যে পদ্ধতিতে ঢাকা মহানগরের অধিবাসীদের পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চলে আসছে, তা ঝুঁকিপূর্ণ ও অদূরদর্শী। এ নগরীর মোট পানির চাহিদার ৭৮ শতাংশই তোলা হচ্ছে মাটির নিচ থেকে। ঢাকা ওয়াসা বলছে, ঢাকা মহানগরে তাদের বসানো গভীর নলকূপের সংখ্যা ৯০০ পেরিয়েছে। আর বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। এই বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপ দিয়ে মাটির নিচ থেকে দিনরাত অবিরাম পানি তোলা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা দুই দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ, যার ফলে আমরা গুরুতর সংকটে পড়ে যেতে পারি।
প্রথমত, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বা ইকোসিস্টেমে ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়।
প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলা চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। উভয় প্রকার ঝুঁকির কথা আমাদের সবারই জানা আছে। সে জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয় সব দেশেই।
ঢাকা ওয়াসাও এ বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এই সংস্থা অনেক আগে থেকেই বলে আসছে, রাজধানী ঢাকার মাটির নিচের পানির স্তর বিপজ্জনক হারে নেমে যাওয়ার ফলে ব্যাপক হারে গভীর নলকূপ বসানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক দশক আগে ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি বলেছিলেন, এখন থেকে গভীর নলকূপ বসানো কমে যাবে। কিন্তু আসলে উল্টো কাজই করা হয়েছে, ওয়াসার এমডির দায়িত্ব নেওয়ার পরের ৯-১০ বছরে প্রায় ৩৫০টি নতুন গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে।
এর ফল কী হয়েছে, তা–ও অজানা নেই। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে; প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫ ফুট করে নেমে যাচ্ছে। আর এর ফলে পানি তোলার খরচ বেড়েছে এবং আরও বাড়ছে। ৮-১০ বছর আগে একটি গভীর নলকূপ বসাতে খরচ হতো ৪০-৫০ লাখ টাকা। এখন খরচ হয় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। মাটির নিচেও পানি ক্রমেই আরও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। আগে একটি গভীর নলকূপ দিয়ে ১০-১২ বছর ধরে পানি উঠত, আর এখন দু-তিন বছরের মধ্যেই পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। পানির স্তর নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর নলকূপ বসানোর ব্যয় ক্রমাগত বাড়ার ফলে ১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে পানির দাম বেড়েছে ১১ গুণেরও বেশি।
গভীর নলকূপের বাইরে আছে পাঁচটি পানিশোধনাগার, যেগুলো থেকে মোট চাহিদার ২২ শতাংশ পূরণ হচ্ছে। কিন্তু শোধনাগারের পানির উৎপাদন খরচ ভূগর্ভস্থ পানির উৎপাদন খরচের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। তা সত্ত্বেও আমাদের গভীর নলকূপের ওপর নির্ভরশীলতা দূর করতে হবে। ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বৃষ্টির পানি একটি ভালো উৎস, বর্ষা মৌসুমে তার প্রাপ্তিও অঢেল। ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সরকারি ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য একটি নির্দেশনা জারি করেছিল। কিন্তু ১৯ বছরেও নির্দেশনাটির বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।
আমরা মনে করি, এ নির্দেশনা সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়েই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কিছু মাত্রায় হলেও কমবে।