ভবদহের জলাবদ্ধতা

বহু মানুষের দুর্গতি যখন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অর্থপ্রসূ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাঁরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সেই দুর্দশার অবসান তো চানই না, বরং সেটিকে ছলেবলে কৌশলে যথাসম্ভব প্রলম্বিত করতে থাকেন। জনদুর্ভোগকে গোষ্ঠীস্বার্থে চড়া দামে বিক্রির সেই কুৎসিত লালসার কালো মেঘে নির্বল দুর্দশাগ্রস্তদের দুঃখের তিমির আর শেষ হয় না।

এই মনুষ্যলালিত সুদীর্ঘ দুর্দশার নির্মম ছবি যশোরের ভবদহ অঞ্চলের মানুষ দেখে আসছে। যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে এ অঞ্চল। সেখানে ছোট-বড় ৫৪টি বিল আছে। এ অঞ্চলের পানি ওঠানামার পথ মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদ। কিন্তু সব নদীই কমবেশি ভরাট হয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি বিল থেকে বের হতে না পারায় বিলসংলগ্ন গ্রামগুলো তলিয়ে যায়। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এ জলাবদ্ধতা নিরসনের একমাত্র উপায় এলাকার নদীগুলো দিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে জোয়ার-ভাটা চালু করা। এতে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি নির্দিষ্ট বিলে অবক্ষেপণের ফলে বিল উঁচু হয়ে উঠবে। পাশাপাশি ভাটায় স্বচ্ছ পানির স্রোতে নাব্যতা ফিরে পাবে নদীগুলো। এ পদ্ধতিকে বলে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট-জোয়ারাধার)।

টিআরএমের জন্য অনেক বছর ধরে দাবি জানানো হচ্ছে। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে কর্মকর্তারা ফি বছর অস্থায়ী খনন ও সেচ প্রকল্প পাস করাচ্ছেন। বর্তমানে ৬০ কোটি টাকার একটি সেচ প্রকল্পের কাজ চলছে। তাতে এলাকাবাসী দৃশ্যমান কোনো উপকার না পেলেও ফের ৫০ কোটি টাকার নতুন একটি সেচ প্রকল্প পাসের প্রক্রিয়া চলছে। অথচ এটি এখন ‘উন্মুক্ত গোপনীয়’ বিষয় যে সেচযন্ত্র বসিয়ে পানি সেচলে কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী ঠিকাদারদের পকেট ভারী হবে, কিন্তু জলাবদ্ধতা কমবে না। আদতে সমস্যা জিইয়ে রেখে স্থায়ী ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করাই এ সেচতত্ত্বের উদ্দেশ্য। নতুন প্রকল্পে এলাকার ভুক্তভোগী মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয় না। কারণ তাঁরা এসব প্রকল্প সমর্থন করেন না। তাঁরা চান নদীগুলো ঠিকমতো খনন করে জোয়ার–ভাটা নিশ্চিত করা হোক। পানি যায় যে নদী দিয়ে, সেই নদীই বুজে গেছে। তাই নদীকে পর্যাপ্ত পানি পরিবাহী করা দরকার। এ বাস্তবতা বুঝতে হবে।