণের ঘটনায় সত্যি কী ঘটেছিল, তা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু পুলিশ করোনাকালে সাহসিকতার যে পরিচয় দিয়েছে, সেই ভাবমূর্তি দিয়ে এ ধরনের ঘটনার কুশীলবদের রুখে দেওয়া যাবে না। নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ওসির ‘কল্পনাশক্তি’ আরও প্রখর বটে। আমরা তাঁর ‘উপস্থিত বুদ্ধি’ দেখে হতভম্ব। তাঁর মনে সন্দেহ উঁকি দিয়েছে যে ধৃত আসামিরা ‘অন্য মেয়েকে’ নদীতে ভাসাতে পারেন। তাই নতুন করে তাঁদের রিমান্ড দরকার। অথচ ‘রিমান্ডের’ ভয় দেখিয়ে ওই তিন আসামির কাছ থেকে ইতিমধ্যে ৪৭ হাজার টাকা আত্মসাতের যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, সে ব্যাপারে তিনি নীরব। এই যে অবস্থা, এটা পুলিশ ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার বিবেকবান নীতিনির্ধারকদের উচিত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। অন্যথায় পুলিশের দেওয়া কোনো তথ্য বা বক্তব্যই আর মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হবে না।
এটা একটা রূঢ় বাস্তবতা। আহতবোধ নয়, পুলিশের আত্মজিজ্ঞাসা জরুরি এবং বাস্তবতা ধরে নিয়েই পুলিশের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের উচিত প্রচলিত বা দায়সারা প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বেরিয়ে আসা। শুধু পুলিশ নয়, পুরো বিচারসংশ্লিষ্টদের মনে রাখা দরকার, প্রতিকারমূলক যথা পদক্ষেপ না নিলে না বাঁচবে বিচারপ্রার্থী জনগণ, না বাঁচবে পুলিশ।
এ জন্য কিছু পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা দরকার। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের নেতৃত্বে পুলিশ বিভাগ–সংশ্লিষ্টদের একদম না রাখা। নারায়ণগঞ্জে প্রশ্নবিদ্ধ পুলিশি ‘তদন্তকাণ্ডের’ তদন্ত করবেন একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। উপরন্তু তিন সদস্যের কমিটিকে কোনো সময়সীমা বেঁধে না দেওয়াটাও কম উদ্বেগজনক নয়।
আমরা আশা করব, তদন্তে সত্য বেরোবে, দোষী চিহ্নিত হবে। কিন্তু জনমনে পুলিশের মাধ্যমে পুলিশের অনিয়ম উদ্ঘাটনের ব্যাপারে গভীর আস্থাহীনতা ও সংশয় আছে।