লন্ডনভিত্তিক শিক্ষাবিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন বিশ্বের সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ৯২টি দেশের ১ হাজার ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আছে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ বিশ্বের সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ভারতের ৩৬টি, পাকিস্তানের ৭টি ও শ্রীলঙ্কার ১টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ২০১৬ সালের মানক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৬০০ থেকে ৮০০-এর মধ্যে ছিল। এখন সেটি ১ হাজার ৩০০তে নেমে এসেছে। এটি শুধু দুঃখজনক নয়, লজ্জারও বটে।
গত মে মাসে সাময়িকীটি এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই তালিকায়ও এশিয়ার ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও উল্লেখ ছিল না। সে সময় বিভিন্ন মহলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও সংশ্লিষ্টরা আমলে নেয়নি। এবারও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা জরিপের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
এর মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের ব্যর্থতাকেই অস্বীকার করছেন না, সত্যকেও আড়াল করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। এই প্রবণতা আত্মঘাতী। টাইমস হায়ার এডুকেশন মানক্রমে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়, তা হলো শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম, সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, এ খাত থেকে আয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতা। পত্রিকাটি যেসব সূচকের ভিত্তিতে এই মানক্রম করেছে, সেগুলোকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। একই সূচকে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জায়গা করে নিতে পারলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় কেন পারল না? ওই জরিপ থেকেই আমরা জানতে পারি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছে গবেষণায়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি গবেষণাই না হয়, তাহলে শিক্ষার মান বাড়বে কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয় কেবল শিক্ষা বিতরণ করে না, শিক্ষা সৃষ্টিও করে। আর উন্নত গবেষণার মাধ্যমেই সেটি সম্ভব।
আরেকটি কথা, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান যে ক্রমেই নিচের দিকে যাচ্ছে, তা জানতে বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপের প্রয়োজন হয় না। প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার নামে যেসব অনাচার ঘটে চলেছে, তা শিক্ষার পরিবেশের পরিপন্থী। শিক্ষক নিয়োগ থেকে পদায়ন-পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্যই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পছন্দের ব্যক্তিকে শিক্ষক করার জন্য আইন শিথিল করার বহু উদাহরণ আছে। যেখানে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার-সমর্থক শিক্ষকেরা গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে লিপ্ত এবং উপদল ভারী করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকেন, সেখানে শিক্ষার মান বাড়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে করি না।
সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে, যেসব দেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে, তার মূলে রয়েছে উন্নত শিক্ষা। পৃথিবীতে এমন একটি দেশ পাওয়া যাবে না যে শিক্ষায় পিছিয়ে থেকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা শিক্ষা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়াতে যতটা সক্রিয়, শিক্ষার মান ধরে রাখতে ততটাই নিষ্ক্রিয়। এ কারণে সরকার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করছে, ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা সনদপ্রাপ্ত হলেও শিক্ষালাভ করেন না।
এই মুহূর্তে হয়তো আমরা ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার শিক্ষার মানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠব না, কিন্তু প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান কিংবা শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে কেন পিছিয়ে থাকব?
ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায়, কিন্তু যারা জেগে ঘুমানোর ভান করে, তাদের জাগানো কঠিন। আমাদের শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ঘুম ভাঙবে কবে?