রাজধানীর মিরপুরে গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে চারজনের মৃত্যুর ঘটনাটি খুবই বেদনাদায়ক। গত বুধবার রাত ১১টার দিকে মিরপুর-১১ নম্বরের সি-ব্লকের ১১ নম্বর রোডের ছয়তলা বাড়ির গ্যাসলাইন মেরামত করার সময় এ বিস্ফোরণ ঘটে। এ দুর্ঘটনা আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, দেশের গ্যাস সরবরাহ লাইন ও সংযোগ কতটা ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ।
ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বাসাবাড়িতে গ্যাসলাইন বসানোর কাজ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু তারা একবার লাইন বসানো ও সংযোগ দেওয়ার পর খোঁজও নেয় না, সেটি কী অবস্থায় আছে। অনেক সময় গ্রাহকেরা তাদের সহায়তা চেয়েও পান না। বাধ্য হয়ে তাঁরা আনাড়ি মিস্ত্রিকে দিয়ে মেরামতের কাজ করান এবং দুর্ঘটনা ঘটে। গত ২৭ জুন মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকায় একটি তিনতলা ভবনে হঠাৎ বিকট শব্দের বিস্ফোরণে পুরো ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এতে আটজনের মৃত্যু হয়। তদন্তে জানা গেছে, মাটির নিচে গ্যাসলাইন লিকেজ হয়ে গ্যাস জমে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিমতল্লায় এলাকায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে তিতাসের পাইপলাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস জমে ঘটে আরেক বিস্ফোরণ। এতে প্রাণ হারান ৩৪ জন মুসল্লি। মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে লাইন মেরামতের আবেদন জানালেও তিতাসের স্থানীয় কর্মকর্তারা ঘুষ চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, রাজধানীতে অগ্নিদুর্ঘটনার প্রায় ৩০ ভাগই গ্যাসের পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে। বিভিন্ন শহরে যে গ্যাস সরবরাহ লাইন সম্প্রসারিত হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। খোদ রাজধানীতে অর্ধশত বছরের পুরোনো লাইনও রয়েছে। গ্যাস দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অবৈধ সংযোগ। গ্যাসের মতো অতি দাহ্য পদার্থের সঞ্চালন, সরবরাহ লাইনও সংযোগ হতে হয় শতভাগ টেকসই, নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত।
তিতাস কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা রোধে গ্রাহকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। আমরাও মনে করি, গ্যাসের মতো অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও দাহ্যপ্রবণ জ্বালানি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সচেতনতার প্রয়োজন আছে। কিন্তু তাতে তিতাস নিজের দায় তো এড়াতে পারে না। নারায়ণগঞ্জ ও মগবাজারের বিস্ফোরণের বিষয়ে কি তারা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে? ২০১০ সাল থেকে বাসাবাড়িতে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ আছে। তারপরও তিতাসের যেসব কর্মকর্তা উৎকোচের বিনিময়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন, তঁাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মাঝেমধ্যে অবৈধ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। কেবল বাসাবাড়ি নয়, শিল্পকারখানায়ও এ অবৈধ সংযোগবাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ আছে। গ্যাসের লাইনগুলো এতই ভঙ্গুর ও পুরোনো যে মেরামত করে লাভ হবে না। পুরোনো পাইপের বদল করে নতুন পাইপ দিতে হবে। একই সঙ্গে বাসাবাড়ির মালিকদেরও সচেতন হতে হবে, কোনো অবস্থায় নিম্নমানের চুলা ও রাইজার ব্যবহার করা যাবে না।
গ্যাস দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু যেমন মর্মান্তিক, তেমনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতারও প্রমাণ। একের পর এক গ্যাস দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, তারপরও কর্তৃপক্ষের হুঁশ হয় না। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ ধারা চলতে পারে না। আমরা গ্যাস দুর্ঘটনায় আর কোনো মৃত্যু দেখতে চাই না।