বিদেশের শ্রমবাজার

সম্পাদকীয়

করোনা সংক্রমণের শুরুতে বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানির হার কমলেও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ বেশি ছিল। এর অন্যতম কারণ, করোনাকালে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো কমে যাওয়ায় বৈধ পথে বেশি অর্থ এসেছে। সরকার প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ওপর যে ২ শতাংশ প্রণোদনা দিয়েছে, তাতেও তাঁরা দেশে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হয়েছেন।

কিন্তু বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় ‘সংকুচিত হয়ে পড়েছে বিদেশের শ্রমবাজার’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা দুই দিক থেকেই উদ্বেগজনক। পুরোনো শ্রমবাজারে মন্দা ও নতুন শ্রমবাজার তৈরি করতে না পারায় চার বছর ধরে বিদেশে কর্মী পাঠানো কমছে। ফলে কমতে শুরু করেছে প্রবাসী আয়ও।

বেসরকারি খাতে বিদেশে কর্মী পাঠানো রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের সংগঠন বায়রা ও রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদের (রোয়াব) মতে, করোনাকালে সৌদি আরবে শ্রমিকের চাহিদা থাকলেও নানা কারণে তারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিএমইটির তথ্য বলছে, বছরে রেকর্ড ১০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে যান ২০১৭ সালে। ২০১৮ সালে এটি কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩৪ হাজারে। ২০১৯ সালেও বিদেশে যান ৭ লাখ কর্মী। করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে শ্রমবাজারে ধস নামলেও পুনরুদ্ধারে জোরদারে কোনো চেষ্টা নেই। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো বন্ধ আছে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। এরপর দুই দেশের প্রতিনিধিরা দফায় দফায় বৈঠক করেও শ্রমবাজার চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার। গত বছর এটি চালুর ঘোষণা হলেও করোনার কারণে গতি পায়নি। গত বছর দেশটিতে গেছেন মাত্র ১ হাজার ৮২ কর্মী; চলতি বছর ৪ হাজার ৬৯০ জন। করোনার প্রভাব পড়েছে কুয়েত, জর্ডান, বাহরাইন ও লেবাননের শ্রমবাজারেও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনার শুরু থকেই প্রবাসী আয় বাড়তে শুরু করে। তবে তিন মাস ধরে এটি কমতে শুরু করেছে। গত বছরের আগস্টে এসেছিল ১৯৬ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়। এবার আগস্টে ১৮১ কোটি মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগে জুলাইয়ে ১৮৭ কোটি ডলার ও জুনে ১৯৪ কোটি ডলার পাঠান প্রবাসীরা। ওই দুই মাসেও আগের বছরের চেয়ে কম এসেছে।

করোনাকালে বিদেশের শ্রমবাজারে যে ধস নেমেছে, তা মোকাবিলায় কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। আমদানিকারক দেশগুলোর চাহিদামাফিক আমাদের কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া; দ্বিতীয়ত, শ্রমশক্তির নতুন বাজার ও খাত খুঁজে বের করা এবং বিদেশে গিয়ে আমাদের শ্রমিকেরা যাতে অহেতুক হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে দূতাবাসগুলোর তদারকি জোরদার করা। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ দেশে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির চাহিদা বেশি, সেসব দেশে কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে দ্রুত আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলো দূর করা। পারস্পরিক দোষারোপ ও দায় এড়ানোর সংস্কৃতি বাদ দিয়ে বিদেশে শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত সব সংস্থা, প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা যেতে পারে।

সর্বোপরি বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির নামে যারা মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এরা কেবল বিদেশে চাকরি–ইচ্ছুক মানুষের সর্বনাশ করছে না, দেশের ভাবমূর্তিও ধুলায় লুটিয়ে দিচ্ছে।