লক্ষ করলে ঢাকা মহানগরীর কোনো কোনো সড়কের মোড়ে ট্রাফিক সংকেতবাতি জ্বলতে-নিভতে দেখা যায়। অবশ্য যানবাহনের চালকেরা সেগুলো দেখতে পান কি না আমরা জানি না। আমরা দেখি, ওই সব রঙিন বাতির জ্বলা ও নেভার ওপর যানবাহনের থামা ও চলা নির্ভর করে না। যদি নির্ভর করত, তাহলে লাল বাতি জ্বলছে এবং যানবাহনও চলছে—এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়া অসম্ভব হতো।
ওই বাতিগুলো স্থাপন করা হয়েছিল স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেতব্যবস্থা হিসেবে। কিন্তু সেগুলোর কল্যাণে স্বয়ংক্রিয় কোনো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু হয়নি। এই মহানগরে যানবাহন চলে ও থামে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের হাতের ইশারায় ও হুইসেলের শব্দে। যানবাহনের চালকদের একটা বড় অংশ এতই অধৈর্য ও বেপরোয়া যে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় তাঁরা যান থামাতে চান না, তাঁদের দিকে তেড়ে যেতে হয় লাঠি উঁচিয়ে; কোনো কোনো চালক বাঁশ ফেলে পথ রোধ না করা পর্যন্ত যান থামান না। ফলে সড়কের মোড়ে মোড়ে কদর্য বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনার বিপদ ওত পেতে থাকে।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষে প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে পৃথিবীর অনেক শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় হয়েছে; হয়েছে সুশৃঙ্খল, কমে গেছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। অর্থাৎ আমাদের রাজধানী শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সেই মান্ধাতা পদ্ধতিতেই চলছে। এমন নয় যে আমাদের প্রযুক্তি কেনার আর্থিক সামর্থ্য নেই, এমনও নয় যে এ বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা করার কেউ নেই। ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় ২০০০ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা মহানগরীর ৭০টি সড়ক মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক বাতি বসানোর কাজ শুরু করা হয়; এই কাজ শেষ হয় ২০০৮ সালের শেষ দিকে। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার না করে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা হাতের ইশারায় ও বাঁশি বাজিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে যেতে থাকেন। ২০০৯ সালের নভেম্বরে প্রায় ৫০টি মোড়ে পরীক্ষামূলকভাবে স্বয়ংক্রিয় সংকেতবাতি ব্যবহার করা হয়েছিল; কিন্তু তিন-চার দিন পরেই সেগুলোর ব্যবহার বন্ধ করা হয়। ব্যবহার না করা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নজর না দেওয়ার ফলে স্বয়ংক্রিয় সংকেতবাতিগুলোর অধিকাংশই অকেজো হয়ে যায়।
একের পর এক প্রকল্প নিয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে কখনো স্বয়ংক্রিয়, কখনো আধা স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেতবাতি বসানো হয়েছে। এভাবে গত ১৯ বছরে যে ৭০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, তা পুরোপুরি অপচয়। কখনো কখনো দেখা গেছে, নগরীর কোনো কোনো সড়কে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেতব্যবস্থা চালু করা হলে গোটা মহানগরজুড়ে যানজট তীব্রতর হয়ে ওঠে; স্থবির হয়ে পড়ে গোটা রাজধানী। এ রকম কেন হয়, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে কোথাও হাতের ইশারায় ও বাঁশি বাজিয়ে আর কোথাও স্বয়ংক্রিয় সংকেতবাতির সাহায্যে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে বাড়তি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে, এটা বোধগম্য। যানবাহনের চালকদের সংকেতব্যবস্থা ব্যবহারের অভ্যাসের বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ঢাকা মহানগরীর স্বয়ংক্রিয় সংকেতবাতি বসানোর কাজটি করেছে সিটি করপোরেশন, আর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। এই দুই কর্তৃপক্ষের কাজে সমন্বয় নেই। সিদ্ধান্ত ছিল সিটি করপোরেশন ট্রাফিক বাতিগুলো ডিএমপিকে বুঝিয়ে দেবে। ডিএমপি বলছে, তাদের ট্রাফিক বিভাগে প্রকৌশলীর অভাবের কারণে তারা ট্রাফিক সংকেতবাতিগুলো বুঝে নিতে পারেনি।
অবিলম্বে এ সমস্যার সমাধান করা উচিত। সংকেতবাতি নিয়ন্ত্রণের কাজও ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগকেই পরিচালনা করতে হবে। হাতের ইশারা ও বাঁশি বাজিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থেকে স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থায় যেতে হবে।